বইয়ের বোঝা আর হিন্দী কার্টুনের মাঝে হারিয়ে যাওয়া শৈশব

লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৪:৩৬:১৪ বিকাল

আম্মু একটু খেলতে যাই?

খেলতে যাওয়া মানে নীচের গ্যারেজে গিয়ে গেটের গার্ডদের সাথে একটু ক্রিকেট খেলা। ভাগ্য ভাল হলে পাশে বাসার সমবয়সী ছেলেটি নামে। গেটের বাইরে যাবার অনুমতি নাই। আশে পাশে কোন মাঠও নাই।

কিন্তু তাতেও মা’র সায় নাই। কি ছেলেরা বাবা, লিখাপড়ায় একটু ও সিরিয়াস নয়। খালি খেলা আর খেলা। আর কয়দিন পরেই পরীক্ষা। মা বাধা দেয়। না বাবা, তোর সোস্যাল সাইন্সের প্রশ্ন তো এখনো মুখস্ত হয়নি। বাংলা একবার লিখতে হবে। আচ্ছা এক কাজ কর, তুই বাংলার প্রশ্ন চারটা লিখে দেখা, তার পর যাস।

ধরে নেই এই শিশুটির নাম শিশির। বয়স কত হবে? ধরুন সাত বা আট। ক্লাস ওয়ান বা টুতে পরে।

ছেলেটি টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখে। ব্যাট হাতে নিয়ে ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করে। বাবাকে বলে আমি ক্রিকেট খেলতে চাই। কিন্তু মাঠে যেয়ে খেলা তো দুরের কথা, এক মাঠও চোখে দেখে না সে। একটা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং নিয়ে তার স্কুল, মাঠ বলতে সেখানেও একটা গ্যারাজ! যেখানে বাচ্চাদের ভীড়ে হাটা মুশকিল, খেলা তো দুরের কথা!

মুখ ব্যাজার করে চারটি প্রশ্ন লিখে মা’র দিকে খাতা ছুড়ে দেয় সে। দৌড়ে বেরিয়ে যাবার প্রাক্কালে মা তাকে স্মরন করে দেয়, তাড়াতাড়ি চলে আসবি। একটু পরেই টিচার আসবে। টিচার গেলে সোস্যাল সাইন্সের প্রশ্নগুলি মুখস্ত করবি, একবার লিখতে হবে। কাল সিটি আছে, মনে আছে তো?

এতো কথা শুনবার সময় তার এখন নাই। এই পনের মিনিট কিম্বা আধা ঘন্টা তার খেলার সময়, এ মুহুর্ত সময় ও নষ্ট করতে চায় না।

ধরুন ছেলেটি ক্লাস টু তে পড়ে। ইংলিশ ভার্সন। বোর্ডের নির্ধারিত বই বাংলা, ইংরেজী এবং অংক। বইগুলো আবার বেশ সহজ। এগুলি পড়ে কি ভিত্তি শক্ত হবে? সামনে অনেক প্রতিযোগিতা, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে চান্স পেতে হবে। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার যদি হতে নাই পারল, তাহলে আর এত কষ্ট করে ছেলে-মেয়ে মানুষ করে লাভ কি? এটা হল বাবা-মার ধারনা-প্রত্যাশা। বোর্ডের কোর্স যারা ডিজাইন করেছেন তারা মনে হয় বেকুব না হয় স্বল্প শিক্ষিত, নাহলে এত কম বই আর সহজ বই তারা দেয় কি করে? স্কুল গুলো আরা বাব–মা বোধ হয় চায় বাচ্চারা যেন ওয়ান-টুতেই জাফর ইকবাল কিম্বা অমর্ত্য সেন হয়ে যায়!! স্কুলগুলো ও আরেক কাঠি সরেস। ভালো স্কুল সাজবার জন্য বোর্ডের বইয়ের সাথে যোগ করে আরো একগাদা বই। রেডিয়ান্ট ওয়ে, জুনিওর ইলিশ, ব্রাইটার গ্রামার, বাংলার বাড়তি বই, রিলিজিওন, সোস্যাল সাইন্স, জেনেরেল সাইন্স, জেনারেল নলেজ, সাথে আছে ড্রইং, গান শেখা। এরকম একটা স্কুলে ক্লাস থ্রীতে পড়ানো জিওগ্রাফী বই দেখছিলাম, লেখকরা বলছেন এটা ক্লাস ফাইভের জন্য, একটি ইন্ডিয়ান বই। স্কুল কত্তৃপক্ষ এটাকে ক্লাশ থ্রীতে দিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বাচ্চাদের এটা গ্রহন করবার ক্ষমতা আছে কিনা এটা দেখবার কেউ কি আছে? প্রত্যেক বিষয়ের আবার ন্যুনতম চারটা খাতা। সব-বই খাতা একসাথে করলে তার ওজন ঐ বাচ্চার ওজনের চেয়ে বেশী হয়ে যেতে পারে। শুধু পড়লে তো হবেনা। পরীক্ষা দিতে হবে। বছরে তিন বার, মাঝে আছে ক্লাশ টেস্ট বা সিটি।

বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের অভাব নাই। রিমোট ঘুরায়ে চ্যানেল শেষ করতে পারি না। কিন্তু শিশুদের জন্য কোন চ্যানেল তো নাইই এমন কি তেমন মানের কোন অনুষ্ঠান ও নাই।যদি পড়ার ফাকে একটু সময় তারা পায় তারা গোগ্রাসে গিলে ডরেমন আর সব বিদেশী কার্টুন। মায়েরাও মনে হয় খুশী বাচ্চাদের অনুষ্ঠান থাকলে আবার তার হিন্দী সিরিয়াল দেখবার সময়ের ভাগ দিতে হবে বাচ্চা কে!

বাচ্চাদের এভাবে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে কি লাভ হচ্ছে জানিনা তবে শৈশবের আনন্দ থেকে তারা আজ বঞ্চিত। বিদেশী কার্টুন দেখে তারা আজ দেশী সংস্কৃতির শিক্ষা থেকে আজ বঞ্চিত। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীকে এ নিয়ে কথা বলতে শুনে খুব আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্ত খুব বেশি কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। আসলে শুধু সরকারের বা কি করার আছে? অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বাবা-মা কেন চাইবে ক্লাশ টু-থ্রীতে তাকে আইন্সটাইন হতে হবে? কেন ক্লাশ নাইনের প্রথম ছয় মাসেই দুই বছরের সিলেবাস শেষ করতে হবে? তাহলে এই কোর্স টা দুই বছরের জন্য ডিজাইন করা হলো কেন? যারা স্কুল চালান, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাবিদ, শিশু মনস্তত্ববিদ সবাই কে সচেতন হতে হবে। আমি যতবার আমার ক্লাশ টু পড়ুয়া ছেলেকে পড়াই ততবার আমি অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয় যে কেন একটি বাচ্চাকে এরকম কষ্টকর পড়া নামক যন্ত্রণা ভগ করতে হবে। আমাদের নীতি-নির্ধারক রা চাইলেই এটা অন্য রকম হতে পারত। বাচ্চারা পড়া-শুনা করতে আনন্দের সাথে।

বিষয়: বিবিধ

১৩১৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

260400
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৪
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৩৬
211179
শরীফ নজমুল লিখেছেন : ধন্যবাদ।
অবশ্য দুষ্টপোলাদের একটু বেশীই পড়ানো দরকার। কি বলেন?
260500
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৩১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়ে সুন্দর পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি দেখেছি ভাল কয়েকটি স্কুলে কম পড়ানতে সেখানে পড়াশুনা হয়না বলে পিতামাতা বাচ্চাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন!! অতিরিক্ত পড়ার চাপে এখন শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ অত্যন্ত বেশি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File