কবিদের মৃত্যুঃ ফররুখ, মল্লিক এবং গোলাম মোহাম্মদ
লিখেছেন লিখেছেন অভিযাত্রিক ০৮ জানুয়ারি, ২০১৩, ০২:০৪:২৩ রাত
এক দেড় বছর পরপর যখন ছুটিতে দেশে ফিরি, প্রথম কয়েকদিন কিছুটা আলস্য থাকে শরীর-মন জুড়ে। বাসায় শুয়ে বসে দিন কাটাই আর আম্মার হাতের রান্না খাই। এ কয়দিনে আম্মার পড়ার টেবিল আর বই এর তাকগুলোতে ঘাটাঘাটি করে কিছু বই পড়ার চেষ্টা করি। প্রতি বছর বেশ কয়েকটা স্মারকগ্রন্থ পড়ার জন্য পেয়ে যাই এসময়, যারা মারা গিয়েছেন তাদের স্মৃতি নিয়ে প্রকাশিত বই।
এবছর যে স্মারক বইগুলো পড়েছিলাম তার মাঝে এখন মনে পড়ছে কবি গোলাম মোহাম্মদ, পীর সুজামিয়া এবং ফটিকছড়ির জামায়াত নেতা নজরুল ইসলামের স্মৃতি বইগুলোর কথা। আমার কবিতা পড়ার অভ্যাস খুবই কম, জানতামই না যে গোলাম মোহাম্মদ এতো বড়মাপের একজন কবি ছিলেন। আমার জানা ছিলো না, সাইফুল্লাহ মানছুরের গাওয়া এতো সুন্দর একটা গান '“হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি/ যতই তারে করুণ কেঁদে ডাকি/ দেয়না সাড়া নীরব গহীন বন/ বাতাসে তার ব্যাথার গুঞ্জরণ' আসলে লিখেছিলেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। আরেকটা প্রিয় গান '“সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে/ আমাকে রাখিও রহমান'” এটাও ছিলো তাঁর লেখা। এধরণের অনেক চমৎকার ও কালজয়ী ইসলামী গানের লিরিক্স লিখেছিলেন এই কৃতী কবি।
কবির স্মারক বইটাতে পড়েছিলাম তিনি অর্থ উপার্জনের জন্য, পরিবারের ব্যয় মেটানোর জন্য বিভিন্ন চেষ্টা করেছেন, ব্যাবসার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে অনেকটা অর্থকষ্টের ভেতর এবং অপ্রতুল চিকিৎসার মাঝেই তিনি মারা যান। কবি গোলাম মোহাম্মদের মৃত্যুর এ ঘটনা পড়ে মনে পড়লো আরো দুইজন কবির কথা। এদের ভেতর কবি মতিউর রহমান মল্লিককে দেখেছি। আর কবি ফররুখ আহমেদ আমার জন্মেরও আগে মারা গিয়েছেন, তাঁর কথা বই পড়ে জেনেছি।
প্রতিটা মানুষেরই চিন্তাশক্তি আছে। সবাই কিছু না কিছু ভাবে এবং বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। কিন্তু সব মানুষের মাঝে সাহিত্যিক, এবং বিশেষ করে যথার্থ কবিদেরকে আমার কাছে অপার্থিব মানুষ মনে হয়। এদেরকে স্রষ্টা ব্যাতিক্রমভাবে ভাবনার এবং অলৌকিকভাবে ভাবনা প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছেন। আমরা সবাই ই তো ভাষা ব্যবহার করি দৈনন্দিক কথাবার্তায়, লেখায়। কিন্তু পরিচিত শব্দগুলোকে অপরিচিতভাবে জুড়ে দিয়ে ভিন্নমাত্রায় প্রকাশের ক্ষমতা যাদের আছে, তাদেরকে শ্রদ্ধা করতেই হয় বৈকি। এই চিন্তার ক্ষমতা সম্ভবত তাদেরকে কিছুটা বাস্তবতাবিমুখ, কিছুটা অপরিচিত করে তুলে। ইসলামী আন্দোলনের ভাইদের মাঝে তাই দেখা যায়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত মানুষদেরকে অনেক সময় ব্যতিক্রম অথবা কখনো অস্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিতে, এমনকি কখনো অবমূল্যয়ণও করতে।
কবি মল্লিক মারা যাওয়ার কয়েকসপ্তাহ আগে দেশে ফিরেছিলাম ভার্সিটি বন্ধের ছুটিতে। হাসপাতালের রুমে দেখা করতে গিয়ে যখন পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি আপনার সাথে দেখা করে দোয়া নিতে এসেছি। তিনি অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। কেবিনে উপস্থিত মানুষদের প্রবল অনুরোধ উপেক্ষা করে অনেক কষ্ট করে উঠে বসেছিলেন এবং বলেছিলেন “'তোমার বাবা-মার বিয়েতে একাশি সালে আমি গান গেয়েছিলাম। আজ তাদের সন্তানকে চোখের সামনে জলজ্যান্ত একজন মানুষ হিসেবে দেখার আনন্দ অনেক'”! তিনি নিজে নিজেই অনেক কথা বলছিলেন, বলতে বলতে এক সময় বললেন '“জীবন বড় বৈচিত্র্যময়। একসময় আমরা যারা এক ছেড়া কাঁথার নিচে ঘুমিয়ে শীত পার করতাম, তাদের কেউ পাঁচতারা হোটেলে থাকে আর কেউ টাকার জন্য চিকিৎসা করতে পারেনা”'। সেদিন তাঁর এ কথা শুনে আমার এতো খারাপ লেগেছিলো, ভাগ্যবিধাতার উপর কিছুটা অভিমান হচ্ছিলো।
[ফররুখ আহমেদ]
এদের তিনজনের মাঝে সেরা কবি ফররুখের পরিণতিও একই। বরং, ফররুখ তো শেষ পর্যন্ত অনাহারে দিন কাটাতেন। টাকা ও চিকিৎসার অভাবে তাঁর সন্তানও মারা গিয়েছিলো।
ফররুখের লেখা কয়েকটা লাইন কৈশোরে আমার খুব প্রিয় ছিলো কোন কারণ ছাড়াই, লিখে পড়ার টেবিলের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম কিছুদিন।
কিছু লেখা হলো, আর অলিখিত রয়ে গেলো ঢের
কিছু বলা হলো, আর হয়নি অনেক কিছু বলা
অনেক দিগন্তে আজও হয় নাই শুরু পথ চলা
কে জানে সকল কথা, কে পেয়েছে সংজ্ঞা সময়ের?
শুধু নিমেষের রঙে এই সব গান মুহুর্তের
অতলান্ত দরিয়ার এসব বুদবুদ গোত্রহীন
কখনো উঠেছে কেঁদে, কখনো বা হয়েছে রঙীন
দু’দন্ড খেলার ছলে স্পর্শ নিতে পূর্ণ জীবনের।
আগেই বলেছি কবিতা পড়ার অভ্যাস আমার খুবই কম। তবু মাঝে মাঝে কিছু বাক্য চোখের সামনে এসে আটকে যায়। তারপর বাক্যগুলো মনকে এমনভাবে টেনে ধরে যে, আরো কয়েকবার পড়ে বুঝার চেষ্টা করতে হয়। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এর ভেতরে রোমান্টিক কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে বেশি। যখন আরবী ভাষার ছাত্র ছিলাম তখনও আনতারা বিন শাদ্দাদের যুদ্ধ উম্মাদনা আর বীরত্বের কবিতার চেয়ে বরং ইমরাউল কায়েসের গাযাল কবিতা পড়তে আমার কাছে বেশি ভালো লাগতো। এ কবিতা পড়ার সাথে চিরন্তন ধর্মীয় নৈতিকতা বোধের মৃদু সংঘর্ষের অনুভূতিও কিছুটা উপভোগ্য, মজার। ফররুখ এমন কিছু রোমান্টিক কবিতা লিখেছেন, ভাবতে অবাক লাগে এতো ভালোবাসা ভরা মন কয়জন মানুষের থাকতে পারে!
ষোল পাঁপড়িতে ঘেরা ষোড়শীর সে পূর্ণ যৌবনে
আসিলো অতিথি এক বন্দরের শ্রান্ত মুসাফির!
সূর্যাস্তের অগ্নিবর্ণ সেহেলির বিমুগ্ধ স্বপনে,
নিভৃত ইঙ্গিত তার ডেকে নেয় পুস্পিত গহনে,
অনেক সমুদ্রতীরে স্বপ্নময় হ’ল এ শিশির
তারার সোনালী ফুল ছিটে পড়ে রাত্রির অঙ্গনে।
কবি গোলাম মোহাম্মদ সম্পর্কে জানতে গিয়ে আহমদ বাসিরের এক লেখায় তাঁর একটা কবিতা পেলাম। কবিতাটা পড়ে কষ্টটা আরো বেড়ে গেলো, এমন মন যে মানুষের, তাকে অর্থাভাবে চিকিৎসার অভাবে মরে যেতে হয়। এটা মেনে নেয়ার মতো না।
সে কেমন ছিলো প্রথম সূর্যোদয়
প্রথম মানব -মানবীর পরিচয়
প্রথম বাতাস শুনাল কিসের গান
পাখির কণ্ঠে কিসের খুশির বান।
কেমন সে ছিলো প্রথম আনারফুল
প্রথম পোষাক কুঞ্চিত কালোচুল
বন-মর্মর নদীর নতুন কূল
ধূ-ধূ প্রান্তর ঘরহীন সঙ্কুল
পুরোটা পৃথিবী দু’জন মানুষ মোটে
কি কথা প্রথম বেজে উঠেছিলো ঠোঁটে
কেমন কেটেছে ফুলেল প্রথম দিন
কি খাবার খেয়ে কিংবা খাবারহীন।
ছিলো কি চন্দ্র আসমানে সারারাত
রজনীগন্ধ ছিলো কি বাগান ভরে
রাতজাগা পাখি কোন গান করেছিলো
সারারাত জেগে অনুনয় করে করে।
কবি মল্লিকের কথায় অবশ্য রোমান্টিক চিন্তার বদলে অসংখ্য প্রিয় গানের কথাই মনে পড়ে। যে মেধা আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন, সব ভালোবাসা আর অনুভূতি ঢেলে দিয়ে তিনি লিখেছিলেন '“এ বুক ভাঙতে চাও ভাঙতে পারো/ অনুরোধ শুধু এই ঘর ভেঙোনা”... অনেক স্বপ্ন নিয়ে গড়া এই মসজিদ/ মুক্তির শেষ ঠিকানা'। মল্লিকের পক্ষেই বলা সম্ভব “'অর্থ বিত্ত নাইবা থাকলো তার/ নাইবা থাকলো সাজানো সম্ভার/ তবুও সে হয়না হতাশ/ মুষড়ে পড়েনা/ একজন মুজাহিদ কখনো বসে থাকেনা'”।
কবি মল্লিকের লেখা প্রিয় গানগুলোর উল্লেখ করতে থাকলে মনে হয় তা কয়েকদিন লিখেও শেষ করা যাবেনা। এটা শুধু আমার কথা না, আমার বিশ্বাস আমাদের মতো যাদের শৈশব ও কৈশোরে ইসলামী গানগুলো চেয়ে না চেয়ে কানের কাছে শুনতে পেতাম, তাদের জীবনের বহু স্মৃতিতে জড়িত হয়ে আছে তাঁর লেখা অসংখ্য গান। তবু দেখা যায় কবির প্রকৃতি তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি, সরল কথায় লিখেছেনঃ
বৈধ নারীর মতো
আর কোন নারী নেই
সুরসঞ্চারী নেই
গান-জারী-সারী নেই
মধু মহামারী নেই
বৈধ নারী-ই চির শিল্পকলা
কবিতার মতো মীড়; নীড় চঞ্চলা।
এভাবে চিন্তা করার, লেখার মতো মেধা ছিলো যাদের, দু:খ হয় আর মনে হয় এদের আরো অনেক কিছু দেয়ার ছিলো। কিন্তু মেধার সাথে সাথে সম্ভবত কিছুটা অহং ও কিছুটা বৈরাগ্যও যোগ হয়ে থাকে। এদের মৃত্যুগুলো এভাবে অর্থকষ্টে না হওয়ারই কথা ছিলো, যদি তারা কিছুটা বিষয়সচেতন হতেন। আর এ কবিদের লেখা থেকে উপকৃত হয়েছে যে চিন্তা, ঐ চিন্তার মানুষদের মাঝে বিষয়ী ধনীর সংখ্যা কম না। জানিনা এরা কবিদের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারবেন কি না। সৃষ্টিশীলতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো মানসিক ঔদার্য্য না থাকলে ঐ সৃষ্টিশীলতা থেকে উপকৃত হওয়ার মতো নির্লজ্জ বিষয় আর হয়না।
কবি ফররুখ আহমেদ ১৯১৮-১৯৭৪
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৫৬ (উইকিপিডিয়াতে ১৯৫০) -২০১০
কবি গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৯-২০০২
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
- কবি গোলাম মোহাম্মদ স্মারক গ্রন্থ
- মাফরুহা চৌধুরীর লেখা বই “"সঙ্গ প্রসঙ্গ"”
- আহমদ বাসিরের লেখা “গোলাম মোহাম্মদঃ পবিত্রতার কবি”
- সামহোয়ারইনে কবি মল্লিকের নামে নেয়া নিক, যদিও ঐ অমানুষদের দঙ্গলে এ নিকনেম নেয়া উচিত না।
- - ইব্রাহিম মন্ডলের লেখা কবি গোলাম মোহাম্মদঃ কিছু কথা কিছু স্মৃতি।
বিষয়: বিবিধ
২৮৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন