ঈদ কড়চা ঃ ত্যাগ-ভোগ-ব্যাবসা-নৈতিকতা

লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ০৫ অক্টোবর, ২০১৪, ০৩:০০:২১ দুপুর

ফজল সাহেব হাটে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটা কালো-সাদায় চকরা-বকরা একটা নাদুস-নুদুস খাসী। বেশ পছন্দ হয় খাসীটি। দরদাম করে কিনেও ফেলেন। খাসীর মালিক জহুর আলি এসেছেন সুদুর পাবনা থেকে। বিনীত ভাবে বলে স্যার, খাসিটা খুব আদরের খাসী, আমার মেয়েটা খুব কেদেছে ওকে হাটে এনেছি বলে, বলতে বলতে তার চোখও ছল ছল করে ওঠে। স্যার ওকে দু-মুঠো ভাত খেয়ে দিয়েন, এক মুঠ চাল দিয়েন। আর স্যার, ও একা থাকতে পারে না, ওর কাছে কেউ যেন থাকে। খাসীর গাল নিজের গাল লাগিয়ে শেষ আদর করে দেন জহুর আলি। ফজল সাহেবের মন টা অন্য রকম ভাল হয়ে যায়, এরকম আদরের প্রিয় জিনিষই তো কুরবানি দিতে হয়। মনে মনে বলেন আল্লাহ আমার কুরবানি গ্রহণ করবেন কিনা জানিনা তবে জহুর আলির এই কুরবানি যেন তিনি কবুল করেন

বরকত সাহেব হাটে কিছুক্ষন ঘুরেই বুঝে গেলেন গরুর দাম বেশ পড়ে গেছে। খুশি মনে দর-দাম করে ভাল সাইজের একটা গরু কিনে ফেলেন। নির্ধারিত বাজেটে প্রত্যাশার চেয়ে বড় গরু পেয়ে যান, বেশি গোশতের লোভে চিক চিক করে উঠে চোখ, আনন্দের আতিশয্যেএক কলীগ কে, “হ্যালো রফিক ভাই, গরু কিনে ফেললাম, হ্যা, মাত্র ত্রিশ হাজার...” আসুন এর উলটো পিঠটা দেখি। মোবারক ধার দেনা করে ২ লাখ টাকায় দশটি গুরু কিনে ছিলেন ছয়মাস আগে, গরুগুলো পালতে গিয়ে বিগত ছয় মাসে আরো ১ লাখ টাকা খরচা করেছেন, আশা ছিল একেকটি গড়ে চল্লিশ হাজার করে বেচতে পারবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি...শেষ দিন বিকালে ছেড়ে দিতে হলো পচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে...মা ভক্ত ছেলে মাকে ফোন করে ডুকরে কেদে ওঠে “ মা আমার তো পুজি উঠল না...” মা স্বান্তনা দেন মন খারাপ কইর না বাবা, সামনে বার হবে...ভালায় ভালয় বাড়ি চলে আস। সামনে বার হবে এ আশায় বাচে বাংলাদেশের কৃষি খাতে জড়িত বেশির ভাগ মানুষ।

আট বছরের আবুল কলোনির পিছনের কাঠাল গাছ থেকে কয়েকটি ডাল কেটে নেয়...গত কাল এই পরিমান ডাল বেচে ৫০ টাকা পেয়েছিল। ডালগুলি নিয়ে ঘুরছিল অভিজাত এলাকার ফ্লাট গুলোর সামনে। এক সাহেব ডেকে দাম জিজ্ঞেস করেন, “স্যার, ৫০ টেকা দিয়েন...দেড় কেজি চাল হইব...।মায় আইজকা কামে যাইতে পারে নাই”...সাহেব পাতা গুলো নিয়ে কুড়ি টাকা ধরিয়ে দেন, যা ভাগ, এই কটা কাঠাল পাতার দাম চায় ৫০ টা, বেটা বড় হয়ে তো ডাকাইত হইবি... আবুল আরো কিছুক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করে চলে আসে। সে জানেনা দশ হাজার টাকায় খাসী, ৫০ হাজার টাকায় গরু কিনলে এদের সমাজে দাম বাড়ে কিন্তু আবুল কে কাঠাল পাতা বাবদ ত্রিশ টাকা বেশী দিলে উনাদের ওয়ালেটে টান পড়ে।

ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় ধনে পাতা কিনতে বাজারে যান সুমন সাহেব, মহল্লার ছোট কাচা বাজার, ৫-৬ টি দোকান আছে এখানে। তবে আজ মাত্র দুইটি খোলা। পরিচিত জনের কাছেই যান তিনি। দোকানদার বলে, “স্যার সারদিন দুই জনে শসা বেচছি ৪০টাকা কেজি দরে। এখন আমারডা শেষ, উনি ষাট টাকা কেজি বেচতি শুরু করছেন...” কত ভাবেই না ব্যাবসা হয় ঈদ কে ঘিরে...গরুর হাটের ইজারা, গরু পরিবহন, টিকেটের কালোবাজারী্‌, আনফিট গাড়ি রাস্তায় নামানো, পুরনো বটি-দাও ধার দেয়া কিম্বা নতুন টা কেনা, একদিনের জন্য কসাই বনে গরু-ছাগল বানানো, জিনিস পত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়া আরও কত কি?? লাভটাই আসল, নৈতিকতা তো বোকাদের বিষয়!!

এই ফাকে ব্যাবসা করে নেয় মোবাইল কোম্পানি গুলোও...গরু কিনে ছবি এমএমএস করা, আবার ফোন করে কনফার্ম করা যে এমএমএস পাইছে কিনা, গরু কেমন লাগল, ঈদ মোবারক জানিয়ে এসএমএস/এমএমএস পাঠানো...কিম্বা জ্যামে আটকে পড়া মানুষের অপেক্ষারত প্রিয়জন কে আপডেট দেয়া...”হ্যা মা, কালিয়াকৈর পার হইছি, তবে যে জ্যাম মনে হয় ঈদের দিন বিকাল হইব...দোয়া কইর...”

তবুও ঈদ আনন্দের। প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে লেখাটি শেষ করব:

শহীদের ঈদ এসেছে আজ

শিরোপরি খুন লোহিত তাজ

আল্লাহর রাহে চাহে সে ভিখ।

জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে

আল্লাহর রাহে তাহারে দে

চাহিনা ফাকির মনি-মানিক।

চাহিনাক গাভী, দুম্বা, উট

কতটুকু দান? ও দান ঝুট!

চাই কোরবানী, চাইনা দান।

রাখিতে ইজ্জত ইসলামের

শির চাই তোর, তোর ছেলের

দেবে কি? কে আছ মুসলমান?

ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

ঈদ মোবারক।

বিষয়: বিবিধ

১৩৫২ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

271639
০৫ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০৩:৫১
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০৫ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:১৭
215843
শরীফ নজমুল লিখেছেন : ধন্যবাদ।
আপনার ভালও লেগেছে জেনে আমারও ভালও লাগল।
271648
০৫ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:১৬
ফেরারী মন লিখেছেন : অসম্ভব সুন্দর লিখেছেন। বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। তাদের জন্য আমার করুণ হয় কিন্তু একা একা কিছু করতে পারি না।
০৫ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:১৮
215845
শরীফ নজমুল লিখেছেন : কার জন্য আপনার করুণা হয়?
271649
০৫ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:১৬
ফেরারী মন লিখেছেন : অসম্ভব সুন্দর লিখেছেন। বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। তাদের জন্য আমার করুণ হয় কিন্তু একা একা কিছু করতে পারি না।
271665
০৫ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৫:৩৫
আফরা লিখেছেন : ফেরারী মন লিখেছেন : অসম্ভব সুন্দর লিখেছেন। বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। তাদের জন্য আমার করণা হয় কিন্তু একা একা কিছু করতে পারি না।
০৬ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৭
216072
শরীফ নজমুল লিখেছেন : আপনার মন্তব্যএর জন্য ধন্যবাদ।
271679
০৫ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৪
শেখের পোলা লিখেছেন : জহুর আলির কথায় মনে পড়ল, আমার ছেলে মেয়েরা একটা খাসী পালতো৷ বাড়িরই বাচ্চা কেনা নয়৷ সবাই তাকে খুব আদর করত৷ সকালে আমাদের বাড়ি চা রুটির চলন ছিল৷ আমার মা তাকে চা রুটি খাওয়াত৷ সকালে চা রুটির জন্য সে ঠিকই বারান্দায় হাজির হত৷ আমার ছেলে তার নাম রেখেছিল পন্টি৷ নামধরে ডাকলে যেখানেই থাক দৌড়ে আসত৷ আমার ছোটমেয়ে রোজ তাকে ফ্যান পানি খাওয়াত৷ বাচ্চা অবস্থায় কাছে নিয়ে ঘুমাত৷ ৯৬ তে কোরবানীর সময় প্রথম দেশে গেলাম৷ তখন সে বেশ বড় হয়েছে৷ মা ওকেই কোরবানী দিতে বললেন৷ দিলাম, নিজের হাতেই জবাই করলাম৷ ঈদের বাকী দিনটা আমার ছোটমেয়ে শুধুই কেঁদে কাটিয়েছিল৷ তখন সে ক্লাশ থ্রীতে পড়ত৷
০৬ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৬
216070
শরীফ নজমুল লিখেছেন : আপনার গল্পটি ভালো লাগলো। ছোটকালে আমরাও দেখতাম কুরবাণীর জনয় একটি খাসী পালা হোত বছর ধরে, যে থাকত ওনেকটা পরিবাবের সদস্যের মতই। নিয়ম করে চড়ে বেড়াত, দুপুরের এসে বাসায় ভাত খেত। সন্ধ্যায় কারও পাশে বসে জাবোর কাটত।
এখন ওবশ্য বাস্তবতার নিরিখে সেসব উবে গেছে।
আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালও লাগলো।
ঈদ মোবারক!
271735
০৫ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:৩৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অত্যন্ত সুন্দর!
আমরা কতটুক কুরবানি এখন করতে পারি আসলে?
মোবারক বা জহুর আলি রা তাদের পরিশ্রম এর দাম পায়না যেখানে।
০৬ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৬
216071
শরীফ নজমুল লিখেছেন : সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File