মিসরের খসড়া সংবিধানের ভালোমন্দ দিকগুলো

লিখেছেন লিখেছেন মারুফ আল্লাম ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২, ০২:১০:৩৩ দুপুর



মিশরে প্রস্তাবিত সংবিধানের ওপর গণভোট সম্পন্ন হয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্ম অবমাননা, নারী অধিকার এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকাসংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয়ে সংবিধানে যেসব বিধান রাখা হয়েছে, তা নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা সমালোচনা চলছে। মিশরে সাংবিধানিক পরিষদের সদস্যরা প্রস্তাবিত সংবিধানের যে খসড়া প্রণয়ন করেছেন, তাতে তাহরির স্কোয়ারের সেই উত্তাল আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটবে সেটাই সকলের প্রত্যাশা। গত কয়েক মাস ধরে দেশটির আইনপ্রণেতা, সুশীল সমাজের সদস্যবৃন্দ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমন একটি সংবিধানের জন্য লড়াই করছেন যেখানে অধিকারকে সুরক্ষিত করা হবে, ইসলামী মূলনীতিগুলোর প্রতিফলন থাকবে এবং স্বৈরশাসনের অবসান নিশ্চিত করা হবে।

তবে ১০০ সদস্যের এই সাংবিধানিক পরিষদে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং রক্ষণশীল সালাফি আল নুর পার্টির যে দাপট, তাতে দেশটির উদারনীতিক, ধর্মনিরপেক্ষমনা নাগরিক এবং নারী অধিকার নিয়ে প্রচারণকারীরা রীতিমতো ভয়ের মধ্যে পড়ে গেছেন। তাদের আশঙ্কা, নতুন সংবিধানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে না। মিশরের এই প্রস্তাবিত সংবিধান নিয়ে মিশরে এবং মিশরের বাইরে জল্পনা-কল্পনা চলছে। গণতন্ত্রকর্মীরা এই সংবিধানের পাঁচটি ইতিবাচক এবং পাঁচটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন।

প্রথমেই দেখে নেয়া যাক, প্রস্তাবিত এই সংবিধানের ভালো দিকগুলো কী কী।



সামরিক আদালতের বিলোপ :
খসড়া সংবিধানে বেসামরিক লোকদের জন্যে সামরিক বিচারের বিধানকেই কেবল লোপ করা হয়নি বরং নাগরিকদের বিচারে বিশেষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আদালতকেও বাতিল করা হয়েছে। মিশরে জেনারেলদের শাসনের কুখ্যাত এক বৈশিষ্ট্য ছিল এই সামরিক আদালত। ১২ হাজারেরও বেশি বেসামরিক লোককে এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। এছাড়াও হোসনি মোবারকের শাসনামলে বিশেষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আদালত গঠন করা হয়, যেখানে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে গিয়ে নিরপরাধ মানুষকে ইচ্ছামতো সাজা দেয়া হতো। যেহেতু, মুসলিম ব্রাদারহুডের হাজার হাজার নেতাকর্মী এসব সামরিক আদালতের নিষ্পেষণের শিকার, সে কারণে বিপ্লবের শুরু থেকেই তারা এই আদালত বিলোপের পক্ষে সোচ্চার ছিল।

মুক্ত মতপ্রকাশ : ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নে ইসলামপন্থী সালাফিদের অব্যাহত চাপ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম ব্রাদারহুড খসড়া সংবিধানে অবাধ ও মুক্ত মতপ্রকাশের ব্যাপারে দৃঢ় ভাষায় নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বক্তব্য, ছবি অথবা যেকোনো প্রকাশনা বা প্রকাশভঙ্গির মধ্যদিয়ে যেকোনো নাগরিক তার চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতে পারবেন।’

প্রতিবাদের অধিকার: ধর্মঘটের মতো প্রতিবাদ এখন মিসরের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। খসড়া সংবিধানে প্রতিবাদের এই মাধ্যমকে পুরোপুরি বৈধতা দেয়া হয়েছে। মোবারকের শাসনামলে পাঁচজনের বেশি লোকের একত্র জমায়েতকে ‘নিরাপত্তার জন্যে হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য সাজার বিধানও ছিল। বর্তমান সংবিধানে নাগরিকদের জমায়েত হবার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে- যা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক।

প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ: আগের সংবিধানে একজন ব্যক্তি যতবার ইচ্ছা ততবার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। এতে করে স্বৈরশাসন মাথাচাড়া দেয়ার ব্যাপক সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু নতুন সংবিধানের বিধান অনুসারে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন।

সুশীল সমাজ: সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন সংবিধানের অধীনে কাজ করার জন্য তুলনামূলক অনুকূল পরিবেশ পাবে। হোসনি মোবারকের আমলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর কণ্ঠ রোধ করে রাখা হয়েছিল। নিবন্ধন পেতে তাদের কঠিন সব শর্ত পূরণ করতে হতো এবং সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর জন্য সবসময় নিজেদের দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হত। বর্তমান সংবিধানের অধীনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আদালত ছাড়া অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

এবারে সংবিধানের নেতিবাচক পাঁচটি দিকের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক।

নির্যাতন: মোবারকবিরোধী আন্দোলনের মূলে ছিল পুলিশি ক্ষমতার ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনরোষ। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল মিসরের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলো। কিন্তু নতুন সংবিধানে পুলিশের এই আচরণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য বিধান রাখা হয়নি; যা মানবাধিকার সংগঠনগুলো আশাহত করেছে। সংবিধানের ৫ম অনুচ্ছেদে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিকারক তুলনামূলক কম মাধ্যমগুলোকে নিষেধ করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এর ফলে পুলিশকে তার ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ থাকছে না।

ধর্মের স্বাধীনতা: নতুন সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতা কিছুটা হুমকির মুখে পড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। ৮ম অনুচ্ছেদে কেবল ইসলাম, খ্রিস্টান এবং জুদাইজমকে মূল ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা চর্চা এবং ধর্মীয় স্থাপনা গড়বার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশটিতে বাহাই ধর্মাবলম্বী কয়েক হাজার মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস চর্চার ক্ষেত্রে এই সংবিধান সমস্যা তৈরি করতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যাও দিয়েছে।

নারী স্বাধীনতা: নারী অধিকারের বিষয়টি মিসরের সংবিধানের সবচেয়ে বিতর্কিত ইস্যু। অভিযোগ করা হচ্ছে, ইসলামপন্থীরা নারীদের ওপর তাদের অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করতে চাইছে। আগের সংবিধানের মতো এখানেও বলা হচ্ছে যে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে ঠিক ততটাই পুরুষের সমান করে নিশ্চিত করা হবে, যতটা করলে ইসলামী শরিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে না। আবদেল ফাত্তাহ নামের সাংবিধানিক পরিষদের একজন সদস্য বলেন, এই বিধানকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এর অর্থ কি এই যে, নারীরা একাকি ভ্রমণ করতে পারবে না কিংবা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবে না? পরিষদে কট্টরপন্থী সালাফিদের উপস্থিতি নারী অধিকারের বিষয়টিকে আরো সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।



মানব পাচার:
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নতুন সংবিধানে নারী ও শিশু পাচার রোধে যথাযথ আইনি সুরক্ষা রক্ষা হয়নি। আগের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে নারী ও শিশু পাচারকে নিষিদ্ধ করে শক্ত বিধান রাখা হলেও নতুন খসড়া সংবিধানের তাদের অধিকার লঙ্ঘনকে স্রেফ নিষিদ্ধ করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে, সালাফিরা চায় না যে, সংবিধানে নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টি এভাবে স্পষ্ট ভাষায় থাকুক। কারণ, তাদের মতে, এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের ফলে মিসরের কলুষিত চিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

শরিয়া আইন: মিসর কি ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, নাকি এটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হচ্ছে? গত বছরের বিপ্লবের পর থেকে এ নিয়ে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা চলছে। সালাফিরা চাইছে, মিসরের আইনের একমাত্র উৎস হবে শরিয়া আইন। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত একটি বিধান এখন মিসরকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। আলোচিত সেই অনুচ্ছেদে মিসরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে একমাত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে শরিয়া আইন ব্যাখ্যার ক্ষমতা প্রদান করেছে। সকল আইনকে শরিয়ার অনুগামী করার দায়িত্বও তাদের। এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, অনির্বাচিত এবং বিচারিক আওতাবহির্ভূত একটি প্রতিষ্ঠানকে এভাবে ক্ষমতা দেয়াটা অগ্রহণযোগ্য। মুসলিম ব্রাদারহুড বলছে, সকল আইন এমনকি আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকেও শরিয়ার মানে উন্নীত হতে হবে।

গ্লোবাল পোস্ট ডট কম অবলম্বনে। দৈনিক যায়যায়দিনে গত ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১০৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File