ডাবল জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি পরীক্ষায় পাশ নম্বর তুলতে পারছে নাঃ কোন অন্ধকার অভিমুখে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা?
লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ০১ জানুয়ারি, ২০১৩, ০১:১৪:২৯ দুপুর
কদিন আগে হয়ে গেল জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট। আনন্দিত শিক্ষার্থীদের ছবিতে ভর্তি পেপারের পাতা, সাফল্যের কীর্তিগাথায় বিশাল হেডলাইন, হাজার হাজার জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর। মন ভালো হয়ে যাবার মত একটি ব্যাপার। আমরা এক সময় দেখতাম মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট-এ পাশের হার ৩০ থেকে ৪০ এর ঘরে থাকত, তা এখন শুধুই স্মৃতি। পাশের হার এখন চলে গেছে ৮০-৯০ এর ঘরে।
বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নতি বুঝতে আরো কিছু উদাহরন দেয়া যায়। প্রাইমারী স্কুলের ভর্তির হার প্রায় ৯৭ (মেয়ে) আর ৯৪ (ছেলে)। ১৫-২৪ বছরের বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষিতের হার ৭৪ (ছেলে) আর ৭৭ (মেয়ে) [তথ্য সুত্রঃ ইউনিসেফ ওয়েবসাইট)।
সন্দেহ নাই, এই সমস্ত ইন্ডিকেটর দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায় শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি ঈর্ষনীয়। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যা নয়, গুণগত মানের বৃদ্ধিও দরকার
যেদিন জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে খবর আসল ঠিক তারপরের দিন প্রথম আলোয় একটা রিপোর্ট এসেছে যে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ৪৪ হাজার ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে, যারা মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত, তাদের ৫৫ শতাংশ উত্তীর্ণ হতে পারে নি। বিগত দুই বছরে এই অনুত্তীর্ণের হার ছিল ৫৩ ও ৫২ শতাংশ। উল্লেখ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ১২০ নম্বরের পরীক্ষায় ন্যুনতম ৪৮ পেতে হয় অথচ এরা মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন।
মেডিকেলে ভর্তির জন্য যে লটারীর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে সেটি কি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে না? এত বিপুল সংখ্যক জিপিএ-৫ পাওয়া যখন ভর্তি পরীক্ষায় পাশ নম্বর তুলতে পারে না তখন মেট্রিক-ইন্টার-এর রেজাল্টের ভিত্তিতে মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে ভর্তির বিষয়টি কি অনুমোদন করা যেতে পারে?
যখন শিক্ষার উন্নতি নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে ব্যাস্ত হয়ত আমরা সবাই, তখন এই খবরটি কি আশার গুড়ে বালি দিয়ে দেয় না? সর্ষের মধ্যে কি ভুত আছে? যখন শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নামে কিম্বা অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তখন আমরা বাবলের কথা শুনি। অর্থাৎ ভিতরে কিছু নাই, ভিতর ফাপা করে ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করা হয়েছে এমন বুঝায়। শিক্ষা ব্যাবস্থা ভালো হয়েছে দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কি শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাবল তৈরি করা হচ্ছে বা হয়েছে?
দুই বছর আগে এক পুরাতন বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল যে কিনা আমরা যে স্কুলে পড়েছি সে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। সে তার হতাশার কথা বলছিল। খাতা দেখাবার সময় বোর্ড থেকে বার বার তাগিদ দেয়া হয় যেন যতটুকু পারে নম্বর বাড়িয়ে দেয়া হয়। পঁচিশের উপরে পেলেই যেন তাকে পাশ করিয়ে দেয়া হয়। ৭৫-৭৯ পেলে যেন ৮০ দিএয় দেয়া হয়। অর্থাৎ রেজাল্ট ভালো করতে হবে সেটাই প্রধান। পাশের হার বাড়াতে হবে, জিপিএ-৫ বাড়াতে হবে। বোর্ডে বোর্ডে প্রতিযোগিতা হবে।তখন ব্যাপারটা তে এতটা গুরুত্ব দেইনি, প্রথম আলোর রিপোর্ট তা ভাবতে বাধ্য করল। মন্ত্রীও চান ভালো রেজাল্ট, রেজাল্টের পরিসংখ্যান ভালো হলেই চলবে, সেটা দিয়ে উনার মন্ত্রীত্বের সাফল্য মুল্যায়িত হবে, হাসিমুখে প্রধান মন্ত্রীকে রেজাল্ট ঊপহার দিতে পারবেন।গুণমান দেখবার মত সময় কারো আছে কি?
এই ছেলে-মেয়ে তো গুলির কোন দোষ নাই। তাদের কে আমরা যে সিস্টেম দিয়েছি তারা তার মধ্যে দিয়ে ভালো করে এসেছে। তারা শর্টকাট শিখেছে, কিভাবে জিপিএ-৫ পাওয়া যায় সেভাবেই পড়েছে। কিন্তু তারা যে শিক্ষার মুলে যেতে পারছে না, সেটি তো আমাদের নীতি নির্ধারকদের ধরতে পারা উচিত। গুণগত শিক্ষা না পাওয়ায় তারা ব্যাক্তি জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সামগ্রিক ভাবে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষায় বেশ ভালো উন্নতি হয়েছে, সেটার জন্য সরকারের চেষ্টার আমরা প্রশংসা করি। তবে উন্নতি হলেই হবে না, সেটি টেকসই (sustainable)কিনা সেটাও দেখতে হবে। আজকের ছাত্ররা আগামী দিনের দেশের কর্ণধার হবে। সময়ের পরিক্রমায় আরো অনেক জটিল সময়ে তারা দেশ কে নেতৃত্ব দিবে। আজকে আমাদের ভুলের কারনে বিষয়টা কে গুরুত্ব না দেবার কারনে যদি ভবিষ্যতে আমরা মেধাহীনতায় পড়ে যাই, আমাদের উন্নতিটুকু অর্থহীন হয়ে যাবে। তখন হয়তা আমরা অনেকেই থাকবনা যখন হয়ত আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের প্রতারক হিসাবে চিহ্নিত করবে।
সুতরাং শিক্ষা নিয়ে বাবল তৈরী নয়, সঠিক গুণগতমান নিশ্চিত করা দরকার। এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিযোগিতা হবে সারা বিশ্বের মাঝে, সেখানে কোয়ালিটি নিয়ে হেলা-ফেলার কোন সুযোগ আছে কি? আশা করি নীতি নির্ধারনী দ্বায়িত্বশীলরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৩৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন