যাকাত:দারিদ্র্যতা বিমোচনের স্থায়ী কৌশলপত্র....( রমজান উপহার-৫ repost)

লিখেছেন লিখেছেন লোকমান বিন ইউসুপ ০৪ জুলাই, ২০১৪, ০৪:০১:৪৬ রাত



যাকাত দারিদ্র্যতা বিমোচনের স্থায়ী কৌশলপত্র:

প্রথমে আমরা লক্ষ্য করব যাকাতের অর্থ কি?

সুরা রুমের ৩৯ এবং সুরা তওবা ১০৩ আয়াত যাকাতের অর্থ নির্ধারন করে দিয়েছে।

وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ ۖ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ (৩০:৩৯)

(রুম-৩৯.) যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো, যাতে মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না। আর যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকো, তা প্রদানকারী আসলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করে।

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (৯:১০৩)

(তওবা-১০৩.) হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক পবিত্র করো, (নেকীর পথে) তাদেরকে এগিয়ে দাও এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করো। তোমার দোয়া তাদের সান্তনার কারণ হবে। আল্লাহ‌ সবকিছু শুনেন ও জানেন।

এই দুটি আয়াত থেকে বুঝা যায় যাকাত অর্থ পবিত্রতা আর বৃদ্ধি পাওয়া।

যাকাত কোথায় হইতে আদায় হইবে?

ইসলামী শরীয়ত অনুসারে যে সমস্ত সামগ্রীর উপর যাকাত ধার্য হয়েছে সেগুলি হলো-

১। ব্যাংকে/হাতে সঞ্চিত/জমাকৃত অর্থ।

২। সোনা, রূপা, এবং সোনা-রূপা দ্বারা তৈরী অলংকার।

৩। ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী।

৪। জমির ফসল।

৫। খনিজ উৎপাদন।

৬। সব ধরনের গবাদি পশু।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সুষ্ঠুভাবে যাকাত আদায়ের জন্যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবম ও দশম হিজরীতে আরব ভূখন্ডের বারোটি এলাকায় বারোজন প্রখ্যাত সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন।

অনুরূপভাবে চৌদ্দটি প্রধান গোত্র হতে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব তিনি বারোজন খ্যাতনামা সাহাবীর উপর অর্পণ করেছিলেন।

যাকাত যথাযথ বিলি বন্টনের জন্যেও নবীজীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্যোগেই বলিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরী হয়েছিল যা আজকে যেকোন উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে তুলনীয়। এ থেকেই বোঝা যায় যাকাত বায়তুলমালের কত বড় গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

যাকাত দারিদ্র্য বিমোচনের স্থায়ী কৌশলপত্র কেন?

ইসলামী ব্যাংক কনসালটেটিভ ফোরাম (আইবিসিএফ)-এর উদ্যোগে ‘শরীয়াহ ব্যাংকিং’ শীর্ষক সেমিনার ২৭ জুলাই শনিবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। আইবিসিএফ-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইবিসিএফ সেমিনার প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক একেএম নূরুল ফজল বুলবুল। সেমিনারে ‘যাকাত ভিত্তিক সমাজ গঠনে শরীয়াহ ব্যাংকের ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইসলামী ব্যাংকিং-এর কনসালটেন্ট এম, আযীযুল হক তার আলোচনায় বলেন, ২৩% লোক অতি দরিদ্র যারা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চিত। শুধু ব্যাংক ডিপোজিট থেকে ১৩৫০০ কোটি টাকা বৎসরে যাকাত আদায় সম্ভব। অন্য সম্পদ হিসাব করলে বার্ষিক ২৫০০০ কোটি যাকাত আদায় সম্ভব। সঠিকভাবে আদায় করলে ৫ বছরে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব। তিনি বলেন, ব্যাংক যাকাত সংগ্রহের সবচেয়ে সঠিক ও কার্যকরী মাধ্যম।

সভাপতির বক্তব্যে আইবিসিএফ এর ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। ২৫% যাকাত দানে সম লোকদের পে ২৩% দরিদ্র সীমার নীচে অবস্থানকারী লোকদের দায়িত্ব নেয়া খুব সম্ভব।

(http://www.notunkhobor.com/2013/07/28/5815)

ডোমেস্টিক সোর্স হতে প্রাপ্ত ১৩৫০০কোটি টাকা থেকে প্রতি পরিবারে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দিলে ২৭ লাখ পরিবারকে দেয়া যাবে।

135000000000/50000=2700000 (27 lac Family )

বিদেশী সোর্স হতে প্রাপ্ত যাকাত দিয়ে আনুমানিক ২৩ লাখ ফ্যামিলিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেয়া যাবে।

১০ বছরে ৫ কোটি ফ্যামিলি উপকৃত হবে।

প্রি পরিবারে ৫ জন ধরলে পাচঁ কোটি পরিবার মানে ২৫ কোটি মানুষ। আর আমাদের দেশে মাত্র ১৬ কোটি মানুষ। উদৃত্ত্ব টাকা দিয়ে আমরা কর্মসংস্থান আর শিল্পায়নের কাজে লাগাতে পারি।

এছাড়া

১.মা-বোনদের কাছে প্রচুর পরিমানে সোনা জমা আছে। মোটিভেশনের মাধ্যমে এর যাকাত নিশ্চিত করা গেলে

২.ব্যাবসায়ী সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ের পন্য সামগ্রী থেতে যাকাত আদায় নিশ্চিত করা গেলে

৩. ফসলের যাকাত ১/১০ বা ১/২০ ভাগ নিশ্চিত করা গেলে

৪. মাটির নীচের উৎপাদিত সম্পদ এর যাকাত নিশ্চিত করা গেলে

৫. সব ধরনের গবাদি পশুর (৪০ ছাগল বা ৩০ গরু) যাকাত নিশ্চিত করা গেলে আরো ব্যাপক ভাবে যাকাতের সমৃদ্ধ ফান্ড গঠিত হতে পারে। যা মানবতার টেকসই সমাজ উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

যাকাত বন্টনের খাত ।

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (৯:৬০)

(তওবা-৬০.) এ সাদকা গুলো তো আসলে ফকীর, মিসকীনদের জন্য। আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের জন্য মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য। তাছাড়া দাস মুক্ত করার, ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষে থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহ সবকিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ।

আয়াতটি লক্ষ্য করে দেখেন প্রথম ৪ টির শুরুতে 'লাম' অক্ষর লাগানো হয়েছে। শেষ ৪ টির শুরুতে 'ফি' অক্ষর লাগানো হয়েছে।

এর তাৎপর্য কি?

খেয়াল করে দেখবেন 'ফি' শব্দটি রিকাবের আগে প্রথম লাগানো হয়েছে।

এরই বা তাৎপর্য কি?

প্রখ্যাত কুরআন ব্যাখ্যা কারক ইমাম যামাখশারী এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে:

লাম অক্ষরটি তামলিক বা মালিক বানানো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ফি দ্ধারা পাত্র বা ক্ষেত্র বুঝায়। 'ফি' দ্ধারা শেষোক্ত ৪ জনের যাকাত পাওয়ার অধিকার অত্যাধিক দৃঢ় বুঝানো হয়েছে।

ইবনুল মনির তার 'আল ইনতিসাফ' গ্রন্থে বলেছেন 'ফি' দ্ধারা ক্ষেত্র চিহ্নিত করে বলেছেন যাকাত সামাজিক কল্যান মূলক কাজে ব্যয়ের বৈধতা রয়েছে এবং এর গুরুত্ব ব্যপক।

ইমাম ফখরুদ্দিন আল রাজী , তাফসীরে খাজেন, আলমুগনী গ্রন্থাকার ইবনে কুদামাহ , হাম্বলী আলিম 'গা'ইয়াতুল মুনতাহা' 'লাম' আর 'ফি' এর তাৎপর্য স্বীকার করেছেন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় রিকাব শব্দের আগেই প্রথম 'ফি' টা লাগানো হয়েছে। সম্ভবত এটা এই কারনে যে দাসত্ব বা বন্দীত্ব মানবতার সবচেয়ে অপমান জনক অবস্থা।

আমি প্রথমে শেষ ৪ টি বর্ননা করার চেষ্টা করব।

৫.নম্বর খাত(ওয়া ফির রিকাব) : ইমাম আবু হানিফা , শাফিয়ী ও তার সাথীগন, লাইস ইবনে সায়াদ , ইবনে আব্বাস ইমাম মালিক , ইমাম আহমদ ও ইসহাক এর মতে "দাস দাসীকে ক্রয় করে তারপর মুক্ত করে দেয়াটা এই সিস্টেমের অর্ন্তভূক্ত।" ইবরাহিম নখয়ী ও সাইদ ইবনে জুবাইর তাবেয়ী ফিকাহবিদ এটা অপছন্দ করেছেন। আবু উবাইদ ইবনে আব্বাস দাস মুক্ত করা মতের অধিকারী ।

ইসলামের কল্যানে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আবু গারিব কারাগার , গুয়ান্তানামো বে সহ পৃথিবীর অসংখ্য কারাগারে লাখো নির্যাতিত বনী আদম বন্দী আছেন। এই মুসলিম বন্দীরা ক্রিতদাসের মত মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে আছে। আপনারা জানেন মুসলিম বন্দীদের কে প্রশ্রাব খেতে বাধ্য করা হয়েছে। বন্দী অবস্থায় জয়নাব আল গাজালী আর আফিয়া সিদ্দিকীর করুন অবস্থার কথা আপনারা জানেন।

ইমাম আহমদের মতে: মুসলিম বন্দীদেরকে মুক্ত করা শরীয়াত সম্মত কাজ। ইবনে হুবাইব বলেছেন জায়েজ হবে।

যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে । যুদ্ধোত্তর বন্দীর কথা আপনারা জানেন। মানুষের প্রভূত্ব ও জুলুম থেকে মানবজাতির নিস্কৃতির জন্যে ইসলামের আগমন সুতরাং ইসলামের কাজ করতে গিয়ে নামে মুসলিম কামে অমুসলিমদের থেকেও খারাপ শাসকের রোষানলে পড়ে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার জন্যে যাকাতের টাকা ব্যয় অত্যাধিক মানবিক বলে বিবেচিত হবে।

সাইদ রিযা তার তাফসীর আল মানারে লিখেছেন যাকাত পরাধীন জাতি ও গোত্র সমুহের মুক্ত করনের জন্যে ব্যয় বৈধ হবে।

শায়খ মাহমুদ শালতুত তাকীদ বলেছেন ব্যক্তি দাসের মুক্তিকরন কার্যক্রম যেহেতু নাই সেহেতু জাতি ও গোত্র সমুহকে সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রামে সাহায্য করন ব্যয়ের ক্ষেত্রটি নতুন ভাবে নির্ধারিত খাত ।

জাতি দল গোত্র ক্রীতদাস বা পরাধীন বা দাসত্বের নিগড়ে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ উভয় ভাবে বন্দী হতে পারে।

৬.নম্বর খাত (আল গারেমুন): ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিকে যাকাত দেয়ার বিধান রেখে ব্যাংক্রাপ্সি বা দেউলিয়া হতে ইসলামী সমাজ পরিত্রান পেয়েছে।

৭.নম্বর খাত(ফি সাবিলিল্লাহ):

যাকাতের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি হল 'ফি সাবিলিল্লাহ'। অনেকেই এই বিষয়টা নিয়ে ভাল ভাবে জানেননা। যারা দ্বীন কায়েমের চেষ্টা করছেন তাদেরকে তাদের দলকে যাকাত দেয়া যাবে।

কারা দ্বীনের পথে আন্দোলন কারী?

১. যারা খারাপ কাজ হতে মানুষকে বিরত রাখে বুঝিয়ে হোক বা শক্তি সামর্থ দিয়ে হোক। নিসা -১৬৭

২. হিজরত বা মামলার কারনে ফেরারী লোকদের যাকাত দেয়া যাবে। (ওয়াল্লাজিনা হাজারু ফি সাবিলিল্লাহ।)

৩. যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করে।

৪.কুরআনের জিহাদ যত জায়গায় এসেছে সে সমস্ত পদ্ধতি যারা অবলম্বন করে তারা দ্বীনের পথে আন্দোলন কারী।

৫. যারা আল্লাহর পথে আহবান করে ও সৎ কাজের আদেশ দেয়।

৬. ইসলামী জ্ঞান অর্জন।

৭. ইসলামী বইপত্র প্রকাশ সহ যাবতীয় আল্লার রাহে কাজের কর্মীরা দ্বীনের পথে আন্দোলন কারী।

৮. ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতান্ত্রিক মতবাদ থেকে সমাজকে মুক্ত করনের কাজ যারা করেন তারা দ্বীনের পথে আন্দোলন কারী।

৮.নম্বর খাত(ইবনুস সাবীল):

ইবনুস সাবীল কে?

বাংলায় হল পথিক।

এটি নাগরিক সেবার অনন্য দৃষ্টান্ত।

তাবারী মুজাহিদ থেকে বর্ননা করেছেন

পথিক ব্যক্তির একটা হক্ব রয়েছে যাকাত সম্পদে। যদি সে ধনীও হয় এবং নিজের সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ইবনে জায়দ বলেছেন ইবনুস সাবিল মানে মুসাফির পথিক সে ধনী হোক বা গরীব হোক। যদি সে প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ব্যপারে বিপদগ্রস্থ বা সম্পদ হারিয়ে পেলে বা কোন বিপদের সম্মুখীন তবে তার যাকাতের টাকা প্রাপ্য।

কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ইবনুস সাবীলের প্রতি বদান্যতা দেখিয়েছে।

যেমন : আল ইসরা ২৬,রুম ৩৮, বাকারাহ-২১৫ , নিসা-৩৬, আনফাল-৪১, হাশর-৭, বাকারাহ -১৭৭, মুলুক-১৫, মুজাম্মিল-২০। আল ইমরান-১৩৭।

সবচেয়ে সুন্দর কথা বলা হয়েছে সুরা হজ্জের ৪৬ আয়াতে।

أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا ۖ فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَٰكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ

তারা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করেনি, যার ফলে তারা উপলব্ধিকারী হৃদয় ও শ্রবণকারী কানের অধিকারী হতো? আসল ব্যাপার হচ্ছে, চোখ অন্ধ হয় না বরং হৃদয় অন্ধ হয়ে যায়, যা বুকের মধ্যে আছে।

রাসুলে করীম সঃ বলেছেন:

যে লোক ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতের পথে চলা সহজ করে দেবেন। (মুনযেরী, মুসলিম কিতাবুল ইলম)

আর যে লোক ইলম সন্ধান করার জন্যে বের হল সে আল্লাহর পথেই রয়েছে যতক্ষন না সে ফিরে আসে।( তিরমিযী)।

সুতরাং প্রত্যেক দল ও জাতি গোষ্ঠির জন্যে ইলম তালাশকারী গবেষক দল থাকা উচিত যারা গবেষনার জন্যে ব্যপক ফান্ডিং পাবে।

ক.জিহাদের জন্যে সফর ইবনুস সাবিলও হবে , ফি সাবিলিল্লাহ হবে।

খ. হজ্জের উদ্দেশ্যে সফর হতে পারে।

গ. বিনোদনের জন্যেও সফর হতে পারে।

সফরের বিষয়টি এমন যে তাতে রোযা ভাঙ্গা যায় আর সালাত কসর করা যায়।

স্বৈরাচার সরকারের কারনে ফেরারী (পথিক) লোকজন বা ঘরছাড়া লোকজন যাকাতের হক্বদার হবে।

কল্যান মূলক কাজে বিদেশগমনকারীরা ইবনুসসাবীল হবে। স্টুডেন্ট ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এর অর্ন্তভূক্ত হবে ।

হাম্বলী মাযহাবের মতে যারা রাস্তায় ভিক্ষা চায় তারা ইবনুস সাবীল। গৃহহীন মানুষ ইবনুস সাবীল হবে।

কুড়িয়ে পাওয়া মানুষ ইবনুস সাবীল হবে। (সাইয়েদ রশীদ রিযা তার তাফসীরে বলেছেন)

৩ নম্বর খাত(যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী):

ইমাম শাফেয়ীর মতে যাকাত আদায়ের কর্মচারীরা যাকাতের সর্বোচ্চ ১/৮ পাবে ।

রাসুলের যাকাত আদায়ের প্রতিষ্ঠানে নীচে বর্ণিত আট শ্রেনীর কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। এর হচ্ছে-

১। সায়ী = গবাদী পশুর যাকাত সংগ্রাহক

২। ক্বাতিব = করণিক

৩। ক্বাসাম = বন্টনকারী

৪। আশির = যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী

৫। আরিফ = যাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী

৬। হাসিব = হিসাব রক্ষক

৭। হাফিজ = যাকাতের বস্তু ও অর্থ সংরক্ষক এবং

৮। ক্বায়াল = যাকাতের পরিমাণ নির্ণয় ও ওজনকারী

৪র্থ খাত(মুয়াল্লাফাতুল কুলুব)

অমুসলিমদের যাকাত দেয়া যাবে কি?

১.সুরা মুমতাহিনার ৮ আয়াত অনুযায়ী যারা মুসলিমদেরকে ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার এবং দ্বীনের ব্যাপারে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নয় তাদের মনরঞ্জনের জন্যে যাকাত দেয়া বৈধ।

২. যারা মুসলমান রাষ্টের আনুগত্য স্বীকার করেছে ,

ইসলামের দেশীয় আইন বিধান (ল অব দ্যা ল্যান্ড) তাদের উপর জারির অনুমতি দিয়েছে ,

দারুল ইসলামের অধীনতা অর্জন করেছে ,

নাগরিকত্ব লাভ করেছে ।

সুরা বাকারাহ এর ২৭২ আয়াত অনুসারে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে অমুসলিমদের দেয়া বৈধ। কারন ইন্নামাল আ'মালু বিন্নিয়াত দিয়ে ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে। ।

দাহর ৮ এ অমুসলিম বন্দীদের খাবার খাওয়ানোকে উৎসাহিত করেছেন।

ইমাম আবু হানিফা ও মুহাম্মদ সাদকায়ে ফিতর কাফফারা মান্নত থেকে জিম্মিদের দেয়া পছন্দ করেছেন।

আবু উবাইদ ও ইবনে আবু শাইবা কোন কোন তাবেয়ী থেকে বর্ননা করেছেন পাদ্রী পুরোহিতদের সাদকায়ে ফিতরার অংশ দিতেন।

ইবনুল মুনজিন মুয়াজ বনির্ত হাদীস থেকে দলীল দিয়েছেন যে যাকাত অমুসলিমদের দিলে যাকাত বৈধ হবেনা।

মুয়াজ বর্নিত হাদীস টি হল:

আল্লাহ তায়ালা তাদের ধনে মালে তাদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন। আর তা ধনীদের নিকট থেকে নেয়া হবে এবং তাদেরই গরীবদের নিকট বন্টন করা হবে।

অমুসলিমদের যাকাত না দেয়ার ইজমার পর্যালোচনা করা যাক।

ইবনে সিরিন ও জুহরী কাফিরদের যাকাত দেয়া জায়েজ বলেছেন।

ইবনে আবু শাইবা আর জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন যাকাত মুসলিম ও জিম্মিদের দেয়া যাবে। (মুরসাল হাদীস)

ইবনে আবু শাইবা হযরত উমর থেকে বর্ননা করে বলেছেন আহলি কিতাবদের যাকাত দেয়া যাবে।

ইমাম ইউসুপ বলেছেন বৃদ্ধ ইহুদীকে যাকাতের ফান্ড থেকে হযরত উমর রাঃ যাকাত দিয়েছেন। বালাযুরী তার ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন দামেশকের আল জাবিয়া নামক স্থানে হযরত উমর উপস্থিত হয়ে খ্রিস্টান কুষ্ট রোগগ্রস্থ লোক দের সাদকাহ (ফরজ যাকাত) দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সাদকাহ ফরজ যাকাত এই জন্যে যে যাকাতই রাষ্টের ভান্ডারে থাকে।

রওজুননজীর গ্রন্থ প্রনেতা ইবনে আবু শায়বা আল মানার তাফসীর লেখক জায়দীয়া জুহরী ও ইবনে সিরিন হযরত উমরের ঘটনা থেকে অমুসলিমদের যাকাত দেয়া বৈধ বলেছেন।

১. হানাফী আলিমগন বলেছেন ফকীর মিসকিনের মধ্যে মুসলিম অমুসলিম পার্থক্য করা হয়নি। হযরত উমর , জুহরী , ইবনে সিরিন , ইকরামা জায়িদ ইবনে জায়দ ও জুফার থেকে যা বর্নিত হয়েছে উক্ত দলীল তার ও সাক্ষী।

অমুসলিম ফকীর মিসকীনকে দেয়া মুয়াল্লাফাতুল কুলুবিহিম এর মধ্যে অর্ন্তভূক্ত হবে।

মুসলিম সমাজে অমুসলিমরা দারিদ্র্যের কষাঘাতে তিলতিল করে মরবে তা মেনে নেয়া যায় না।

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীজ তার বাওরার উপর নিযুক্ত প্রশাসককে জিম্মিদের (অমুসলিম) মধ্যে থেকে যাদের বয়স বেশী ও দুর্বল জিম্মিদের বায়তুলমাল হতে অর্থ দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

যাদের যাকাত দেয়া বৈধ নয়ঃ

পিতামাতা স্ত্রীকে যাকাত দেয়া বৈধ নয়।

ইবাদাতে লিপ্ত ব্যক্তি যাকাত পাবেনা।

কি পরিমান যাকাত দিতে হবে?

হযরত উমর বলেছেন "ইজা আ'তাইতুম ফাগনাও"। যখন দিবে ধনী করে দিবে।

একবছরের জন্যে যথেষ্ট পরিমান করে দেয়া যেতে পারে।(ইমাম গাযযালী ইয়াহ উল উলুম) বিয়ে করিয়ে দেয়া যথেষ্ট পরিমানের অর্ন্তভূক্ত হবে।

বই পত্র দান যাকাতের অর্ন্তভূক্ত হবে।

উপযুক্ত মানের জীবিকা ও স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

মুয়াল্লাফাতুল কুলুব???

অমুসলিমকে যাকাত দানের আরো উদাহরন:

১. সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া কে মক্কা বিজয়ের দিন নিরাপত্তা দিয়েছিলেন রাসুল সঃ। রাসুলের সঃ দেয়া ৪ মাস সময় উপেক্ষা করে সে পালিয়ে যায় ।পরে হুনাইন যুদ্ধে ইসলাম গ্রহন না করেও সে রাসুল সঃ এর সাথে যোগ দেয়।

মুসলিম ও তিরমীযি ইবনুল মুসাইয়েব সুত্রে বর্ননা করেছেন সাফওয়ান বলেছে যে নবী সঃ তার কাছে ঘৃন্য ব্যক্তি ছিল। রাসুলের ক্রমাগত দানে তিনি রাসুল কে ভালবেসে ফেলেন। পরে এই লোকটি ইসলাম কবুল করে।

২.কাফির দুস্কৃতিকারীর ভয় থেকে বাচার জন্যে কনভিন্স করার জন্যে জাকাত দেয়া যাবে।

৩.নতুন ইসলাম গ্রহন কারী লোকেরা যাকাত পাবে।

৪. মুসলিম নেতৃস্থানীয়দের কনভিন্স রাখার জন্যে যাকাত দেয়া যাবে। হযরত আবু বকর আদী ইবনে হাতেম ও জারকার ইবনে বদরকে অনেক বায়তুলমাল থেকে অনেক উপটৌকন দিয়েছিলেন।

৫.দুর্বল ঈমানদারদের যাকাত দেয়া যাবে।

৬. কাতাদাহ বলেছেন 'মুয়াল্লাফাতুল কুলুবিহিম' মানে মরু বেদুইন। এদের অনেকেই রাসুলের দানে ইসলামের পথে চলে আসে।

রাসুলের মৃত্যুর পর মুয়াল্লাফাতুল কুলুব মানসুখ হয়নি।

ইমাম আহমদ , ইমাম জুহরী, আবু জাফর আল বাকের ও জাফরী ও জায়দীয়া মাযহাব বলেছে এটা মানসুখ হয়নি।

কুরতুবী ও মালিকী মাযহাব এর কাযী আবদুল ওহাব বলেছেন দরকার থাকলে দাও।

কাযী ইবনুল আরাবী বলেছেন দেয়া যাবেনা।

নাইল কিতাবে এবং তার শরাহ গ্রন্থে আবাজিয়া ফিকাহর মত লিখিত আছে । এই খাতটি পরিত্যক্ত নয়। ইসলামী রাষ্টকর্তা মনে করলে দিবে। আমের আশশাবী বলেছেন এটা রাসুলের যুগে ছিল এখন নাই।

ইমাম নববী ও ইমাম শাফেয়ী বলেছেন ফাই(রাষ্টের অন্য আয়) থেকে দিতে।

খলীল নামক গ্রন্থ, ইবনে হুবাইব বলেছেন মানসুখ হয়নি। হানাফী ফকীহরা বলেছেন মানসুখ হয়েছে।

হানাফীদের উত্তরে বলা যায় 'খবরে ওয়াহিদ' কুরআনের আয়াত মানসুখ (রদ) করতে পারেনা।

প্রথম ও ২য় খাতঃ ফকীর মিসকীন। অনেকেই বলেছেন যারা নিঃস্ব তারা মিসকিন আর যাদের কাছে কিছু আছে তারা গরীব। কেহ তার উল্টোও বলেছেন।

শেষ কথাঃ

যাকাত দারিদ্র্যতা বিমোচনের স্থায়ী কৌশলপত্র। এটা গ্রহন করে আমরা অতি দ্রুত দারিদ্র্যতা মুক্ত সমাজ গঠন করতে পারি। বস্তুত সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানে যাকাত কার্যকর পন্থা। সমাজের নিম্মস্তরে যাকাতের মাধ্যমে 'মানি ফ্লো' করে আমরা প্রোডাকশানকে উৎসাহিত করতে পারি। যা দেশের জিডিপি উন্নয়নে সহায়তা করবে। সমৃদ্ধ শালী বাংলাদেশ গঠনের জন্যে যাকাত ব্যবস্থার মধ্যে দারুন এক শক্তি লুকায়িত আছে।

তাই আমাদেরকে সুরা মুমীনুন এর আয়াত "ওয়াল্লাজিনাহুম লিজ্জাকাতি ফা'য়িলুন। যাকাতের মাধ্যমে (পবিত্রতা ও বৃদ্ধির ) কর্মতৎপর থাকতে হবে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

241492
০৪ জুলাই ২০১৪ রাত ০৪:২০
ভিশু লিখেছেন : মাশাআল্লাহ! যাকাতের ওপর সংক্ষিপ্ত তবে মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক এবং সম্ভাব্য সামাজিক ফলাফল সমৃদ্ধ পোস্ট! খুব সুন্দর আবেদন! দরকার সার্বজনীন অনুভূতির জাগরণ এবং বাস্তবায়ন! জাযাকাল্লাহ খাইরান...Praying Happy Good Luck Rose
241494
০৪ জুলাই ২০১৪ রাত ০৪:২২
খেলাঘর বাধঁতে এসেছি লিখেছেন : "যাকাত:দারিদ্র্যতা বিমোচনের স্থায়ী কৌশলপত্র"

যাকাত দিয়ে পৃথিবীর কোনকোন মুসলিম দেশ দরিদ্র বিমোচন করতে সক্ষম হয়েছে, বলেন তো শুনি?
০৪ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৭:১৯
187532
লোকমান বিন ইউসুপ লিখেছেন : যাকাত সিস্টেম চালু নেই। প্রপার ম্যানেজমেন্টও নেই।
241515
০৪ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৫:৫১
সন্ধাতারা লিখেছেন : Masha Allah very valuable post bhaiya. Jajakalla khairan.
241758
০৪ জুলাই ২০১৪ রাত ১১:৪২
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : আমাদের দেশে সম্পদ অবৈধভাবে করা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে। ব্যালেন্স নেই দেখেই ধনী-গরীবের বৈষম্য এত বেশী! কিছুদিন আগে আমাদের এখানকার একটা নিউজপেপারে পড়েছিলাম বাংলাদেশে ধনীরা কর দেয় ৩০% আর দরিদ্ররা দেয় ৭০%। অথচ কানাডায় যার আয় যত বেশী তাকে তত বেশী ট্যাক্স দিতে হয়। এই ট্যাক্স দিয়েই ফ্রি চিকিৎসা, ওল্ড হোম, বাচ্চাদের স্কুলে ফ্রি এডুকেশনের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেশে ধনীরা কর ফাঁকি না দিলে আর ঠিকমত যাকাত আদায় করলে ধনী-গরীবের এত বৈষম্য থাকতোনা।

রামাদান মুবারাক। ধন্যবাদ আপনাকে Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File