রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকের অপব্যবহার ও আইন

লিখেছেন লিখেছেন মারুফ আল্লাম ২৮ মে, ২০১৩, ০৩:০৯:৪৫ দুপুর



যুদ্ধ চলাকালে যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়, তা প্রশমনে ১৮৬৩ সালে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব স্যার হেনরি ডুনান্টের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা হয় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস (আইসিআরসি)। যুদ্ধের সময় কিংবা দুর্যোগে অসহায় মানুষের প্রতি মানবিক সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে আক্রান্ত মানুষের সুরক্ষা দিতে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের বিকাশ ও প্রয়োগে ভূমিকা রেখে চলেছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক এ আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য সংস্থাটি।

রেড ক্রস নামক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে প্রারম্ভিক পর্যায়ে থেকে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের সবাই সুইজারল্যান্ডের নাগরিক এবং প্রথম থেকেই এ আন্দোলনের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে যুক্ত। এ কারণেই এ মহৎ প্রচেষ্টার উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি হিসেবে যুদ্ধে হতাহত মানুষের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থার প্রতীক ও পতাকা নির্বাচনে সুইজারল্যান্ডের জাতীয় পতাকাকে বিবেচনায় নেয়া হয়।

রক্ত রাঙা জমিনে সাদা ক্রসযুক্ত সুইস পতাকার জায়গায় সাদা জমিনে লাল ক্রসকে প্রতিষ্ঠানটির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠালগ্নে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৮৭৬ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে তুরস্কের উসমানী শাসকরা রেড ক্রস প্রতীকের ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে ঘোষণা করেন, তারা রেড ক্রসের পরিবর্তে রেড ক্রিসেন্ট (লাল রঙের প্রথমা চাঁদ) ব্যবহার করবেন। পরে ইরানও রেড লায়ন-সান প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯২৯ ও ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে মূল রেড ক্রস প্রতীকের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট এবং রেড সান-লায়নকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়।

এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর ১৯৮০ সালে দেশটি তার আগের রেড লায়ন-সান প্রতীক ত্যাগ করে রেড ক্রিসেন্ট প্রতীক ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নেয়। এ কারণে বর্তমানে রেড লায়ন-সান প্রতীকটি কেবলই আইসিআরসির দাপ্তরিক প্রতীক হিসেবেই সীমাবদ্ধ। এর কোনো ব্যবহার নেই। এদিকে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ‘রেড শিল্ড অব ডেভিড’ প্রতীক ব্যবহার করে আসছে। ২০০৫ সালে এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ইসরাইলের ওই প্রতীককে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি ‘রেড ক্রিস্টাল’কে একটি নতুন অভিন্ন নিরপেক্ষ প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে ১৫১টি দেশ রেড ক্রস এবং বাংলাদেশসহ ৩২টি মুসলিম দেশে রেড ক্রিসেন্ট প্রতীক ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রতীকের অপব্যবহার নিষিদ্ধ : ১৯৪৯ সালে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনসংক্রান্ত ৪টি জেনেভা কনভেনশন প্রণয়নের পর ১৯৭৭ সালে দুটি অতিরিক্ত প্রটোকল নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। প্রথম প্রটোকলের ৩৮ অনুচ্ছেদে এবং দ্বিতীয় প্রটোকলের ১২ অনুচ্ছেদে রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট এবং রেড লায়ন-সানের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সংস্থা ছাড়া অন্য কেউ এসব প্রতীক ব্যবহার করলে এসব প্রতীকের অপব্যবহার সংঘটিত হতে পারে।

কারা এসব প্রতীক ব্যবহার করতে পারে : রেড ক্রস কিংবা রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকগুলো যে কেউই ব্যবহার করতে পারে না। যুদ্ধ চলাকালে এ প্রতীকগুলো সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এসব প্রতীক সংবলিত কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর হামলা চালানো জেনেভা কনভেনশন অনুসারে নিষিদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধও বটে।

দ্বিতীয় প্রটোকলের ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে, যুদ্ধ চলাকালে রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও সংস্থা ছাড়াও এসব প্রতীক সেনাবাহিনীর চিকিৎসা কাজের সঙ্গে জড়িত সদস্যদের পোশাক ও সরঞ্জামের ওপর ব্যবহার করা যাবে। ধর্মীয় কর্মচারী যেমন ধর্মীয় শিক্ষকরাও এ প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন। যুদ্ধে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের ওপর এবং যারা তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন তারা এ প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন।

যুদ্ধ ছাড়া শান্তিপূর্ণ সময়ে এসব প্রতীক ব্যবহারের আওতা বেশ কমে আসে। এ সময় কেবল আন্তর্জাতিক রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কোনো সংগঠন এবং এসব সংগঠনের কাজে জড়িত ব্যক্তি ও সরঞ্জামের ওপর এ প্রতীক ব্যবহার করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলন বলতে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস (আইসিআরসি), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অর রেড ক্রিসেন্ট সোশ্যাইটিজ (আইএফআরসি) এবং ১৮৮টি দেশে তৎপর ন্যাশনাল রেড ক্রস অথবা রেড ক্রস সোশ্যাইটিগুলোকে বোঝাবে। শান্তিপূর্ণ সময়ে ন্যাশনাল রেড ক্রস অথবা রেড ক্রিসেন্ট সোশ্যাইটির অনুমতিক্রমে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে আহত ও অসুস্থদের সেবা দিলে রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট প্রতীক ব্যবহার করতে পারে।

যেভাবে প্রতীকের অপব্যবহার হচ্ছে : আইসিআরসির অনুমোদন ছাড়াই পৃথিবীর দেশে দেশে রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে। ইচ্ছামতো যে কেউই ব্যবহার করছেন এসব প্রতীক। বিশেষত স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং ওষুধসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকের যত্রতত্র ব্যবহার চলছে। মনে রাখতে হবে, এসব প্রতীক কোনো লোগো কিংবা ট্রেডমার্ক নয়। যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে এসব প্রতীকের সুরক্ষা দেয়ার মূল্যমান কমে আসবে।

বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকের অপব্যবহার : বিশ্বের যেসব দেশে আইসিআরসির প্রতীকগুলোর নির্বিচার ব্যবহার হচ্ছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। এখানকার হাসপাতাল, চিকিৎসকদের চেম্বার, গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে অহরহ ব্যবহার হচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট প্রতীক। অথচ তাদের ব্যবহার করা উচিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ কর্তৃক অনুমোদিত বিভিন্ন প্রতীক। আগেই বলা হয়েছে, যুদ্ধ ছাড়া শান্তিপূর্ণ সময়ে এসব প্রতীকের ব্যবহার করতে পারে কেবলই আইসিআরসি এবং এর কোনো অঙ্গ সংগঠন। অন্য কেউ এসব প্রতীক ব্যবহার করলে সেটি আন্তর্জাতিক ও দেশি উভয় আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বাংলাদেশের আইনে রেড ক্রিসেন্ট প্রতীক ব্যবহারের সাজা : ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত হয় জেনেভা কনভেনশন বাস্তবায়ন আইন। ১৯৭৪ সালে এই আইনে সংশোধনী আনা হয়। আইনের ২ ও ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, আইসিআরসির অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট বা রেড লায়ন-সান প্রতীকগুলো হুবহু বা সামান্য পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে পারবে না। ৪ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি এ অপরাধ সংঘটন করলে ৫০ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং কোনো সংস্থা বা কোম্পানি করলে ওই সংস্থা বা কোম্পানির প্রত্যেক সদস্যকে পৃথক পৃথকভাবে ৫০ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থদণ্ডের পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল। এটিকে সংশোধন করা তাই সময়ের দাবি। তবে দণ্ড যাই হোক, রেড ক্রিসেন্ট বা রেড ক্রস প্রতীক ব্যবহার করা যে আইনত অবৈধ ও নীতিগর্হিত, সেটি সবার মনে রাখতে হবে।

সুপারিশ : ১৯৩৬ সালের আইনটি প্রণীত হয়েছিল ১৯২৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের ২৮ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের উদ্দেশে। ১৯৪৯ সালে নতুন করে চারটি জেনেভা কনভেনশন সম্পাদিত হওয়ায় ১৯২৯ সালের কনভেনশন এখন কার্যত অচল। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে ১৯৭২ সালে। এ কনভেনশন অনুসারে সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের দেশে অভ্যন্তরীণ আইন প্রণয়নে বাধ্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের তরফে ১৯৪৯ সালের আইন বাস্তবায়নে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উচিত অতিদ্রুত ১৯৩৬ সালের আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করা যাতে ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে উদ্ভাবিত আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের নীতিগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

বিষয়: বিবিধ

১২০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File