শৈশব স্মৃতির নুড়ি পাথর
লিখেছেন লিখেছেন জোছনার আলো ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০১:২৫:২৮ দুপুর
শৈশব শব্দটার সাথেই যেনো মিশে থাকে দুষ্টুমিতে,আদরে,শাসনে,ভালোবাসায় ভরপুর স্মৃতির কথামালা। মায়ের হাজারো বারণ,নিয়মুবার্তিতা,কঠোর শাসনের আড়ালে মমতা ভরা হৃদয়, বাবার আদর ,ভাইয়াদের ভালোবাসার প্যাকেটে মোড়ানো ছোট্ট সেই আমি,বান্ধবীদের সাথে খেলা-ধুলা,মারামারি,ঝগড়া শেষে টিফিন ভাগাভাগি করে নেয়া এই সব কিছুই ভেসে আসে শৈশবে শব্দটা শুনলেই।
বর্ষা কালে আমাদের বাড়িটি হয়ে যেতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।গাছ-গাছালিতে ঘেরা আমাদের সেই বাড়িটি।
আমার জন্ম গ্রামে। একদম গ্রামীন পরিবেশে কাদা-মাটি,প্রকৃতি আর সবুজতার সাথে মিতালি করেই আমি বড় হয়েছি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমরা আর আমার মেঝো চাচার পরিবার ছিলাম। বিক্রমপুরের বাড়িগুলো হয় কাঠের তৈরী।আমাদের বাড়িটিও ছিলো কাঠের তৈরি দুতলা ঘর। বিশাল বড় বাড়িতে দোতলা তিনটি ঘর।আমাদের বাড়ির উঠানের অপরপ্রান্তে ছিলো চাচাদের বাকি দুটা ঘর। আর বাড়ির চারপাশ জুড়ে ছিলো আম,জাম,কলা,লিচু, তাল, তেতুল,চালতা, আতাফল,নারিকেলসহ অনেক ফল ও ঔষুধি গাছ।ঔষুধি গাছে মধ্যে ছিলো ঘৃতকুমারী,আমলকীসহ আরো নাম না জানা লতা পাতার গাছ। আমার বাবা আর চাচা মিলে লাগিয়েছিলো গাছগুলোকে। বাপ-চাচাদের দেখাদেখি আমরা চাচাতো ভাই বোনেরা মিলে একটা ফুলের বাগান করেছিলাম বাড়ির প্রবেশ মুখের দখিনপাশে। ঘাসফুল,গোলাপ ফুল, হাস্নাহেনা, জবা, মোরগ ফুল,দিনমনি ফুল, গাঁদা ফুল, গন্ধরাজ ,বেলিফুল,আর নীলুপরাজিতা ফুলে ভরপুর ছিলো বাগান। প্রতিটি ঋতুতেই কোনো না,কোন ফুল থাকতো তার রুপমাধুর্য নিয়ে।শুনেছি, হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে রাতে নাকি সাপ আসে, আমার সেঝো চাচীমার কবরের পাশে লাগিয়েছিলাম একটি গাছ। গাছটি এখনো আছে, তবে সাপ মহাশয়ের সাথে সাক্ষাত হয়নি আমাদের কারো।
দুরন্তপনা
শৈশবের খেলার সাথী,বন্ধু,ভাই,গল্প বলার সাথী ,হাউজ টিচার এই সবই ছিলো আমার ছোট ভাইয়া। আমি ছিলাম বদে হাড্ডি আর ভাইয়া ছিলো শান্তশিষ্ট ছেলে। সহজে বইয়ের ধারে কাছে যেতামনা। ভাইয়া গল্পের ছলে,শব্দ নিয়ে খেলা করে,আমাকে পড়া শিখাতো।
ভাইয়া অনেক মাটির হাড়িপাতিল কিনে দিয়েছিলো। ভাইয়া আর আমি মিলেও মাটি দিয়ে ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল, জগ, মগ, চাচম, কড়াই,ফুল এসব বানাতাম। ভাইয়া আমার থেকে ছ’বছরের বড় হলেও এসব খেলায় সব সময়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। মাটির খেলনা গুলোকে রোদে শুকিয়ে, মাটির চুলায় জ্বলন্ত কয়লার নীচে রাখতাম।খেলনা গুলো শক্ত আর লাল বর্ণের হয়ে যেতো। সেই খেলনা নিয়ে বিকেলে সোজা হিজল গাছের নীচে মাদুর পেতে বসে যেতাম খেলতে।চড়ুইভাতি খেলতাম। গাছের পাতা দিয়ে ছোট্ট ঘর বানাতাম। সাথে থাকতো পাড়াতো বান্ধবীরা। কচুরী পানাকে চাকু দিয়ে কেঁটে বানাতাম মাছ,বালুর তৈরী ভাত,ইটের গুড়া দিয়ে হলুদ,বড়াই গাছের উপরে এক ধরণের আগাছা দিয়ে বানাতাম সেমাই।ছেলেদের কাজ ছিল বাজার করা।আম গাছের পাতা হতো টাকা। রান্না শেষে খেয়ে দিতাম ঘুম।ঘুম ভাংলেই খেলা শেষ।
এছাড়াও কুমীর-কুমীর খেলা,গোল্লা ছোট, ক্রিকেট,ব্যাটমিন্টন সহ আরো কত খেলা ওপেনটি বায়োস্কোপ খেলতে খেলতে বলতাম,
‘’ওপেনটি বায়োস্কোপ,নাইন-টেন টেস্কোপ
সুলতানা-বিবিআনা, সাহেব বাবুর বৈঠক খানা
বৈঠক খানায় গিয়ে, পান-সুপারি খেয়ে
পানের আগা মরিচ বাটা,স্প্রিংয়ে ছবি আকা
যার নাম রেণুমালা, তাকে দিব মুক্তার মালা"
আমার সেঝো ভাইয়ার ছিলো মাছ আর পাখি ধরার নেশা।মাছ রাখার ঝুড়ি নিয়ে ভাইয়ার পেছনে আমিও ছুট।নলা মাছ,রুই মাছ,কাতল মাছ,পুটি মাছ, কৈ মাছ ঝুড়ি ভর্তি করে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। গায়ে কাঁদা-মাটির ছড়াছড়ি।মা ভিষন রেগে যেতো। গোসল করিয়ে দিত মারতে মারতে। ভোর বেলায় চুপিচুপি চাচাতো বোনদের সাথে নৌকা নিয়ে শাপলা তুলেছি কত! শাপলা ফুলের মালা গেঁথে গলার হার হাতের চুড়ি বানিয়ে আপুরা আমাকে সাজিয়ে দিত।
একটু বড় হলে আরবী শিক্ষার জন্য মসজিদে পাঠানো হলো। সকাল বেলা উঠে ভাইয়ার সাথে যেতাম।হুজুর (তিনি গত বছর মারা গিয়েছেন।আল্লাহ ওনাকে জান্নাতবাসীকরুন।) সুন্দর করে সূরা মুখস্ত করাতো।বোর্ডে লিখে লিখে শিখেছিলাম আলিফ,বা,তা,ছা জিম.........।। বাড়ি ফিরার পথে ভাইয়া ইসলামী সঙ্গীত শুনাতো।ছোট বেলা থেকেই ভাইয়ার কাছে শুনে শুনে অনেক গজল,সূরা মুখস্থ করে ছিলাম।
প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম ভাইয়ার হাত ধরেই।আর প্রথম দিনেই পালালাম স্কুল থেকে।সেই সাথে ধরা পড়ে মায়ের হাতে ডাল ঘুটনি দিয়ে মার ও খেয়েছিলাম। স্কুলের হেডমাস্টার ছিলো ভিষন রাগী।ক্লাশ ফোরের একটা ছেলেকে ধমকাচ্ছিলো।সেই ভয়েই স্কুল পলায়ন আমার। পরবর্তিতে অবশ্য স্যার এর অনেক আদর আর ভালোবাসা পেয়েছি। স্কুলে প্রথম বন্ধুত্ব হলো বিথী নামের এক মেয়ের সাথে।অনেক দুষ্টূমি করেছি দু’জনে মিলে।
স্কুলে নতুন বই পেলেই তার গন্ধ শুকতাম।বানান করে করে বইয়ের গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ পড়ে ফেলতাম। প্রতি মাসে ভাইয়া আমার জন্য নিয়ে আসতো ‘কিশোরকন্ঠ, মাসিক মদিনা, আদর্শ নারী’’। গল্প ও ছোটদের বয়স উপোযোগী হাদিসের বই।
বর্ষার সময়ে একবার সাঁতার শিখাতে সেঝো আর ছোট ভাইয়ার সাথে গিয়েছিলাম।কলার গাছ ধরে সাঁতার শিখাচ্ছিলো ভাইয়া। কলার গাছ থেকে ধপাস করে গেলাম পানিতে পড়ে। সেই সাথে খেয়ে ফেলেছিলাম পানি। শামুকে পা কেটে গিয়েছিলো।সেই দাগ আজো আছে আমার পায়ের পাতায়।
আমাদের নৌকা নিয়ে ভাইয়া আর আমি ধঞ্চা ক্ষেতে যেতাম। ধঞ্চা গাছের হলুদ ফুলগুলো বাতাসে দোলতো,সেই সাথে আমাদের নৌকা। ভাইয়া ওর বই নিয়ে এক পাশে পড়তো, অন্যপাশে আমি খেলতাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে, হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে যেতাম। গ্রামে কারেন্ট অনেক জ্বালাতন করতো।বারান্দায় মাদুর পেতে পড়তে বসতাম। হারিকেন জ্বালিয়ে দিত মা। তেতুল গাছের প্যাঁচাটা তাকিয়ে থাকত গাছের ফাঁকে।
শীতের সকালে নিজেদের গাছের খেজুরের রস খেতাম রোদে বসে।শিশির ভেজা ঘাসে পা ভিজিয়ে ঘরে ফিরতাম। চাঁদনি রাতে জোস্নার আলোয় শুয়ে মায়ের কাছে গল্প শুনতাম। একা একা আকাশের তার গুনতাম।মাঝে মাঝে জোনাকী পোকা ধরে মশারীর ভেতরে ছেড়ে দিতাম। মায়ের বকুনী খেয়ে তাদের আবার ছেড়ে দিতাম শুন্যে। জোনাকী গুলো মিটিমিটি আলো বিলাতে বিলাতে চলে যেতো দূর দিগন্তে
ওহ,লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে মেলায় যেতাম। আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগতো নাগরদোলায় চড়তে।মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিলেও নেশা ছিলো। খাবারের মধ্যে প্রিয় ছিলো নিমকি।
সময়ের সাথে সাথে শৈশবের সেই দিনগুলো থেকে যোজন যোজন দূরে চলে এসেছি। তবে সময় পেলেই দু'চোখ বন্ধ করে খুজে বেড়াই আমার ফেলে আসা শৈশবকে।
বিষয়: বিবিধ
৫৬৮৬ বার পঠিত, ৬৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শৈশব স্মৃতির নুড়ি পাথর
নিয়ে এলো
আর আমাদের স্মৃতিতে ভাসাল
স্মৃতির ভেলায় ভাসতে তো আর মানা নাই।
লিখে ফেলুন আপনিও শৈশব নিয়ে কথা
চাওয়া,পাওয়া, না পাওয়ার ব্যাথা।*-
উপরের কথাটি আপনার লেখা থেকে চয়ন করা। বুঝাই যাচ্ছে আপনি এখনও চঞ্চল। তবে আপনার লিখাগুলো আরো প্রাণচঞ্চল ও প্রানবন্ত। সুন্দর লিখাটি পড়ে আমিও আমার ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের ধুলোবালির রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক ধন্যবাদ, ভাল থাকুন।
আপনার শৈশব জানার অপেক্ষায় রইলাম ভাইয়া। শুভেচ্ছা জানবেন।
এক পিকুলিয়ার মানুষ নামে পর্বটি এখান থেকে দেখতে পারেন।
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/1704/tipu1900/20825
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/1704/tipu1900/21342
খুব ভালো লেগেছে আপনার শৈশবের সেই সময়ের ঘ্রাণটুকু! আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ভিতরে স্মৃতিকে ধরে রাখার সব চেয়ে বেশী কার্যকরী ভূমিকা রাখে এই ঘ্রানেন্দ্রিয়। এক সময় আমার লেখা 'সময়ের ঘ্রাণ'লেখাটি টি ব্লগে পোষ্ট করার ইচ্ছেটা রাখছি।
আপনার লেখায় অনেক মুগ্ধ হলাম।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ভালো থাকবেন সবসময়।
কঠিন এক পরিস্থিতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে টুমরো ব্লগ ।
অনেক দিন পরে দুষ্টু ও ফাঁকিবাজ আপুটাকে পেয়ে ভীষণ ভালো লাগতেছে ..... ব্লগথেকে এতদিন দুরে থাকা ভালো না আমরা অন্নে---ক মিস করছিলুম আপনাকে...... ইমন ভাইয়া ভালো আছেতো? সালাম জানাবেন আসসালামু আলাইকুম......
স্টিকি পোস্ট এর জন্য বিশেষ শুভেচ্ছা জানবেন।
অনেক অনেক ভালো থাকবে আফরা আপুনি।
আমার শিশুকালের আপনি কি লিখবেন এই নিয়ে ভাবনার
একটা ফটক দিলাম
গ্রামের পরিবেশ এখনো টানে।
গ্রাম ছেড়ে থাকা অসম্ভব।
শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো এখনো অমলিন।
বারংবার মনে হয় যদি সেই শৈশব আবার ফিরে আসতো! নারিকেল গাছের ডাল ধরে দোল খাওয়ার অনুভূতি, ছোট যখন ছিলাম তখন সুপারি গাছের খোলের উপর বসে গাড়ি চড়েছিলাম। কটকটি,বোম্বাই আইসক্রিম এর কথা মনে আছে হয়তো?! গান বাজিয়ে নৌকাতে করে আইসক্রিম বিক্রি করতে আসত আইসক্রিমওয়ালা সেই দৃশ্যতো ভোলার মত নয়। ৫০ পয়সায় পেতাম আটপিছ গোল বিস্কিট সে কথা ভুলি কিভাবে? মোট কথা আপনার লিখাটা পড়ে শৈশবে একটা ডুব দিয়ে এসেছি । শেষের দিকটাতো অনন্য সাধারন। দোয়ায় আমীন।
(++++++++++++++++++++
আলহামদুলিল্লাহ অন্নেক ভালো লাগলো অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু অসাধারন অনূভুতিগুলো অনন্য সাধারন লিখার দ্বারা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য
আপনার শৈশব স্মৃতি কবে পড়বো?
টুনটুনির ব্লগের কি খবর।
জোসনা আপু কি আর ছোটপাখি টুনটুনি হবেনা?
চোখে বড় চশমা পড়া সেই টুনটুনির অপেক্ষায়।
আপনার সাথে যেন আমরাও হারিয়ে গিয়েছি সেই উন্মুক্ত মাঠ আর সবুজ বৃক্ষছায়ায়। ফুল,পাখি আর পানির মাঝে।
অসম্ভব গতিশিল আকর্ষনিয় লিখাটির জন্য অাবারও ধন্যবাদ।
পাশেই মেঘনা নদী আর নৌকা। আজ যেখানে থাকি, নেই কোন খাল, বা নদী,নেই ঘন সবুজের মাঠ। মাঝে মধ্যে লেইক রয়েছে কয়েক শত মাইল দুরে। তবুও হৃদ্ধয়ে একেঁ আছে আমার বাংলাদেশ।
খুব ভাল পোষ্ট অশেষ ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন