আবদুল কাদের মোল্লা শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)

লিখেছেন লিখেছেন অভিযাত্রিক ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:১৯:৩২ সকাল

কাদের মোল্লা শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) চাচার সাথে স্মৃতি অনেক কম। তবু যা আছে তাতে আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞ, একজন শহীদের স্নেহ কিছুটা হলেও পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি তাঁর আত্মা এখন জান্নাতের সুঘ্রাণ পাচ্ছে। মানুষের জীবনে এর চেয়ে মহত্তম অর্জন আর কি আছে?

আমার আব্বা যখন জামায়াতের কেন্দ্রীয় দায়িত্বে ঢাকা আসলেন, তার আগেই আমি সউদি আরবে পড়ালেখা করতে চলে গিয়েছিলাম। পরে বিভিন্ন সময় দেশে গেলে আমার ঝোঁক সবসময় ছিলো চট্টগ্রামের প্রতি, ঢাকায় তেমন থাকা হতো না। তাই আব্বার সহকর্মীদের সাথে, ঢাকার কারো সাথে তেমন পরিচয় হয়নি। কাদের মোল্লা চাচার সাথে প্রথম পরিচিত হই দুইহাজার সাতের মাঝামাঝি। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে দেশে গিয়েছিলাম।

ভার্সিটির দেয়া টিকেটে দেশে এসেছি। খরচের হাতের কারণে স্কলারশিপ থেকে জমিয়ে আনা টাকাও শেষ। একদিন সকালে কেন্দ্রীয় অফিসে গেলাম আব্বার কাছ থেকে কিছু টাকা নেয়ার জন। গিয়ে ওনার টেবিলের সামনে বসে অপেক্ষা করছি। একটু পর সবাই একসাথে কোন একটা প্রোগ্রাম থেকে বের হলেন। কাদের মোল্লা চাচা আর মকবুল আহমেদ চাচা একসাথে আসলেন ঐ রুমে আব্বার সাথে। কেউ আমাকে চিনতেন না। আর আমি চাচ্ছিলাম কোন একটা সুযোগে উনাদের সামনে না পরে টাকাটা নিয়ে চলে আসতে। বড় বড় মানুষদের কাছে যেতে সবসময়ই আমার অস্বস্তি।

কিন্তু আব্বার অভ্যাস অন্যরকম। আমার ঘাড় ধরে মকবুল আহমেদ চাচাকে বললেন, এই ছেলেটাকে একটু দোয়া করে দেন। আগে ঠিকমতো নামায পড়তো না। এখন তো বিদেশে থাকে, কি অবস্থা জানার সুযোগ নাই। এইসব শুনে আমি সবসময় যা করতাম, কিছুই যেহেতু করার নেই তাই মাটির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলাম। তখন কাদের মোল্লা চাচা বললেন, তাহের ভাই চিন্তা করবেন না। আমাদের বয়স পঞ্চাশ আর ওদের বয়স পঁচিশ। জোয়ান ছেলেপুলের কাছ থেকে বুড়োদের মতো দাবী করলে হবে? ওরা যখন বুঝবে তখন এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি চুপচাপ শুনে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি যে আমার চেহারা ভুলেননাই তা বুঝতে পারলাম কয়েকদিন পর ভোরবেলায়।

জামায়াতের নেতারা প্রায় সবাই স্বাস্থ্যগতভাবে খুব খারাপ অবস্থায় থাকেন। তারা গড়পড়তায় সংগঠনের জন্য প্রোগ্রাম সফর কন্ট্রাক্ট এসব কাজে যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন, একজন পরিশ্রমী সফল ব্যাবসায়ীও সাধারণত তত কষ্ট করেননা। কিন্তু তাদের মাঝে খাদ্যাভ্যাস হিসেব করা, ব্যায়াম করা, এসব স্বাস্থ্যগত বিসয় পালন করেন হাতেগোণা অল্প কয়েকজন। কাদের মোল্লা চাচা ছিলেন এমন একজন। আব্বাস আলী খানের 'স্মৃতি সাগরের ঢেউ' বইটাতে স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখার এ বিষয়টা নিয়ে কিছু কথা আছে। ঐ বাক্যগুলো আন্ডারলাইন করে বইটা আমি আব্বাকে দিয়েছিলাম, কোন কাজ হয়নি।

দুই তিন দিন পর ভোরবেলায় রমনা পার্কের দিকে যাচ্ছি, ওয়ারলেসে রেলগেটের উপর 'ভাতিজা' ডাক শুনে দৌড়ানো থামিয়ে দেখি রাস্তার অন্য পাশে কাদের মোল্লা চাচা। জোরে জোরে হাটছেন, সাথে আরেকজন এটেনডেন্ট। জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাচ্ছি। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, তোমার আব্বা তো নিশ্চয় ঘুমাচ্ছেন। বাপের প্রতি কোন খেয়াল না রেখে নিজে ব্যায়াম করলে হবে? কেমন বাপকা ব্যাটা হলে তাহলে? উনার খোঁচাটা এবারও চুপচাপ মেনে নিলাম হাসতে হাসতে। ওনাদের ব্যাক্তিত্বের কারণে এসব নিয়ে জোর করাটা তখন আমাদের জেনারশনের পক্ষে অসম্ভব ছিলো, অন্যদেরও মোটামুটি একই অবস্থা দেখেছি। কিছু বলার ছিলোনা।

এরপরে আরো চারপাঁচবার দেখা হয়েছে। একবার সাংগঠনিক প্রোগ্রামে, বক্তব্য রেখেছিলেন 'মুসলিম হিসেবে একজন মানুষ যেখানে, যেদেশেই থাকুক না কেন, কেন ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা দরকার' এধরণের একটা বিষয়ে। আরেকবার উনাকে আমি ভাড়া করা গাড়ি ড্রাইভ করে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়েছিলাম অনেক রাতে। রাত দেড়টা দুইটার দিকে ইউসুফ স্যারের বাসা থেকে তুলে নিয়েছিলাম, সাথে খায়রুল ভাই গিয়েছিলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তিনি নামায পড়ে নিয়েছিলেন। বিমান ছাড়ার আগে বেশি সময় ছিলো না, এক ঘন্টারও কম। চেক ইন করতে দেয়ার কথা ছিলো না। আমরা একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম, শেষ চেষ্টা করতে আমাকে একশ সত্তর আশি স্পিডে গাড়ি চালাতে হচ্ছিলো। আর তিনি পুরো রাস্তা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, বিদেশের রাস্তাঘাট নিয়ে বিভিন্ন কথা বলছিলেন।

সেই আবদুল কাদের মোল্লা চাচাকে গতকাল রাতে বাংলাদেশের সরকার ও বিচারব্যাবস্থা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে। আমার জন্ম হয়েছে একাত্তরের অনেক বছর পরে। একাত্তর দেখিনি, কিন্তু জামায়াত নেতাদেরকে দেখেছি। এবং আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, সাংবাদিকদেরও খুব কাছে থেকে দেখেছি। বাংলাদেশের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে, কখনো বা একটু বেশি আগ্রহ নিয়ে, দেখেছি ভেবেছি। অন্যদের মতোই কমন সেন্স দিয়ে আমি বুঝতে পারি কোন ধরণের মানুষদের সততা কেমন, মানসিক গড়ন কেমন, মনোবৃত্তি কেমন। কোন লোকদের পক্ষে কি করা সম্ভব।

এর বাইরে একাত্তরের যুদ্ধের সময় যেহেতু জামায়াত পাকিস্তানী সরকারের কাজকর্মে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলো, এমনকি কোথাও কোথাও পাক আর্মির সহযোগী হিসেবেও কাজ করেছে, তাই এ নিয়ে জামায়াত নেতাদের সাথে কথা বলেছি। কারো কারো ইন্টারভিউ সম্মতি নিয়ে অন-রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু উনাদের দলগত অবস্থান যেহেতু এসব নিয়ে কথা বলার না, সে অবস্থানের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি মনে করেছি এসব প্রকাশ করার সময় এখন না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত সম্ভব বই পড়েছি। অন্য একজন সচেতন মানুষ যেমন কোন ঘটনা বুঝার চেষ্টা করতে পারে, আমিও চেষ্টা করেছি।

আজকে কাদের মোল্লা শহীদকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন ইতিহাসের সূচনা হবে ইনশাআল্লাহ। দেশ খুবই সাময়িক একটা বিষয়, ইসলাম চিরকালের। আমি উনাকে যতদূর চিনেছি, তার ভিত্তিতে বলতে পারি এসব অন্যায় করার মতো মানুষ তিনি না। এ ধরণের অন্যায় ওনারা করেননি আর নৈতিকতার সাথে আপোষ করেননি বলেই বাংলাদেশে ভ্রষ্টবিচারের বাহানায় জুডিশিয়াল কিলিং করা হচ্ছে। এবং জামায়াতের বেশিরভাগ নেতাই এমন মানুষ না। বরং এ ধরণের অন্যায় কাজ বাংলাদেশের অন্য ধরণের মানুষরা অনেকেই করতে পারে। কিন্তু জামায়াতকে যারা জীবনের আদর্শ হিসেবে সজ্ঞানে বেছে নিয়েছেন, এসবের প্রতি ঝোঁক নেই বলেই তারা ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব পর্যায়ে আসতে পেরেছেন।

কাদের মোল্লা চাচা জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন অবিচল, নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন। নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি পারবো যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়ি? ওনারা কিভাবে পারলেন?

তখন বুঝতে পারি, বিশ্বাসের শক্তির কাছে পৃথিবীর অন্য সব কিছু তুচ্ছ, অনেক নিচু। খুবাইব বিন আদী রা.কে যখন কুরাইশরা হত্যা করেছিলো, তখন ক্রুসে নেয়ার পথে ও ক্রুসে তুলে দিয়ে মহিলা শিশু সবাই বিভিন্ন কিছু ছুড়ে মারছিলো। অপমান করছিলো। সেই মুহুর্তে খুবাইব রা. আট দশ বাক্যের একটা কবিতা বলেছিলেন। এর মাঝে বলেছিলেন: ওদের নারী ও শিশুরা সমবেত হয়েছে, ক্রোধে ফেটে পড়ছে/ কিন্তু যখন আমি আল্লাহর পথে নিহত হই, তখন অন্য কিছুর পরোয়া কিভাবে করি? যেখানে আমি মারা যাচ্ছি শুধু আল্লাহর জন্য/ আমার ভাঙ্গা হাড় আর ছিড়ে যাওয়া শরীরের অংশ তিনি চাইলে ঠিক করে দেবেন!

আজকে আমি দেখি বাংলাদেশের তথাকথিত দেশপ্রেমের দায় শোধ করতে নারী পুরুষ যুবক কিশোরী কত মানুষ রংবেরং নিয়ে শাহবাগে উপস্থিত হয়েছে। চৌদ্দশত বছর আগের অতীতের ভাঁজে আটকে থাকা আরেকটা ঘটনা আর সময়ের সাথে অলৌকিক সাযুজ্য দেখে শিহরিত হই। শত শত বছরের এ দীর্ঘ পথচলায় কত শত শ্রেষ্ঠতম মানুষেরা এই শহীদি মিছিলে পা মিলিয়েছেন? অনন্তের দিকে রহমতের ছায়ায় হেটে চলা, নবীদের পরেই যাদের মর্যাদা, সে শহীদানদের স্মৃতিতে আমরা গুনাহগার মানুষেরা অশ্রুসজল হই।

এই বাংলাদেশ কিছু বছর আগে ছিলো না। আর কিছু বছর পরে পৃথিবীর এ অংশে কি ঘটবে আমরা কেউ জানিনা। দেশপ্রেমের নাম নিয়ে মিথ্যে আবেগ আর মিথ্যা বিচারের পৈশাচিক আনন্দে ফেটে পড়া মানুষগুলো সবাই মিলে একজন আবদুল কাদের মোল্লা শহীদের সামনে কতটা তুচ্ছ!! ভাবনায় আসে না। আমাদের পৃথিবীতে এভাবেই বোধহয় বৃহৎ ও ক্ষুদ্রেরা পাশাপাশি সমান্তরাল চলে। আমরা বুঝতে পারিনা আ'লামে আরওয়াহ থেকে শুরু হওয়া বিশাল যাত্রায় আমাদের অবস্থান কোথায়। আর এধরণের বিভিন্ন ঘটনায় আল্লাহর বাছাই করা মানুষগুলো সমস্ত ক্ষুদ্রতার বন্ধন ছিড়ে হাসতে হাসতে চলে যান মহামহিম স্রষ্টার আরশের ছায়াতলে।

কখনো কল্পনা করি, খুবাইব হামযা থেকে শুরু করে সাইয়েদ কুতুব হাসানুল বান্না ওমর মুখতার আবদুল মালেক শহীদের সাথে আজ বুঝি দেখা করেছেন আবদুল কাদের মোল্লা শহীদ। ওদের কথা বলার ভাষা কি? পৃথিবীর সীমাবদ্ধতাগুলো তো সেই আত্মার জগতে নেই। ওখান থেকে তারা কি আমাদের জন্য শুভকামনা করেন? তারা কি তাদের হত্যাকারীদের, ঘৃণ্য জালিম পশুগুলোকে কখনো ক্ষমা করে দেন?

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা মৃত না, বরং আমাদের মতই জীবিত। রাসুল সা. বলেছেন, যখন তারা শহীদ হওয়ার স্বাদ পান তখন বারবার পৃথিবীতে এসে বারবার শহীদ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন। কেমন সেই জীবন ও মৃত্যুর সব সীমা ছাড়ানো অনির্বচনীয় স্বাদ? কোন মানুষদেরকে আল্লাহ তায়ালা ঐ মহত্তম সম্মানের জন্য ক্ববুল করেন এবং কেন করেন?

বিষয়: বিবিধ

২৪১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File