মাওলানা শফীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রসঙ্গে মামলা নিয়ে দুইকথা

লিখেছেন লিখেছেন অভিযাত্রিক ০৮ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৫৯:৪৩ রাত

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী মাওলানা শফী তার বইয়ে লিখেছেনঃ “আল্লাহ-তায়ালা মিথ্যা বলতে পারেন এমনকি ওয়াদারও বরখেলাফ করতে পারেন, কিন্তু করেন না”। এ কথার মাধ্যমে তিনি আল্লাহ তায়ালার অবমাননা করেছেন, এ অভিযোগ এনে ইসলামী ছাত্রসেনার নেতা ইমরান হোসাইন তুষার মূল উদ্যোক্তা হয়ে মাওলানা শফীর বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছেন। ব্যারিষ্টার তানিয়া আমীর তার হয়ে মামলা লড়বেন।

মাওলানা শফী মূল বইটি লিখেছেন উর্দুতে। তার অনুবাদ করেছেন মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, ‘ভিত্তিহীন প্রশ্নাবলীর মুলোৎপাটন’ এ নামে বইটি ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হওয়ার আঠারো বছর পর ইসলামী ছাত্রসেনা,বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি এবং আঞ্জুমানে গাউসুল আযম (সবগুলো বেরেলভী মতের অনুসারী ফেরক্বা/উপদল) নেতাদের বোধোদয় হয়েছে।

এ পর্যন্ত তথ্যগুলো পত্রিকা থেকে পাওয়া।

আলেমদের মাঝে অসংখ্য দল-উপদল, সাধারণ মুসলিমরা এতোকিছু বুঝেননা। তারা যে আলেমদের ভালো মনে করেন, অথবা যাকে সামনে পান তাদের অনুসরণ করেন। আল্লাহ তায়ালার বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাওলানা শফীর এ বক্তব্য মূলত দেওবন্দী আলেমদের সাধারণ মতামত। এ মতামত প্রকাশ করার পর মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহীর (রাহিমাহুল্লাহ) অনেক সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছিলো।

এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হলো, আক্বীদার মৌলিক বিষয়ে মুসলিমরা একমত, যেমন আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদের প্রসঙ্গ। কিন্তু এরপর আল্লাহ তায়ালার বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন তার কিছু কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। এটি মৌলিক বিষয়ে মতান্তর নয়, বরং প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ব্যাখ্যার ভিন্নতা।

দ্বিতীয় কথা হলো, এ বিষয়গুলো ভাষার প্রয়োগ এবং ব্যাখ্যার ভিন্নতার কারণে এমন জটিল যে তা বিশেষজ্ঞ আলেমদের ছাড়া অন্য সবার বোধগম্য নয়।

তৃতীয় কথা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ বিতর্কগুলো প্রায়োগিকভাবে অপ্রয়োজনীয়।

শেষ কথা হলো, আউট অভ কনটেক্সট এবং সিলেক্টেড টেক্সট দিয়ে কোন অভিযোগ আরোপ করলে কেমন লাগে, মাওলানা মওদুদীর (রাহিমাহুল্লাহ) প্রতি কি আচরণ করা হয়েছে, তা বুঝার জন্য এটা একটা ভালো উপলক্ষ।

যাইহোক, ‘আল্লাহ তায়ালা চাইলে মিথ্যা বলতে পারেন’, এবং ‘আল্লাহ তায়ালা মিথ্যা বলেন’ (আসতাগফিরুল্লাহ) এ দুটি বাক্যের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য, শুধুমাত্র একটা শব্দের কারণে।

সুরা নিসার ১২২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'আল্লাহর চাইতে অধিক সত্যবাদী কে”?'

কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা পরিস্কার বলেছেন, আবু লাহাব জাহান্নামের বাসিন্দা (সুরা লাহাব দ্রষ্টব্য)। এখন তিনি কি চাইলে আবু লাহাবকে জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারেন না? চাইলে পারেন। কিন্তু তিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ীই তা করবেন না। আবু লাহাবকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য তিনি বাধ্য নন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কোন স্ববিরোধী কথা বলেন না। এবং তিনি পুরোপুরি নিজের স্বাধীন ইচ্ছাতেই সবকিছু করেন। সুরা আস-সাজদার ১৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ “'আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে সঠিক দিক নির্দেশ দিতাম”'।

সুরা মায়িদার ১১৮ নাম্বার আয়াতে তিনি বলেছেনঃ “'যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন তবে তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করে দেন, আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান”'। এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম বায়দাভী (মৃত ৬৮৫ হিজরী) একটা কথা বলেছেনঃ “"তিনি প্রজ্ঞাময় জ্ঞান ও যথার্থতা ছাড়া পুরস্কৃতও করেন না, শাস্তিও দেননা। যদি কোন অপরাধীকে তিনি ক্ষমা করে দেন তাহলে তা তাঁর করুণা। সুতরাং তিনি যদি শাস্তি দেন তবে তাতে ন্যায়বিচার করেন আর তিনি যদি ক্ষমা করে দেন তবে তাতে অনুগ্রহ করেন। তিনি শিরকের গুণাহ ক্ষমা করেন না, এর কারণ তিনি তা ক্ষমা না করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। এমন না যে তিনি চাইলে তা ক্ষমা করতে পারেন না”"। (আনওয়ারুত তারতীল ওয়া আসরারুত তা’ওয়ীল/ তাফসীরে বায়দাভী)।

দেওবন্দী আলেমরা ফিক্বহী বিষয়ে ইমাম আবু হানীফার (রাহিমাহুল্লাহ) অনুসারী এবং আক্বীদাগত বিষয়ে সাধারণত ইমাম আবুল হাসান আশআরী ও ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী (রাহিমাহুমাল্লাহ) এর অনুসরণ করেন। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রাহিমাহুল্লাহ) এবং মাওলানা শফী এখানে আল্লাহ তায়ালার মিথ্যা বলার ক্ষমতাকে (জাওয়ায আক্বলী) ‘হাইপোথেটিকালি পসিবল’ বলে মত দিয়েছেন, (ইমকানিল কাযিব) মিথ্যার সম্ভাব্যতা বলে মত দেননি। পার্থক্যটা অতি সুক্ষ্ণ। ইচ্ছে করলে পার্থক্যটা দেখাও যাবেনা।

আল্লাহ তায়ালা কি তাঁর নিজের করা ওয়াদা ভেঙ্গে ফেলতে পারেন? এ প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা খলীল শাহরানপুরী তার বই ‘আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’ এ লিখেছেনঃ “"এ ধরণের কাজ করতে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই সক্ষম (মাক্বদূর ক্বাত’আন), কিন্তু তা সম্পাদিত হওয়ার বৈধতাবিহীন (গায়র জাওয়াযিল ওক্বু’)। এটাই আশআরী (শরয়ী ও যৌক্তিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) এবং মাতুরিদী (শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) আলেমদের মত”"।

আক্বীদার এ আলোচ্য বিষয়গুলো তাত্ত্বিক, দর্শনসংক্রান্ত এবং জটিল। ভুল বোঝাটা খুব সহজ, ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা করা আরো সহজ, কিন্তু বুঝা খুব কঠিন। ব্যাক্তিগতভাবে আমি অনেকসময় এর প্রয়োজনীয়তাও বুঝতে পারিনা। যাইহোক, আশআরী ও মাতুরিদী আলেমদের বাইরে বর্তমান আরব বিশ্বের দুইজন বড় আলেমের বক্তব্যও দেখা প্রয়োজন। শায়খ রামাদান আল-বুতী সিরিয়ার একজন বড় আলেম ছিলেন, এ মার্চে শহীদ হয়েছেন। আর প্রফেসর সা’দ রুস্তম একজন সালাফী পন্ডিত।

শায়খ মুহাম্মাদ সাঈদ রামাদান আল বুতী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ “"কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে বলেছেনঃ 'নিশ্চয় তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান' (আল আহক্বাফ: ৩৩)। সুতরাং এমন কোন কাজও তিনি করতে সক্ষম যা তার পক্ষে করাটা অনুচিত বলে বিবেচিত হতে পারে। হতে পারে এটা এমন কিছু যা আল্লাহ তায়ালার ত্রুটিমুক্ততার বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়না। এ ধরণের কোন কিছু করা থেকে তিনি অক্ষম নন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার অবস্থান হলো সকল প্রকার ত্রুটি ও অনুচিত কাজ করার উর্ধ্বে। কারণ তিনি তাঁর নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব ধরণের ত্রুটিযুক্ত বৈশিষ্ট্যের বাইরে রয়েছেন। তিনি সব ধরণের উৎকৃষ্ট ও বিশুদ্ধ বৈশিষ্টে গুণান্বিত, এটা পরিস্কারভাবে প্রমাণিত। আর এমন হওয়ার জন্য কেউ তাকে কোনভাবেই বাধ্য করেনি।

সুতরাং আল্লাহ তায়ালা কখনো মিথ্যা বলতে পারেননা, এটা একারণে নয় যে তিনি তা করতে অক্ষম। বরং, এর কারণ হলো এ বিষয়ে তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আর আল্লাহ যে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তা অপরিবর্তনীয়।

আরও জানা দরকার, কোন সৃষ্ট বস্তুর উত্তম হওয়া অথবা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার বৈশিষ্ট্যের কারণে আল্লাহ তায়ালার কাজে কোন প্রভাব পড়তে পারেনা। বরং, তাঁর কোন কাজ উত্তম হওয়া অথবা অগ্রহণযোগ্য হওয়া পুরোপুরি তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। সুতরাং, তিনি যা করতে সিদ্ধান্ত নেবেন তাই উত্তম এবং তিনি যা না করতে সিদ্ধান্ত নেবেন তাই অগ্রহণযোগ্য”"। এটা শায়খ বুতীর (রা.) বক্তব্যের অনুবাদ।

আল্লাহ তায়ালার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এধরণের বিভিন্ন আলোচনা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। ইসলামী আক্বীদার আলোচনায় একটি প্রশ্ন বিখ্যাত স্থান করে নিয়েছে, আল্লাহ কি এমন একটা পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যা তিনি নিজেই উত্তোলন করতে অক্ষম হবেন?

এধরণের প্রশ্নগুলোর বিষয়ে প্রফেসর সা’দ রুস্তম বলেছেনঃ "““আল্লাহ তায়ালার সক্ষমতা, যা নিঃসন্দেহে অসীম ও পরিপূর্ণ, এমন সব বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট যা যৌক্তিকভাবে সম্ভবপর। যৌক্তিকভাবে অসম্ভব এমন কিছুর সাথে আল্লাহ তায়ালার শক্তি সামর্থ্য সংযুক্ত নয়। এটা কোন ঘাটতি নয়, বরং এ বিষয়টি আরো কিছু উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে।

যেমন এধরণের কিছু আরো কিছু প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ কি আরেকজন আল্লাহ সৃষ্টি করতে পারেন? অথবা, আল্লাহ কি কাউকে তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতে পারেন? একজন অমুসলিম আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন: তোমার প্রভূ কি এমন পাথর বানাতে পারবেন যা এতোবড় হবে যে তিনি নিজেই তা নাড়াতে অক্ষম হবেন? আমি তাকে সরল উত্তর দিয়েছি। নিজেই নাড়াতে অক্ষম হয়ে পড়বেন এতোবড় পাথর বানানো আল্লাহ তায়ালার শক্তিমত্তার অংশ নয়। কারণ তিনি যাই সৃষ্টি করুন না কেন তাই তিনি নাড়াতে পারবেন। এই ধরণের কল্পিত পাথর বানানো আল্লাহ তায়ালার পক্ষে অসম্ভব হওয়ার অর্থ এই না যে তার শক্তিতে কোন ঘাটতি আছে। বরং, এটা তার শক্তিমত্তার পরিপূর্ণতা প্রমাণ করে। আপনি যদি প্রশ্ন করেন, আল্লাহ তায়ালা কি এমন কিছু করতে সক্ষম যা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব? আমি বলবো, না। তার অর্থ এই না যে আল্লাহর ক্ষমতা সীমিত। বরং এটা তার ক্ষমতার পরিপূর্ণতা নির্দেশ করে। অক্ষম না হওয়ার অর্থ হলো শক্তি থাকা। যেমন, আমরা যদি বলি যে আল্লাহ কোন কিছু সম্পর্কে অসতর্ক হননা অথবা কোন কিছু ভূলে যাননা, এর অর্থ এমন না যে তিনি অক্ষম বা ঘাটতিযুক্ত। বরং এটা তার ত্রুটিমুক্ততা, পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও জ্ঞান বুঝায়”"।

মোদ্দাকথা হলো, এ প্রসঙ্গে সালাফী ও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের সাথে আশাআরী ও মাতুরিদী আলেমদের খুব সুক্ষ্ণ কিছু মতপার্থক্য থাকতে পারে, যা আদৌ দৃশ্যমান না এবং যার আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। পার্থক্যটা হলো, মূলধারার আলেমরা সরাসরি বলছেন যুক্তিবিরোধী অথবা পরস্পরবিরোধী কিছু আল্লাহ করেন না। আর গ্রীক দর্শনে প্রভাবিত আশআরি ও মাতুরিদী আলেমরা মানতিকের (যুক্তিবিদ্যা) মারপ্যাচ খাটিয়ে বলছেন, করাটা সামর্থ্যের বাইরে তা না। তবে কথা একটাই, তিনি করেন না।

শায়খ সা'দ রুসতমের ফতোয়া

ইংলিশ অনুবাদ

শায়খ বুতীর ফতোয়ার উল্লেখ

শায়খ গাঙ্গুহীর ফতোয়া

বিষয়: বিবিধ

২০১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File