ইসলামী আন্দোলনে তুরস্কের সম্ভাবনাঃ বাংলাদেশের ট্রাইবুনাল পরিদর্শনের প্রেক্ষিত
লিখেছেন লিখেছেন অভিযাত্রিক ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২, ০২:৩৮:৩৭ রাত
ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ায় মাষ্টার্সে পড়ার সময় আমি বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের ভাইদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। এর আগে অন্যদেশেও অসংখ্য দেশের ছাত্রদের সাথে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ক্যাম্পাসে পড়ার ও থাকার সুযোগ আল্লাহ দিয়েছিলেন, কিন্তু সে ছিলো কঠোর নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। ছাত্ররা যেন পড়ালেখা ছাড়া রাজনীতি অথবা অন্য কোন কিছু নিয়েই না ভাবে, পরিবেশটা গড়ে তোলা হয়েছিলো ওভাবে। মালয়েশিয়াতে এসে দেখলাম বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবছে, কথা বলছে, আলোচনা করছে। অবশ্য এর কিছু নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও যে ছিলোনা তা না, কখনো কখনো খবর শোনা গেছে অমুক গ্রুপকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসবাদীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে।
----
যাহোক, সেসময় বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের খবরাখবর, অগ্রগতি, সমস্যা, প্রকৃতি এসব জানার পাশাপাশি অবচেতন মনে একধরণের তুলনামুলক চিন্তার জন্ম নেয়। অগ্রজ সতীর্থ তাজুল ভাই এর সাথে এ নিয়ে অনেক কথা হতো। কথা হতো আরো অনেকের সাথে। এ সময় তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রতি অনেকের বিশেষ আগ্রহ দেখে আমারও কৌতুহল জন্মায়। এরপর থেকে তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের ভাইদেরকে যেখানে পেয়েছি পরিচিত হয়েছি, কথা বলেছি। দীর্ঘদিনের সেকুলার দমন নিপীড়ন তাদেরকে ধৈর্য্যসহিষ্ণু করেছে, ইউরোপের সান্নিধ্য তাদেরকে আধুনিক মনস্ক এবং বুদ্ধিমান করেছে, কয়েক শতাব্দীর খেলাফতের ঐতিহ্য তাদেরকে আভিজাত্য দিয়েছে। অনেকে মনে করেন শুধুমাত্র সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তুর্কী ইসলামী আন্দোলনের সফলতার কারণ। কিন্তু আমার মতে এটি আংশিক চিন্তা, বরং জ্ঞান ও চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাদের উন্নতি কম না। নুরসী মুভমেন্টের দারাসানেগুলোতে গেলে এবং অনেক টার্কিশ ভাইদের নফল রোযা ও সালাতের চর্চা দেখলে অনুপ্রাণিত হতে হয়।
----
[আবদুল্লাহ দাভোতুগলু]
----
তুরস্কের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ দাভোতুগলু (দাউদ-উগলু) আইআইইউএম এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন বহু বছর আগে। আমি ওখানে থাকা অবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাভোতুগলু মালয়েশিয়া সফরে এসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। প্রফেসর আবদুল্লাহ আহসান স্যারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি, সেই বন্ধুর সভাপতিত্বে রেক্টর বিল্ডিং এর চারতলার অডিটরিয়ামে তিনি কিছু কথা বলেছিলেন। তাকে দেখেই প্রথমে মনে পড়েছিলো চাচা চৌধুরীর কথা, ঠোটের উপর গোঁফ আর হাসি হাসি চোখ, কেবল পাগড়িটা নেই! মনে হলো এতো সাধারণ একটা মানুষ কিভাবে এতো বিরাট ব্যাক্তিত্ব হতে পারে! কিন্তু কথা বলা শুরু করার পর বুঝা গেলো কিভাবে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তুরস্কের মতো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে যান। পরবর্তীতে অন্যদেশেও তুরস্কের আরো বেশ কয়েকজনকে দেখেছি এমন যোগ্য, অথচ বাড়াবাড়ি কিংবা কৃত্রিমতার ভার নেই।
----
বিশাল অডিটরিয়াম উপচে পড়েছিলো এবং তাঁর একঘন্টার বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলো সেদিন সবাই। কোন ফাপা বুলি অথবা গৎবাঁধা কথা ছিলো না। বরং সাধারণ কিন্তু জ্ঞানী একজন মানুষের মতো বাস্তবতানির্ভর স্বপ্নের কথা। তার সাথে তুর্কী দূতাবাস থেকে যে কর্মকর্তারা আর সিকিউরিটি পারসোনেলরা এসেছিলো তাদের মাঝে এমনকি আটোসাঁটো স্কার্ট পরা মেয়েরাও ছিলো, কিন্তু স্যুট টাই পরা দাভোতুগলু ছিলেন আপন ব্যাক্তিত্বের কারণে সবার মাঝে অনন্য। কথাবার্তা ও আচরণে ইসলামিক। সেদিন দেখেছিলাম ইসলামের জন্য কাজ করতে হলে দাড়ি আর লম্বা জামা উত্তম হলেও অত্যাবশ্যক শর্ত না। বরং জ্ঞান, আচরণ ও মানসিকতা একজন মানুষের ইসলামিক ওরিয়েন্টেশনকে এরচেয়েও বেশি ঋজুভাবে প্রকাশ করতে পারে।
----
বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে ট্রাইবুনাল চলছে, তা নিয়ে দেশে বিদেশে প্রচুর তর্ক বিতর্ক, উগ্র সমর্থন কিংবা বিরোধিতা, এবং আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের দলীয় সরকারও পরিস্কারভাবে আতংকিত ও উগ্রভাবে রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থা উসকে দিয়েছে দেশে ও বিদেশে সাধারণ মানুষের মাঝে একধরণের মাস হিষ্টিরিয়া। কোন যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই দেখি দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে পারিবারিক দাওয়াত খেতে এসে দুই বাংলাদেশী গলা ছেড়ে বিশ্রী ও অসম্মানজনকভাবে বিতর্ক করছেন। আর পত্রিকায় যা পড়ি তা থেকে পরিস্কার বুঝা যায়, দেশে এখন এ নিয়ে '‘সমালোচনা'’র '‘দন্তস্য’' অক্ষর উচ্চারণ করাও 'বিচার ‘বানচাল করার ষড়যন্ত্র'’র অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
----
[ট্রাইবুনাল পরিদর্শনে টার্কিশ ডেলিগেশন]
----
এ ফ্যাসিবাদী অবস্থার ভেতরেও তুরস্কের চৌদ্দ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে তদন্ত করে গিয়েছেন। এ সফলতা এবং দক্ষতা শুধুমাত্র '‘আবেগকম্পিত ঈমানদীপ্ত মুজাহিদ ঈমান'’ দিয়ে সম্ভব না। বরং আন্তর্জাতিক কুটনীতি, রাজনীতি এবং একাডেমিয়া এসবদিকে দক্ষ হলেই এমন করা সম্ভব। এ প্রতিনিধি দল ট্রাইবুনালও পরিদর্শন করেছে, এমনকি সরকারের আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ট্রাইবুনালে স্বাক্ষ্য দেয়া আইন শালিস কেন্দ্রের সুলতানা কামাল এবং চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর মতো কী প্লেয়ারদের সাথেও মিটিং করেছে। এর কারণ একটাই, যোগ্যতা। তুরস্কের এরা ইংলিশে দক্ষ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে সম্যক অবগত, ন্যাটো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে নেগোশিয়েশনে অভ্যস্ত। এরা আরব শায়খদের মতো কৌতুহলী হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকে না, যাদেরকে অনুবাদ ও যোগাযোগের জন্য এদেশীয় দরিদ্র নতজানু আলেমদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। কোন সিদ্ধান্তের আগে ইউরোপীয় উপদেষ্টাদের সাথে কথা বলতে হয় (কোন অসম্মান প্রকাশ করছি না, বাস্তবতা)।
----
তুরস্কের প্রতিনিধিদল দু’'পক্ষের সাথে বসেছেন, কথা বলেছেন। একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য যেটা মূলশর্ত তা তারা সাফল্যের সাথে করে ফেলেছেন। এর ফলে এখন বাংলাদেশের মিডিয়ায় বিক্রিত এবং বিকৃত সাংবাদিক বুদ্ধিজীবিদের আফসোসের সীমা নেই। তারা একে আখ্যা দিতে চাচ্ছেন গোপন বৈঠক হিসেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের কাছে আপত্তি জানিয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণি সম্ভবত এটা বুঝার সাধ্য রাখেন না যে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েল ও আমেরিকার মতো দেশের সাথে কুটনৈতিক সমস্যা ডিল করে এখন পর্যন্ত পৃথিবীকে অবাক করে রেখেছে, সুতরাং দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া মানুষদের মন্ত্রণালয়টা বুদ্ধির ক্রীড়ায় ওদের কাছে দুধভাত শিশুর মতো।
----
দাভোতুগলো সেদিন বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'তুরস্ক নিজেদেরকে শত বছরের ওসমানী খেলাফতের উত্তরাধিকার মনে করে। সুতরাং বিশ্বশান্তি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যদি ঐ উত্তরাধিকারের ঐতিহ্য কোন অবদান রাখতে পারে, তার কার্যকর ব্যাবহার করতে তাদের সরকার অনিচ্ছুক না'।
----
তুরস্কের আন্তর্জাতিক সচেতনতার প্রকাশ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্নভাবে সারা পৃথিবী দেখেছে। পৃথিবীর যেখানেই হোক, মুসলিম স্বার্থে সামনে এগিয়ে আসতে, সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়তে টার্কিশরা এখন সংকোচ করেনা। ফিলিস্তিনের জন্য সাহায্যবাহী ফ্লোটিলা পাঠানোর আয়োজন করার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে টার্কিশরা। আফগানিস্তান ও ইরাকে তুরস্ক কার্যকর ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। মাথাগরম উগ্রপন্থী বেশিরভাগ মুসলিমদের মতো শুধু প্রতিবাদ আর ধ্বংসের আহবানে না গিয়ে তুরস্ক গঠনমূলক ও সম্ভবপর কাজ করে যাচ্ছে। এবং এ পর্যন্ত তারা সফল। তুরস্কের এ সফলতার কাছাকাছি আসতে পারে অসংখ্য সব উস্কানী ও প্রতিকূলতার পরও টিকে থাকা ফিলিস্তিনের হামাস এবং মিশরের ইখওয়ানের আন্দোলন। আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পরের বৈশ্বিক ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি বুদ্ধিবৃত্তিক ও চরিত্রগত যোগ্যতার কারণে তুরস্ক হাতে তুলে নেয়, তাতে অতীতের মানুষ হিসেবে আমি আশ্চর্য হবো না।
----
----
[ছবিটা সুন্দর, কৃতজ্ঞতা অজানা ডিজাইনারের প্রতি]
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন