ভালোবাসার পরাজয়!! .........
লিখেছেন লিখেছেন জোছনার আলো ১৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:১২:৫৪ বিকাল
জোছনা ধোয়া চাঁদনী রাত………।। ছোট্ট আবদার, ‘একটা গল্প বলো না’। বলা মাত্র-ই শুরু……এক ছিলো সোনার রাজ্য।সেই রাজ্যে এক রাজকন্যা ছিলো। তার নাম…………………। উহহ! আমি জানি তার নাম………সেই রাজকন্যা আমি-ই। না শুনবো না এই গল্প।। তাহলে?
অন্য কিছু………।। আতস পাখির পাখির গল্প,ফুল-পাখিদের গল্প, প্রকৃতির গল্প বা………অন্যকিছু………।।
পরন্ত বিকেল বেলা……… মেঠো পথ, পথের দু’ধারে গাছের সারি………মৃদু বাতাস ছোয়ে যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে……দূওওওরর থেকে দেখা যেচ্ছে, সেই মেঠো পথের উপরে ছোট ভাইয়ার হাত ধরে একটি লাল টুকটুকে ফ্রক পরে, এই আমি, সেই দিনের ছোট্ট মেয়েটি লাফিয়ে লাফিয়ে চলছি।কখনো না পথের পাশে বসে বসে গল্প করছি……… বয়স কত হবে তখন আমার?? হুমমম…………সাড়ে চার কি পাঁচ!স্কুলে যাওয়া সবে শুরু করেছি মাত্র!রাস্তার ধারে কৃষকেরা মাঠের ধান ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত! সেই কাজ দু’জন বসে বসে দেখি………সেই ফাঁকে ফাঁকে চলে গাছ-পালা,পাখি,কৃষকদের গনণা করা। দুইটি পাখি ছিলো আর এই মাত্র একটি পাখি এলো।তাহলে পাখির সংখ্যা কত হলো? ভেবে উত্তর দেই ‘তিনটি’ এই তো এভাবে এবাভেই তো অংক শিখা হলো আমার। বাক্য গঠন টাও শিখে ছিলাম খেলা করতে করতেই ………। ঝটপট লিখে দিতাম। সঠিক উত্তর লিখতে পারলেই মজার মজার গিফট!
বর্ষার দিনে……চারপাশে থৈ থৈ পানি…আমাদের বাড়িটা যেনো বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ…নৌকা নিয়ে চলে যাওয়া হতো মাঠের মাঝে……ধইঞ্চা (শুদ্ধা নামটা যানা নেই)। ক্ষেতের ফাঁকে নৌকা টা রেখে হাড়ি-পাতিল খেলা শুরু হতো আমার ভাইয়ার সাথে। কচুরিপানার তৈরী মাছ, বালুর চাল দিয়ে ভাত রান্না করা,বরই গাছের যে আগাছা হয় ,তা দিয়ে সেমাই রান্না করে ভাইয়া কে দিতাম। ভাইয়া বই নিয়ে পড়তো।তার পাশে আমি। কাজটা ছিলো কিভাবে ভাইয়াকে বিরক্ত করানো যায়। তবে ভাইয়া কখনোই রেগে যেতো নাহ। ভাইয়ার পাশে বসেই রংধনুর সাত রঙ্গে ভেসে যেতাম মেঘের দেশে। মাটি দিয়ে খেলনা বানানো, কাপড়ের পুতুলের বিয়ে, গাছের ডালে বসে দুষ্টুমি করা, এসবের সঙ্গি আমার ছোট ভাইয়া।
এভাবেই তো বড় হলাম আমি। স্কুলে যখন যাওয়া শুরু করলাম, ভাইয়া নিয়ে যেতো। পাজি স্যারগুলো কে যা ভয় পেতাম!! ভয়টা ভাঙ্গানোর কাজটাও ভাইয়া করে ছিলো। আর পড়া-শুনা? এসব মানুষ করে? ইয়া মোটা মোটা বই (ছোট্ট বেলায় আমার মতে) কি সব আবোল-তাবোল লিখা। 'আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা' চাঁদ আমার মামা হতে যাবে কেনো? আজব!! এসব আমি পড়বো না''। কিন্তু আমাকে কিভাবে পড়াতে হবে তা ভাইয়া জানতো ভালো করেই। ভাইয়া ছড়া আবৃতি করতো আর আমি তার সাথে তাল মিলাতাম। তখন কি আর বুঝেছি না কি যে আমাকে বইয়ের পড়া শেখানো হচ্ছে? সঁন্ধ্যা বেলায় গ্রামে কারেন্ট এর ঠিক-ঠিকানা নেই। উঠানে মাদুর পেতে পড়তে বসতাম ভাইয়া আর আমি। আমাদের বাড়ির চারপাশেই গাছ-পালা।শীতল মৃদুলা বাতাসে আমার দুষ্টূ চুলের উরাধুরা ছুটু-ছুটি। ভাইয়া ক্লিপ দিয়ে আটকে দিতো পাজি, হতচ্ছারা চুলগুলো কে। জোনাকী পোকা ছুটু-ছুটি করতো পাশে। আমার চাই-ই চাই জোনাকী। পড়া বাদ দিয়ে ভাইয়া ছুটতো।তার সাথে সাথে আমি। জোনাকী ধরে মশারীর ভেতরে ছেড়ে দিয়ে ভাই-বোন মিলে ওদের খেলা দেখতাম। পুকুর পাড়ে কচুরী ফুলের জন্য ভাইয়া-ই যেতো কাদায়। আমি বসে বসে তা দেখতাম।
একবার হলো কি, খেলতে গিয়ে মুখে প্রচন্ড ব্যথা পেলাম। আমি কি কান্না করবো, আমার রক্ত দেখে ছোট ভাইয়া কান্না করতে করতে শেষ। আবার, একবার সাঁতার শিখতে গিয়ে পা' শামুক দিয়ে কেটে ফেললাম।সে সময়েও ভাইয়া পাশে। তখন ক্লাশ ফোরে পড়ি। ভাইয়ার কোলে করে বাসায় ফিরলাম। মায়ের বকাগুলো ভাইয়া হজম করলো। তবে আমাকে কিছু বলতে দেয় নি। এভাবেই তো আমার ছোট্ট বেলার সঙ্গি ছিলো ছোট ভাইয়া। একটা মুহুর্তো আমার কাটে না তাকে ছাড়া। যখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি, ভাইয়া চলে গেলো রংপুরে। আমি হয়ে গেলাম একদম একা। কিছু-ই ভালো লাগে না আমার। এক মাস পরেই চিঠি।
'আপু,'
কেমন আছো তুমি? খাওয়া-দাওয়া করো তো? মা কে একদম বিরক্ত করবে না।। আমি নেই তাই আম্মুর সাথে সাথেই থাকবে। একা একা পুকুরে যাবার দরকার নেই। আর পড়াশুনায় ফাঁকি একদম চলবে না। আম্মুর সাথে নিয়মিত নামাজ পড়বে কেমন? নিজের খেয়াল রেখো।আল্লাহ হাফেয '
চিঠির মুল বক্তব্য এমন ই ছিলো। চিঠির জবাব দেয়া চাই। আমার ছোট্ট হাতে চিঠি লিখলাম। ভাইয়া দারুন খুশি আমার চিঠি পেয়ে। প্রতি মাসের চিঠি আদান-প্রদান হতো। আর ফোনে তো কথা বলা হতোই। তবুও আমার ভাইকে আমার পাশে চাই। ক্লাশ সিক্সে আমিও চলে গেলাম রংপুরে। ছোট ভাইয়ার কাছে। যেনো দেহের মাঝে প্রাণটা ফিরে পেয়েছিলাম।
কিন্তু তাও বেশি দিন থাকা হলো না। ভাইয়া ঢাকায় চলে এলো ইন্টার পরীক্ষার পরে। জাবিতে ভর্তি হলো। আবারো আমি একা। প্রতিদিন মোবাইলে কথা বলেও মন ভরে না।
এস,এস,সি পরীক্ষার পরে আমিও নিলাম ভাইয়ার পিছু।ঢাকায় চলে এলাম। এর পর তো এক সাথেই চলা। সাভার থেকে ঢাকায় ছুটে আসতো ভাইয়া।এইচ,এস,সি পরীক্ষার আগে আমার হলো চিকেন পক্স!ভাইয়া রাত জেগে রইলো আমার পাশ।। সারাক্ষন বলে 'কি খাবো', 'এখন কেমন লাগছে',এটা সেটা কত কি!! কষ্ট জেনো আমার না তার-ই হচ্ছে। গত রোজার ঈদে আমার একটু জ্বরে কি পরিমাণ দুঃশ্চিন্তাটাই না করছিলো।গভীর রাত পর্যন্ত মাথার পাশে বসে থেকে চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাবিতে যেদিন ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবো, ভাইয়ার চাকরীর ইন্টার ভিউ ছিলো। তাতে না গিয়ে আমাকে নিয়ে ছুটলো। যখন চান্স পাইনি তখন আমার জন্য যতটুকু না খারাপ লেগেছিলো, তার চেয়েও বেশি খারাপ লেগেছে ভাইয়ার জন্য। এরপর তো ভাইয়াও ভার্সিটির লেকচালার হলো আমিও সেই পিছু নিলাম তার। সেই ভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়ে গেলাম।
এক সাথে যাওয়া। কি যে আনন্দ । সারা পথটা জুড়ে ভাই-বোনের গল্প চলে।খাবার টেবিলে গল্প করতে করতে কখন যে খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়! মা এসে বকা দেয় -এত কি গল্প করিস তোরা?' মা কে বলে বুঝাতে পারি না ভাইয়ার সাথে সময়গুলো যে কিভাবে কেটে যায় । বুঝতেতেই পারি না। সেই সুখটাও এখন আমার হারাতে হবে। ভাইয়া চলে যাবে সেই সে সুদূরে! বুঝতেছি না ভাইয়া একা একা কিভাবে থাকবে,কে রান্না করে দিবে। কি খাবে না খাবে! উফ!! ভাবতেই বুকের মাঝে কষ্টটা চিনচিন করে বেরে যাচ্ছে!
লাইফে তো আর কম দুষ্টুমী করিনি! সব ক্ষেত্রেই ভাইয়া বুঝিয়েছে। কখনো ঝাড়ি মেরে একটা কথাও বলেনি। জীবনে চলার পথে যখন-ই পা পিচ্ছলে পড়ে যেতে ধরেছি,তখন-ই ভাইয়া হাতটা ধরে বলেছে ''উঠো, জীবনে পথে পথে কাটা তো থাকবেই,তাই বলে কি কাটার কাছে হার মানবে?জীবনটা তোমার, তাই একে সাজিয়ে নাও ইচ্ছে মতো ''
ভাইয়া কে বলছি,- 'ভাইয়া তুমি জানো না আমার হ্বদয়ের কোথায় আছো। বাকী তিন ভাইকেও আমি খুব ভালোবাসি, তোমাকে তার চেয়েও বেশি। তবুও তোমার আদর,স্নেহ,ভালোবাসার কাছে আমি পরাজিত। এ পরাজয়টাই আমার অহংকার!
খুব বেশি ভালোবাসলে মানুষ হয়ত বা কখনো কখনো স্বার্থপর হয়ে যেতে চায়। এখন আমার খুব বেশি বলতে ইচ্ছে করছে 'ভাইয়া, যেও না । কি দরকার পি,এইচ,ডি করার। কি দরকার বিদেশে পড়ি দেবার। আমার কাছা-কাছি থাকো। আমার কিছু হলে কে দেখবে আমাকে? জানি মা-বাবা আছে, ভাইয়ারা আছে। তবুও আমার তোমাকেই চাই!!''
বিষয়: বিবিধ
৩৭৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন