অসৎ মানুষের দেশে ভোক্তা অভিজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট সেবা
লিখেছেন লিখেছেন অভিযাত্রিক ০৬ জানুয়ারি, ২০১৩, ১০:৪৯:২৬ রাত
দেশে চার মাস থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু কথা লিখে রাখি। ব্রাউজিং স্পিড বা নেটওয়ার্ক নিয়ে অভিযোগের প্রসঙ্গে আমার কথা নেই আপাতত। আমার দেশ এখনো দরিদ্র, অনুন্নত। এখানে আমি এক এমবিপিএস আনলিমিটেড ইন্টারনেট আশা করিনি। বরং মাঝে মাঝে অনুভব করি, যে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘুম থেকে উঠে আদৗ কিছু খেতে পারবে কি না তাই জানেনা, ঐ দেশে বসে মেইল চেক করতে পারাটা অনেক অনেক বড় ব্যাপার। আমাকে বরং বারবার পীড়া দিয়েছে সেবা প্রদানকারী কোম্পানীগুলোর অসততা আর চৌর্যবৃত্তি।
যেদিন ঢাকায় পৌছলাম, ঐ দুপুরে সিটিসেলের একটা যুম আল্ট্রা মডেম দিয়ে সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করলাম। মডেমটা বাসায় ছিলো কিন্তু এর আগের দুই এক মাস ব্যবহার করা হয়নি। টাকা টপ আপ করা হয়নি তাই ডিসকানেক্টেড। জানতে পারলাম ঐটাতে আল্ট্রা সিক্স নামে একটা প্ল্যান ব্যাবহার করা হতো। যার গতি একশ পঞ্চাশ কেবিপিএস, দুই গিগা ইউজেস লিমিট এবং মাসে দিতে হয় সাড়ে চারশত টাকার মতো। দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আরো বেশি গতির কি আছে, তাদের দেয়া লিফলেট থেকে জানলাম আল্ট্রা টু নামে একটা প্যাকেজ আছে, তিনশ কেবিপিএস স্পিড, তিন গিগা লিমিট এবং এর জন্য দিতে হবে নয়শত টাকার মতো। একটিভেট করার জন্য সিটিসেলের একটা নাম্বারে ‘আল্ট্রা টু’ লিখে এসএমএস পাঠাতে হবে।
মোবাইল নাম্বারটাতে নয়শত টাকা টপ আপ করলাম। বাসায় এসে মডেম কম্পিউটারে লাগিয়ে এসএমএস পাঠিয়ে দিলাম। এরপর এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেলো তবু কানেক্ট হয়না। কাষ্টমার কেয়ারে ফোন করলাম। মধুময় কণ্ঠে রাশেদ (আসল নাম না) নামের এক ভদ্রলোক '‘ছার-ছার-ছার'’ ডেকে বিলাপ করতে করতে আর বিনয়ে চাটতে চাটতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে আমার একাউন্ট দেখে জানালেন, আমাকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে আরো পাঁচশ টাকার মতো টপ আপ করতে হবে।
কারণ হলো, দুই তিন মাস আগের ব্যবহার করা আল্ট্রা সিক্স প্যাকেজ টা আগে ডিএকটিভেট করা হয়নি। তাই টাকা ঢুকানোর সাথে সাথে আগের প্যাকেজের জন্য টাকা কাটা হয়ে গেছে। এরপর আমি আবার অন্য প্যাকেজের জন্য এসএমএস পাঠানোতে এখন ঐ নতুন প্যাকেজ চালু হয়েছে, কিন্তু এর জন্য লাগবে নয়শ টাকার মতো। আমার একাউন্টে বাড়তি ছিলো চারশ টাকার মতো। বাকিটা দিতে হবে।
আমি তো জানতাম না, আগের প্যাকেজ দুই তিন মাস ইনএকটিভ থাকলেও তা ডিএকটিভেট করতে হয়। লিফলেটেও লেখা ছিলো না। কিন্তু কাষ্টমার কেয়ার দু:খিত গলায় এ প্রান্তে স্যারকে জানালেন, তিনি দু:খিত হলেও কিছু করতে পারবেন না। বুঝলাম, ইগনোরেন্স ইজ নট এন এক্সকিউজ। অনুরোধ করলাম, তাহলে যে প্যাকেজটার জন্য টাকা কেটে নেয়া হয়েছে, স্লো স্পিডের সে আল্ট্রা সিক্স ই তাহলে আমাকে একটিভেট করে দিতে। ঐটাই ব্যবহার করার সুযোগ দিতে বললাম। তখন আমি বিস্ময় ও দু:খে অভিভূত হয়ে জানতে পারলাম, ভিক্ষা না চাইলেও কুত্তা সামলানো হবে না! যেহেতু আমি এসএমএস পাঠিয়েছি আল্ট্রা টু একটিভেট করার জন্য সুতরাং আগে বাকি টাকা কাটা হবে, দুনিয়া ওলট পালট হয়ে গেলেও এ টাকা না কেটে অন্য কিছু করা সম্ভব না। আবার পরে এটা যদি ডিএকটিভেট না করি তাহলে এরপর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নয়শত করে কাটা শুরু হবে। আমি যার থেকে মডেমটা নিয়েছি, সে সবসময় সিক্সই ব্যাবহার করে। সুতরাং ভবিষ্যতের জন্য আবার সিক্স এ কনভার্ট করার বিষয়টা খেয়ালও রাখতে হবে।
বহু আগে একটা ছবি দেখেছিলা এনাকোন্ডা নামে। বিশাল এক সাপ মানুষদেরকে গিলে খায়, মাঝে মাঝে পেঁচিয়ে ধরে তারপর মহানন্দে মোচড়ায়। আমার মনে হলো অসহায় এক ‘'ছার'’ কে সিটিসেলের মতো জায়ান্ট এনাকোন্ডা পেচিয়ে ধরে টাকাটা নিয়ে গেলো, কিছু করার নেই নিয়তি মেনে নেয়া ছাড়া।
সিটিসেলের সুবিধা হলো মফস্বল শহর এমনকি গ্রামেও ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। তবে খরচ ওয়াইম্যাক্স গুলো থেকে একটু বেশি। বেশি স্পিড নিতে গেলে ওয়াইম্যাক্স থেকে খরচ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু নেটওয়ার্ক ওয়াইম্যাক্স থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো। সেদিন সিটিসেলের প্রতি যে ঘৃণার উদ্রেক হলো, তাতে আমি আর ওদের ইন্টারনেট ব্যবহার করিনি।
এ অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তীতে আরো কিছু নিদারুণ আনন্দ থেকে শিখেছি, কয়েকটা ‘'জিআরবিএসবি’' (গোল্ডেন রুল ওভ বাংলাদেশী সেবাপ্রদান বাটপারী)! হলো:
১. কাষ্টমার কেয়ারে ফোন করলে টাকা খরচ হওয়ার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশে কাটা হয়, কোথাও কোথাও বরং দ্বিগুণ তিনগুণ কাটা হয়। পরিচিত একজন বললেন, যদি এভাবে টাকা কাটা না হতো তাহলে মানুষজন অনর্থক কাষ্টমার কেয়ারে ফোন করতো আর ওখানে কাজ করা মেয়েদেরকে উত্যক্ত করতো। যুক্তিটা আমি মেনে নিয়েছি, কারণ এটা সম্ভবপর সম্ভাবনা। কতবড় অথর্ব মানসিকতা আমাদের!
২. কাষ্টমার কেয়ারে ফোন করলে সাধারণত তারাই সমস্যাটা সমাধান করে দেয়ার কথা। আমার অভিজ্ঞতায় অল্প যেসব ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের এক্সেস নেই, তখন তারা বিষয়টা ফ্ল্যাগ করে রাখে, এবং পরের এক দুই দিনের ভেতর সমাধান পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে কাষ্টমার কেয়ারে ফোন করে কেবল তথ্য জানা যায় এবং প্রচুর স্যার সম্বোধন শোনা যায়। তাদেরকে কোন কিছুর সমাধান করার ক্ষমতা দেয়া নেই এবং তাদের কিছু করার কোন পদ্ধতিও সম্ভবত নেই। বরং এমন কিছু হলে তখন তারা তখন সরাসরি সশরীরের কাষ্টমার কেয়ার সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। শুধু সিটিসেল না, আরো কিছু সেবা প্রদানকারী কোম্পানীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে। এছাড়া এরা অকারণে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আলাপ লম্বা করে, সময়ের কোন দামই নাই আমাদের দেশে।
৩. গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার প্রথম ও প্রধান চ্যানেল হলো অসংখ্য প্যাকেজে খুটিনাটি পার্থক্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে দেয়া এবং এইসব প্যাকেজের ফাকতালে বাড়তি অর্থ অনর্থক আদায় করে নেয়া। প্রতিটা মোবাইল ও ইন্টারনেট কোম্পানীর এরকম অসংখ্য অগণিত প্যাকেজ আর প্ল্যানের ছড়াছড়ি। একটাতে এই কম তো আরেকটাতে ওই কম। ছোট ছোট পার্থক্য যোগ করে বিভ্রান্ত করে বড় বড় টাকা হাতিয়ে নেয়ার এই মোক্ষম ধান্দা নির্বিবাদে চালাচ্ছে সবাই। কেউ যদি এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সিম্পল একটা প্ল্যানে থাকতে চায় তবুও কখনো না কখনো গলায় ফাঁস পরিয়ে টাকা আদায় করা হবে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের যা চরিত্র, এই প্ল্যান ওই প্ল্যান গুতাগুতি করা আর এ সুবিধা ঐ সুবিধার পিছনে দৌড়াদৌড়ি করা, তাহলেই কেল্লাফতে।
৪. বিভিন্ন সেবা চালু করার উপায় বারবার রাতদিন শোনানো হবে রেডিও টিভি পত্রিকার মাধ্যমে। কিন্তু ঐ সেবার খুটিনাটি বিষয়, কোন কোণায় গিয়ে গ্রাহক কোন সমস্যায় পড়বে, কোন স্পেসিফিক সেবা নিতে হলে কি করতে হবে, অফ করার উপায় এগুলো জানার কোন উপায় নেই। সিটিসেলের ওয়েবসাইট কিংবা লিফলেট কোথাও লেখা নেই আগের প্যাকেজ ডিএকটিভেট করার কথা। এগুলো জানার দুটো উপায়। হয় ঐশীবাণীর মাধ্যমে, অথবা বাঁশ খেয়ে মুগ্ধ হওয়ার পরে দৌড়াদৌড়ি করে।
মোবাইলে জোচ্চুরী করে যাচ্ছে থার্ড পার্টি কন্টেন্ট প্রোভাইডার কোম্পানীগুলো, যার লুটের কোটি কোটি টাকার ভাগ নিচ্ছে মোবাইল কোম্পানীগুলো। এরকম ‘ব্রেকিং নিউজ’ যখন আমি পাওয়া শুরু করলাম, ইন্টারনেট সার্চ করে বের হলো, আমাকে এই মহান সেবা দিচ্ছে ‘বিটুএম টেকনলজিস’ নামে একটা কোম্পানী। তাদের ওয়েবসাইটে খবর, কৌতুক, রাশিফল, ধাঁধাঁ, উক্তি, রিংটোন, ওয়ালেপেপার এরকম আউল ফাউল অর্থহীন ত্রিশটারও বেশিধরণের কন্টেন্ট একটিভেট করার উপায় দেয়া আছে, একটাও অফ বা বন্ধ করার উপায় কোথাও দেয়া নাই।
আর যখন তারা ‘'না চাহিলেও তারে বাঁশ দেয়া যায়'’ গান গাইতে গাইতে আমার মতো রসকষহীনদেরকে সেবা দেয়া শুরু করে তখন তা বন্ধ করার উপায় খুঁজে পেতে পঞ্চাশ একশ টাকা বেরিয়ে যাবে, যদি আপনি ঠিকভাবে খুঁজতে পারেন। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যেখানে প্রযুক্তি বিষয়ে স্বল্পঅভিজ্ঞ, ওখানে এরা কোন স্কেলে হরিলুট চালাচ্ছে তা ভাবলে আনন্দে গা শিহরিত হয়।
আজকে অনেক লিখলাম, কিছুটা বড় হয়ে গেলো। পরে বাংলালায়ন আর একটেল নিয়ে অভিজ্ঞতাগুলো আবার লিখবো। সবগুলো কোম্পানীর সেবার ক্ষেত্রেই জোচ্চুরী করার জন্য উপরের চারটা সূত্র সাধারণভাবে প্রযোজ্য। এর বাইরে এদের নিজস্ব কিছু কিছু শয়তানীও আছে। একটেল (এবার গিয়ে দেখলাম 'রবি' হয়ে গেছে। অন্য কিছু পরিবর্তন হোক বা না হোক, নাম পরিবর্তনে আমরা বিশ্বসেরা) নাম্বারটা ব্যবহার করছি প্রায় দশবছর হয়ে গেলো, তাই ছেড়ে দিতে পারি না। আর ছেড়েও লাভ নেই, সবগুলো কোম্পানীই মোটামুটিভাবে চোর শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত।
কয়েকটা সেবা প্রদানকারী কোম্পানীর কাজকর্মের উপর ভিত্তি করেই পুরো দেশকে অসৎ মানুষের দেশ বলা ঠিক না। দেশের কোটি কোটি গরীব মানুষ অসততা করেনা, বরং কাজ করে দুইমুঠো খেয়ে বাঁচতে চায়। সুতরাং এ আখ্যাটা আমি শুধু এদের কারণেই দেইনি। কিন্তু একটা রাষ্ট্রব্যাবস্থার যারা চালিকাশক্তি, রাজনীতিবিদ-ব্যাবসায়ী-শিক্ষক-কর্মচারী; বাংলাদেশে এদের বর্তমান প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অসততা। সেবাখাতের চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হলো, খাদ্য ব্যাবসায় আরো বেশি ক্ষতিকর অসততা চলছে মহানন্দে, অবাধে। সব ব্যাবসায়।
যেদিন দেশে গিয়েছিলাম, পরের সপ্তাহেই এক ব্যাবসায়ী বন্ধু বলেছিলো, বাংলাদেশে অসৎ উপার্জন অথবা ফরেন রেমিটেন্সের টাকা ছাড়া স্বচ্ছল থাকার কোন উপায় নেই। এবং কোন ব্যাবসায়ী অসততা না করলে হারিকেন হাতে আর বাঁশ পিছনে নিয়ে ঘুরতে হবে। খাবারের তেলে বিভিন্ন তরল ও কেমিক্যাল মেশানোর জন্য ঐ বন্ধুর প্রতি সেদিন ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিলো, কিন্তু চারমাসের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি তার কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। অন্যায়, অবিচার, শঠতা এবং প্রতারণাই হলো দুই হাজার বারো সালের বাংলাদেশের মূল বৈশিষ্ট্য। এটা এখন একটা অসৎ মানুষের দেশ।
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন