অহংকার না করাই ভালো (জীবন থেকে নেয়া)ঃ

লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:২৯:৫৮ সকাল



ধরা যাক তার নাম চন্দন (সংগত কারণে ছদ্মনাম ব্যাবহার করা হলো)। পেশায় ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। আমি তখন একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে এসিস্টেন্ট ম্যানাজার হিসাবে কর্মরত, সেটা আমারো প্রথম চাকুরি, অভিজ্ঞতা বছর তিনেকের। কোম্পানিও নতুন, আমিও কোম্পানীর শুরু থেকেই কাজ করছি। মিস্টার চন্দন আমার সাথে কাজ করেন।

সেবা বিস্তারের সাথে সাথে আমরা ঢাকার বাইরে তিনটি অফিস খুললাম। ইউনিট অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হলো তিনজন মাস্টার্স ডিগ্রী পাস ছেলেকে। চন্দন রয়ে গেল আমার সাথে হেড অফিসে। সে ফিল্ডে গেলে নিয়ে যেত অফিসের জীপ আর ইউনিট অফিসাররা ফিল্ডে ঘুরাঘুরি করত লোকাল ট্রান্সপোর্টে। এমডি স্যারের গুডবুকে ছিলেন চন্দন বাবু।

ভালোই চলছিল। কিছুদিন পর ইউনিট অফিসারদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া শুরু করলাম যে চন্দন বাবু উনাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেন। তারা পদ-মর্যাদায় বড় সেই সম্মান তো দেনই না, বরং উল্টা-পাল্টা বকা-ঝকা করেন। চন্দন বাবুর কাজ ছিল সমনন্বয় করা, প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া, তাদের উপর খবরদারী করা নয়। উলেখ্য ইউনিট অফিসাররা ছিলেন অফিসার পদ-মর্যাদায় আর চন্দন বাবু ছিলেন সহকারী অফিসার পদ-মর্যাদায়। সবার রিপোর্টিং ছিল আমার কাছে।

যাই হোক অভিযোগের মাত্রা বেশী হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে চন্দন বাবু কে ইউনিট অফিসগুলোর কো-অর্ডিনেশন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। একই সাথে তার কাজের পুরস্কারও দেয়া হবে। সিরাজগঞ্জে চতুর্থ ইউনিট অফিস খোলার সিদ্ধান্ত হলো, চন্দন বাবুকে অফিসারে হিসাবে প্রমোশন দিয়ে সে অফিসের ইউনিট অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হলো। ঢাকার বাইরে যেয়ে সেটল হতে যেন সমস্যা না হয় সেজন্য এক মাসের সময় দিয়ে চিঠি দিয়ে জানানো হলো।

চন্দন বাবু এক মাস নিয়মিত অফিসে করলেন। তিনি ঢাকার বাইরে যেতে চান না এরকম কিছু বললেন না। আমাদের কাজ ছিল আরেকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলিত ভাবে, যাদের এরিয়া অফিসে চন্দন বাবুর জয়েন করবার কথা। যে দিন তার সিরাজগঞ্জে যাবার কথা সেদিন আমি অফিসে ছিলাম না, ট্যুরে যাচ্ছিলাম। চন্দন বাবু আমাকে ফোন দিয়ে বললেন তিনি ওখানে যেতে চান না। আমাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিলেন। উনি ছাড়া এই অফিস চলবে না সেটাও শুনিয়ে দিলেন। উনি প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিবেন কারন যোগ্য লোকের চাকরির অভাব নাই।

আমার মাথা এবং মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমরা কাজ করি তাদের এরিয়া ম্যানেজারকে বলা আছে আজ আমাদের অফিসার যাবে, উনি উনার ফিল্ড প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে আমাদের অফিসারের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাছাড়া এখন নতুন একজন কে নিয়োগ দিয়ে এই অফিস চালু করতে এক মাসের উপর সময় লাগবে, আমার পারফরমেন্স নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যাহোক একটু রাগারাগি করে বললাম আপনি আজকেই রিজাইন দিয়ে অফিসে ছেড়ে চলে যান। এবং তিনি তাই করলেন। যাবার পর দেখা গেল উনি যে মোবাইল ফোনটি ব্যাবহার করতেন সেখানে প্রায় হাজার পঞ্চাশেক টাকার বিল তুলেছেন এই এক মাসে।

অফিসের এই ব্যাপার টা সামিলিয়ে নিলাম। সময়ের পরিক্রমায় ভুলে গেলাম চন্দন বাবুর কথা।

তার প্রায় দুই বছর পরের কথা। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বদলেছে। আমাদের ইউনিট অফিসে বেড়ে ১০টি পার হয়ে গেছে । পরবর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন ইউনিট অফিসে গুলোতে বিএসসি এঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চন্দন বাবু থাকলে আজ গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে একই পদ-মর্যাদায় থাকতেন। আমি তখন অবশ্য এই অফিসে ছেড়ে দেবার জন্য প্রস্তুত, কারন আরেকটি চাকরি পেয়ে এক মাসের নোটিশ দিয়ে রিজাইন দিয়েছি, শেষ মাসের অফিস করছি।

ঠিক এমন সময় একদিন অফিসে এসে হাজির চন্দন বাবু। “ভাই আমি খুব বিপদে আছি। কোথাও কোন চাকরি যোগাড় করতে পারিনি। পরে ব্যাবসার চেষ্টা করেছি, তাও কিছু করতে পারিনি বরং পুজি যা ছিল তা হারিয়েছি। আমার এখন না খেয়ে থাকবার যোগাড়।“ বলেই তিনি পা ধরতে আসেন।

খুব বিব্রত বোধ করি, যেদিন তিনি ফোন করে বলেছিলেন যে তাকে ছাড়া এই অফিস চলবে না, তার কাজের অভাব হবে না, তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে চান, সেদিনের রুঢ় এবং দাম্ভিক চন্দন বাবুর অবয়ব মনে পড়ে। আবার খারাপও লাগে। বিপদ্গ্রস্ত চন্দন বাবুর আগের ব্যাবহার ভুলে তাকে সাহায্যের চেষ্টা করবার সিদ্ধান্ত নেই। তবুও বললাম আমি তো ভাই এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, এই কোম্পানীর ম্যানেজমেন্ট মনে হয় আমার কথা রাখবে না। তাছাড়া বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাকে আগে দেখেন নি। তবুও তার অনুরোধে ঢেকি গিললাম। ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে গিয়ে তার ব্যাপারটা ব্রিফ করে বললাম স্যার তাকে নিতে পারেন। এখানকার কাজগুলো তার জানা। নতুন একজন নেবার চেয়ে তাকে নিলে তাড়াতাড়ি রিটার্ণ পাবেন। স্যার কড়া মানুষ ছিলেন, বললেন যে একবার ছেড়ে চলে গেছে তাকে আবার নেবার কোন দরকার আমি দেখছিনা। আমি চন্দন বাবুকে ফিডব্যাক দিলাম। উনি আশাহত হয়ে চলে গেলেন। এই ঘটনা প্রায় ১১ বছর আগের। পরে অবশ্য চন্দন বাবুর কোন খবর আর জানি না।

আমি জীবন থকে শিখলাম, অহংকার করা ভালো নয়। সব সময় নিজের ওজন বুঝে চলা উচিত।

বিষয়: বিবিধ

১৬২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File