থানা হাজতে অছি প্রদীপ কুমারের লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী। (চট্টগ্রাম মহানগরী শিবির সদস্য সাব্বির ভাইয়ের কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন লোকমান বিন ইউসুপ ১৪ নভেম্বর, ২০১৩, ১২:৪৭:০৯ দুপুর
পর্ব 1: দাঁত মুখ খিঁচে চোখ বন্ধ করে প্রস্তুত হয়ে আছি। এই প্রস্তুতি গুলি খাওয়ার প্রস্তুতি। ডুশ করে একটা শব্দ হলো, আর আমার মনে হলো কিছু একটা জিনিশ যেন আমার ডান পায়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। চোখ খুললাম, দেখলাম, আমার ডান উরুতে প্যন্ট ছিড়ে পতাকার মত উড়ছে আর গলগল করে লাল গরম রক্ত বের হচ্ছে।
এর আগে চারদিকে যখন পুলিশ ঘিরে ফেলে তখন উপায়ন্তর না দেখে একটি মসজিদে আশ্রয় নিলাম, মসজিদ থেকেই ওসি প্রদীপ কুমার দাস আমাকে ধরে ফেলে। তারপর মসজিদ থেকে বের করে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দিতে থাকে, গুলি করব.. গুলি করবো...
আমি ভাবলাম এত লোকের সামনে নিশ্চয় গুলি করবে না। কিন্তু যখন ঠিক মাথার এক ইঞ্চি উপর দিয়ে একটা ফাঁকা ফায়ার করে, বুলেটের বাতাসে যখন চুল উড়ছিলো, তখনি বুঝলাম এই লোকের বিশ্বাস নেই.. গুলি সে করে ফেলতেই পারে....
............ চলবে..............
পর্বঃ ২
মাথায় গুলি ঠেকিয়ে আছে.... ভাবছি এই মুহুর্তে গুলি করলে কি হবে......।। আবার ভাবছি, না, মনে হয় গুলি করবে না। আচ্ছা গুলি করলে তো মারা যাব... এটা চিন্তা করতেই কালেমা পড়ে নিলাম।। ঠিক তখনই পিস্তলটি মাথা থেকে নেমে আসল পায়ে, তখন বুঝলাম গুলি এবার করবেই।
এবার চিন্তা আসলো, পায়ে গুলি করলে কি অবস্থা হবে? তখন মনে পড়লো ২৮ শে অক্টোবর ছাত্রলীগের গুলি লেগেছে আমাদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. রেজাউল করিম ভাইয়ের পায়ে। তখন তিনি তার সাক্ষাতকারে বলেছেন, তার পায়ের অবস্থা হয়েছে চাকা পাংচার হওয়ার মত। গুলি লাগার সাথে সাথেই তিনি পড়ে যান।
এত সব চিন্তা করছি অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। ইতিমধ্যে আমার ডান পায়ে গুলি করা হয়ে গেছে। আমি সামান্যতম ব্যথাও পেলাম না। তাই কোন চিৎকারও করি নি। আমার কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে পেছনে থাকা অন্যান্য পুলিশ সদস্য প্রদীপকে বলছে... স্যার গুলি লাগে নি, লাগে নি, আরেকটা করেন।
এবার আর প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাই নি, চোখের সামনে পিস্তল আবার অগ্নি উদগিরন করলো, এবারের টার্গেট বাম উরু। আবারো সেই অনুভূতি... কিছু একটা যেন ঢুকে গিয়েছে বাম পায়ে। আমি দু’পা দিয়েই মাটি ঠুকে দেখি আমার পা সম্পূর্ণ ঠিক....
প্রদীপ আমাকে ধাক্কা দিয়ে তিন জন দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের কাছে দিয়ে দেয়। শুরু হয় ক্রমাগত লাথি, কিল ঘুষি.... হঠাৎ এক অমানুষিক চিৎকার শুনে পেছনে তাকাই, দেখি ......
পর্বঃ ৩
দেখলাম থেঁতলে যাওয়া একটা পা নলার মাঝখান থেকে ঝুলছে .... লাঠির ক্রমাগত আঘাতে পা’টি ভেঙ্গে গিয়েছে।। অনেকদিন পর জানতে পারলাম সেই ভাইটির নাম ছিল ইসমাইল রাসেল।
আমাকে দু’জন কলার চেপে ধরে আছে.... আর ৭-৮ জন বিরতিহীন লাথি দিচ্ছিল..... প্রথম দু’ একটা লাগলেও পরেরগুলো তেমন কোন কঠিনভাবে অনুভূত হয়নি....
হঠাত দেখি একজন পুলিশ আমার দিকে দৌড়ে আসছে.... তার হাতে ছিল একটা রাইফেল... প্রবল গর্জন আর গালিগালাজ করতে করতে আসছিল... আমি মাথা ঘুরিয়ে নেওয়ার সাথে সাথেই মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেলাম।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো.... লুটিয়ে পড়লাম রাস্তায়... থেতলে গিয়েছে মাথার পেছনের অংশ.... আমি পড়ে যাওয়াতে তাদের আমাকে মারার ক্ষেত্রে আরো সুবিধে হল... আমি রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম.........
রক্তের নোনতা স্বাদ পেলাম......... সাথে সাথে রঞ্জিত হয়ে গেলো আমার সাদা শার্ট টি.......
.....চলবে......
পর্বঃ ৪
রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে খেতেই দেখলাম, একটা বাচ্ছা ছেলেকে ওরা ঐ মসজিদ থেকে বের করছে, সে কোনভাবেই পুলিশের কাছে ধরা দিতে রাজি নয়......... ধস্তাধস্তি করতে থাকে..... এক পর্যায়ে সে তাদের হাত থেকে ছুটে যায়.... এবং পালানোর চেষ্টা করে।। কিন্তু ব্যর্থ সে চেষ্টা.... একজন লাঠি দিয়ে মারে .... অন্য আরেকজন তাকে ঠেকিয়ে গুলি করে.... ।। সেই ছেলেটির নাম ছিল তানজিম আল হাসান।।
সামনেই থানা ছিল..... রাস্তা থেকে আমাকে উঠিয়ে আবার নিয়ে চললো..... থানা তে ঢুকিয়ে ডিউটি অফিসারের কক্ষে আনলো। আমি ছিলাম গ্রেফতারকৃত প্রথম ব্যক্তি.... আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হলেও প্রচন্ড অবসাদে না দাঁড়াতে পেরে বসে পড়লাম..... কেন বসলাম, এই অপরাধে শুরু হল মার...যাই হোক শত মারেও আমি আর ঊঠি নি.... আসলে উঠার সামর্থও ছিল না....।।
এরপর একে একে অনেক লোক কে মারতে মারতে থানায় নিয়ে আসছে.... মারতেছে.... আর তাদের চিৎকার সব মিলে এক বিভীষিকাময় অবস্থা.... আমাদের সব ভাই একত্রে গোল করে বসিয়ে মারতে থাকে.... ওরা একেকজন মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে আরেকজন শুরু করে..... এভাবেই চলতে থাকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মত.....
আমার ততক্ষনে অবস্থা কেরোসিন..... আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি.... এই অবস্থায়ই আমি বাম হাত পকেটে কায়দা করে ঢুকিয়ে মেসেজ টাইপ করে পাঠিয়ে দেই আমার আপু আর আব্বুর মোবাইলে..... কি লেখেছি, আর কাকে পাঠিয়েছি... এটা আমার দেখা হয় নি.....।। কিন্তু পরে জানতে পারলাম কোন বানানই ভুল হয় নি... যাই হোক আমি পকেট থেকে হাত বের করার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের সব মোবাইল নিয়ে গেলো.... আমি ততক্ষনে শিওর না, আমি খবর পাঠাতে পেরেছি কি না.......
আমাদের মারছে এই সময় হঠাত খট করে একটি শব্দ হয়ে একজনের কনুই ভেঙ্গে যায়...... ঝরঝর করে রক্ত পড়তে থাকে..... এতে টনক নড়ে পুলিশদের....।। তাদের মধ্যে প্রস্তুতি দেখা যায় আমাদের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য..... মার বন্ধ হয়.... আর হাত ভাঙ্গা ঐ ভাইটিকে একটি গামছা দিয়ে বেঁধে দেয় একজন পুলিশ...।। পরে জানতে পারি ঐ ভাইটির নাম ছিল কবির হোসেন....।।
গাড়ি রেডী.... এখানে আমরা তিন জনের অবস্থা বেশী খারাপ..... আমি, তানজিম, আর কবির এই তিনজন কে হসপিটালে নেয়া হবে.... আমাদের বলা হল বের হতে... তানজিম এবং কবির উঠে চলে গেলো.... আমি শোয়া থেকে উঠে বসেছি..... কিন্তু ততক্ষনে আমার দু’টো পা’ই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়...।। উঠব কি? আমি পা এক ইঞ্চিও নাড়াতে পারছি না...।। আমি উঠছিনা দেখে একজন গালি দিতে থাকে... আমি অসহায় ভাবে বললাম আমি পা দুটো নাড়াতেই পারছি না....
কিন্তু সে আমার কথা বিশ্বাস করে নি...... আমি যেখানে বসা ছিলাম সেটা টাইলস করা ছিল... এবং আমার পা থেকে বের হওয়া রক্তে প্লাবিত ছিল......।। ঐ পুলিশ সদস্য আমাকে পেছন থেকে জোরে লাথি মারে.....।। রক্তে ভেজা থাকার কারনে আমি স্লিপ করে সাত আট হাত সামনে চলে যাই.... তারপর একজন এসে আমার পায়ের কেডস খুলে দেয় ......।। আর তিনজন মিলে আমাকে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তুলে দেয়.....।।
..........চলবে......... ।।@ Md Nomanul Ahasan
পর্বঃ ৫
হাসপাতালে পৌঁছার সাথে সাথে প্রচুর সাংবাদিক আমাদের ঘিরে ধরলো।। ক্যমেরার ফ্ল্যাশ ও ক্লিক ক্লিক শব্দের মধ্যেই আমাদের স্ট্রেচারে তোলা হল..... সেখানে শুয়ে আমি সাংবাদিকদের ঘটনার বর্ননা করতে থাকি.... আমি প্রথম চিন্তা করেছিলাম নিজের সঠিক পরিচয় সাংবাদিকদের দেব না..... পরে চিন্তা করলাম আমি তো জানি না আমার খবর ফ্যমিলির লোকজন পেয়েছে কি না...... তারপর তাদের আমি আমার পরিচয় দেই...।
ইতিমধ্যে ডাক্তার নার্স ও পুলিশ সকল সাংবাদিকদের ঠেলে আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন... ডাক্তার বললেন এই একটা ব্লেড নিন... ব্লেড নিন.....।। এই প্রথম আমি ভয় পেতে শুরু করেছি......।। আমি ভেবেছি ব্লেড দিয়ে কেটে আমার পা থেকে বুলেট বের করা হবে..... ব্লেড আসলো.... মোড়ক খোলা হল.....।।
আমার আর সহ্য হচ্ছে না একদিকে ভীষন পেইন, অন্যদিকে ব্লেডের ভয় সব মিলে মনে মনে আল্লাহকে এমন ভাবে ডাকছি..... মনে হচ্ছিল স্বয়ং আল্লাহ এখনি বুঝি নেমে আসবেন....।। ডাক্তারের কথা কানে আসলো... তিনি নার্স কে বলছেন...... এই খুব সাবধানে ওর পায়ে যেন না লাগে। তখন বুঝলাম এই ব্লেড দিয়ে আমার প্যান্ট কাটা হবে পা নয়। দু’টো পায়ে ব্যন্ডেজ করা হল.... মাথায় হালকা ড্রেসিং করা হল......।।
প্রচন্ড অবসাদে ও রক্তক্ষরণে পুরো শরীর কাঁপছে। এই সময়ে একজন দাড়িপাকা লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখলেন......।। এটা যেন ছিল শান্তির পরশ। মোবাইল বের করে বললেন বাসার নাম্বার বলেন। আমি আমার বোনের নাম্বার বললাম, কল করেই আমার কানের পাশে ধরলেন। আপু রিসিভ করার পর আমি বললাম....... আমি সাব্বির, আপু বললো তুই এখন কই? আমি বললাম আমার পায়ে গুলি লেগেছে আমি এখন CMC তে। আল্লাহ হাফেয.....।।
পাগুলো তো আগেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে....।। এখন হাত গুলোও কেমন যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে.... থরথর করে কাঁপছি.....।। আমার মনে হচ্ছিল আমি কাঁপতে কাঁপতে স্ট্রেচার থেকে পড়ে যাব।। ডাক্তার কে কাছে পেয়ে বললাম খুব ব্যথা হচ্ছে.........।। ঊনি বললেন হ্যাঁ হ্যাঁ এখুনি ঠিক হয়ে যাবে.......।। কিছুক্ষণ পর এসে আমার দু বাহুতে ইঞ্জেকশন দিলেন......।। এবং বললেন আপনার বাসায় খবর দিন......।। আপনার রক্ত লাগবে দু ব্যাগ.........।। আপনার অপারেশন করতে হবে......।।
সাথে সাথে ঐ লোকটি হাজির তিনি আবার আপুর নাম্বারে কল দিলেন....।। আপুর সাথে কথা বলতেই দেখলাম আমার দু বোন হাসপাতালের করিডোরে......।। ডাক্তার বলতেই আপু চিৎকার করে বলতে থাকে আমার B+ তারও B+........ আমি দেব...... আমি দেব.......।।
...........চলবে...........
পর্বঃ ৬
পেইন কিলার দেয়ার পর অনেকটাই স্বাভাবিক হতে শুরু করছি।। আমাকে স্যলাইন দেয়ার হাতে ক্যনুলা লাগাবে..... কিন্তু আমার শিরা খুঁজে পাওয়াটা বেশ দুষ্কর। হাত দুটো ফুলে ঢোল হয়ে আছে......।। যাই হোক আঙ্গুলের কাছাকাছি অবস্থানে ক্যনুলা সেট করা হল। আমাকে একটা বেডে ট্রান্সফার করা হল। ইতিমধ্যে কাপড় চেঞ্জ করলাম...।। মোটামুটি একটা ভালো অবস্থানে আসতে লাগলাম..... ।।
হটাত চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি জিয়া কে নিয়ে আসা হয়েছে......।। পা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে...।। ওর ঐ একটুখানি পা থেকে ছয় ছয়টি বুলেট বের করা হয়েছে.........।। পাশাপাশি তিনটা বেডে একটাতে আমি মাঝখানে তানজিম এরপর জিয়া......।।
এরমধ্যে জিয়া কান্না করছে দেখে তানজিম ওকে সান্তনা দিচ্ছে......।। তানজিমের ইন্টারনাল রক্তক্ষরন হচ্ছে প্রচুর......।। এর মধ্যে ওর কোন স্বজন তখনো আসে নি......।। আমাকে এক্স রে করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে......।। তিন তলায় নেবে......।। আমাকে হুইল চেয়ারে বসানো হয়েছে......।। একজন আয়া হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে......।। লিফটের সামনে এসে অপেক্ষা করছি......।। এইসময় দেখলাম গালিব, রহমত, রায়হান, মেহেদী দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে......।। তারা জানত না আমি কোথায়...... হটাত দেখা.......
আমার পাশে এসে দাড়ানোর জন্য এই কঠিন পরিস্থিতিতে চলে এসেছিল। সারা হাসপাতালে ডি.বি. পুলিশ গিজ গিজ করছে...।। এরই মধ্যে ওরা এসে গেছে আমাকে রক্ত দেয়ার জন্য। আমি ওদের কাছে কৃতজ্ঞ... এর মধ্যে হাসান রক্ত ব্যাগে নিয়ে ব্লাড ব্যাংকে জমা রেখেছে......।। আমি ওদের ঋণ কখনোই শোধ করতে পারবো না.........।।
এক্স রে রিপোর্ট পাওয়ার পর জানতে পারলাম আমার কোন হাড়ই ভাঙ্গে নি...।। তবে বাম হাঁটুর নিচে, ডান হাতে এবং বাম কাঁধে ফ্র্যাকচার দেখা গিয়েছে......।। বাম পায়ের গুলি একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে......।। ডান পায়ে বুলেট আছে ...... অপারেশন লাগবে.........।।
এই রিপোর্ট পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম যদিও থানা থেকে আসার সময়ে আমার অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর মনে হয়েছিলো, কিন্তু বাস্তবে তা নয়, এখন সবচাইতে বেটার পজিশনে আমি। তাই সিদ্ধান্ত হল আমার অপারেশন পরে হবে............।।
তানজিমের পাকস্থলিতে তিনটি বুলেট। ওর অপারেশন আগে হবে...।। কিন্তু শুরু করা যাচ্ছিল না ওর অভিভাবকের অভাবে......।। সন্ধ্যার পর ওর দুঃসম্পর্কের এক ফুফা আসলেন......।। ওর অপারেশন শুরু হল......।। টানা চার ঘন্টা অপারেশন করার পরও একটা বুলেট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পেট সেলাই করে দিয়ে আবার এক্সরে করা হল...।। আরেকটি বুলেট ধরা পড়লো ব্লাডারে......।। ব্লাডার ফেটে গিয়েছে......।। অবস্থা খুব সঙ্গিন...।।
সকালে তার জ্ঞান ফিরেছে... তাকে আবার ও টি তে নেয়া হয়েছে......।। ডাক্তার তার কানের কাছে বললেন তোমাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না তোমার কিছু বলার থাকলে বল.........।। সে বললো, আমাকে পুলিশ অন্যায়ভাবে গুলি করেছে, আমি এখন মারা গেলে আমি শহীদ হয়ে যাব...।। এই কথাটা সে একবার নয় বারবার বলেছিল......।। শুধু ডাক্তার নয়...... নার্স পুলিশসহ সবাইকে খুব নাড়া দিয়েছে কথাটা.....
...........চলবে.........।।
পর্বঃ ৭
আমার জীবনে না পাওয়ার বেদনা ছিল না বললেই চলে......।। যখন যা চেয়েছি তখনই তাই পেয়েছি...।। খুব ছোটবেলা থেকেই সংগঠন করি বলে দলীয় সাপোর্ট টাও সবসময় পেতাম......।। নিজেকে অসহায় মনে হওয়া তো দূরের কথা ধরা কে সরা জ্ঞান করতাম সবসময়.........।। এই ঘটনাটি ঘটার পর বুঝতে পারলাম মহান আল্লাহ তায়ালা কত অল্প সময়েই কত অসহায় করে তুলতে পারেন......।। এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি...।।
আমার তখন এই অবস্থা একজন সার্বক্ষনিক সহযোগী না থাকলে আমার চলে না। আমার টয়লেট, খাওয়া দাওয়া কাপড় পাল্টানো সব কিছুতেই আরেকজনের সহযোগিতা নিতে হয়। রাত ১০ টার দিকে প্রদীপ হাসপাতালে আসে আমাদের নাম ঠিকানা ইত্যাদি নেয়ার জন্যে...।। জিয়া কোনভাবেই স্বীকার করছিল না সে যে শিবির করে......।। এই অসুস্থ অবস্থায় তাকে বার বার জেরা করতে থাকে.........।। এরপর তার বড়ভাই পরিচয় দেয়া সংগঠনের এক সাথী কে একপাশে নিয়ে যায়.........।।
আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ি....... একেও কি এরেস্ট করবে ......? তারপর দেখলাম তার কানে কানে কি যেন বুঝাচ্ছে......।। পরে যেটা জানতে পারলাম সে বললো,... তোমার ছোট ভাই কে বল সে যে শিবির করে এটা বলতে......... সে যদি শিবিরের সাথী হয় তাহলে তার জন্য স্পেশাল সুবিধে আছে... ইত্যাদি ইত্যাদি... যাই হোক সেদিন জিয়া কে কোনভাবেই স্বীকার করানো যায় নি...।।
আমার কাছে যখন আসে আমি অকপটে স্বীকার করি......। এবং বলি এটা আমার অধিকার...।। সে আমাদের সবার অনেক ছবি তোলে......এবং আমাদের ইনফরমেশন গুলো নিয়ে চলে যায়.........।। সেই রাতে আমার পাশে সারা সময় ছিলেন আমার ভগ্নিপতি হারুন ভাই...।। উনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা... সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়ার সুযোগ পান নি...... ওখান থেকে আবার কর্মস্থলে যেতে হয়েছে......
আমার অপারেশন হবে দুপুর দু’টোয়। গতকাল আমার হাতে যেখানে ক্যনুলা লাগানো হয়েছে সেটাতে আর কাজ হচ্ছিল না। ও টি তে নেয়ার পর অনেকক্ষন লেগেছে আমার হাতের শিরা খুঁজে পেতে। ডাঃ কিবরিয়া শেষ পর্যন্ত সফল হন অনেক চেষ্টার পর। ডাক্তাররা আমার ব্লাড প্রেশার সহ নানান বিষয় চেক করে জানালেন...... আমাকে লোকাল এনেস্থেসিয়া করা হবে......... আমি কয়েকবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি...।। কিন্তু আমার প্রতিবাদ ধোপে টিকে নি......।। আমি বার বার বলেছিলাম, আমাকে টোটাল এনেস্থেসিয়া করা হোক।
তারা বললেন একটু সহ্য কর, কোন অসুবিধা হবে না......।। অপারেশন শুরু হল......। আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি...... যন্ত্রনা হচ্ছিল...... আল্লাহকে এখন আর গোপনে নয়, প্রকাশ্যে ডাকতে থাকি...... ডাক্তাররা আমাকে বারবার সবর করার জন্য বলছিলেন......... কয়েকজন ডাক্তার বিশেষ করে ডাঃ কামাল ও ডাঃ কিবরিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন.........।। একজন আমার হাত ধরেছিলেন......... এটা কে ছিলেন আমি জানি না তবে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছি...... আর তিনি আমাকে হাত ধরে তুলছেন.........।।
সম্ভবত আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল...... তাই এক পর্যায়ে আমার মুখে অক্সিজেনের মাস্ক পরিয়ে দেয়া হল...... উফ... এত ভালো লাগছিলো, এত আরাম লাগছিলো...... অসাধারণ ফিলিংস......।। ঠিক কিছুক্ষন পরই সবাই দেখি হাততালি দিচ্ছে...।। আমি বুঝলাম না কি হয়েছে......।। ঐখানে যিনি প্রধান ডাক্তার ছিলেন তার নাম আমার এখন মনে নেই, তিনি গ্লাভস পরা হাতে বুলেট টি নিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললেন এই হচ্ছে তোমার বুলেট...... কাজ শেষ। তখন আমি বুঝলাম অপারেশন সাকসেসফুল। এরপর আমাকে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়। আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই।
আফসোসের বিষয় ঐ দিন আসর নামাযটি আমার কাযা হয়ে যায়......।।
.........চলবে............
পর্বঃ ৮
অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে আনা হল সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে। শরীর খুব দূর্বল। বেডের পাশে অনেক আত্মীয় স্বজনের পাশে শাহীন ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম...।। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দন শেষে আমাকে বললো, ভাই খারাপ খবর আছে। তানভীর ভাই, গালিব ভাই, মিশকাত ভাই এবং মেহেদী ভাইকে পুলিশ নিয়ে গেছে....।।
গতকাল অলংকারে ইমরান ভাই এবং দেওয়ান হাটে আবিদ ভাই শহীদ হন। তাদের এই হাসপাতালেই আনা হয়েছিল কিন্তু আমি দেখি নি। আমার ভগ্নিপতি হারুন ভাই তাদের খবর আমাকে দিচ্ছিলেন। তাদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দানে। সেখানে যাওয়ার সময় বহদ্দারহাট থেকে সবাই গ্রেফতার হয়। খুব হতাশা অনূভব করলাম, আমি তো আগেই এরেস্ট, এখন সাংগঠনিক সম্পাদক সহ চারজন দায়িত্বশীলের গ্রেফতারের খবরে বেশ মুষড়ে পড়লাম।
খুব খারাপ লাগলো গালিব কালকে আমার পাশে ছিল..... ।। এর কিছুক্ষন পরই শুনলাম আমাদের BBA Dept. এর প্রফেসর মাহবুব স্যারের ছোট ভাই আহমদ উল্লাহ গুরুতর আহত। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। স্যার তার ভাই কে দেখতে এসে যখন আমার কথা শুনলেন তখন আমার বেডের পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্যার কে বললাম স্যার আমি ভালো, আহমদ উল্লাহ্র কি অবস্থা ? ওর বুকে গুলি লাগে, ফুসফুসে ব্যপক ক্ষতি হয়। কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে............।।
এই আহমদ উল্লাহ পাঞ্জেরির নিয়মিত শিল্পী। ওর সুন্দর গানের কারণে আমরা আমাদের যে কোন বড় প্রোগ্রামে তাকে নিয়ে আসি। আমাকে শাহীন ভাই জানালো সে গলায় কোন সাউন্ডই করতে পারে না। ফিসফিস করে কথা বলে। ডাক্তার বলেছে, ওকে বাঁচতে পারলেও কথা হয়তো সে আর আগের মত বলতে পারবে না। খুব খারাপ লাগে, যে গলায় এত সুন্দর গান গাইতো সে গলা এখন স্তব্ধ......।। আগামী পর্বে তার গ্রেফতার হওয়ার কথা বলবো......।। ইনশাল্লাহ.........।।
ও.. একটা বিষয় বাদ পড়েছে তা হল আমার বাবা মায়ের প্রতিক্রিয়া...... আমার বোনেরা যখন প্রথম আসলো তখন তারা আব্বুকে ফোন দেয়। আমার অবস্থা জানায়, এবং আমার সাথে কথা বলতে বলে। এখানে অনেকে আছেন যারা আমার বাবা কে চিনেন......।। খুব কঠোর এবং নিয়মতান্ত্রিক মানুষ...।। আমি ততক্ষন পর্যন্ত মানসিকভাবে খুব স্বাভাবিক ছিলাম, আব্বু বলে খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না ? আমি বলি না আব্বু আমার তেমন কোন অনুভূতিই হচ্ছে না। তিনি তারপর বললেন আমি তো তোমার অনেক আগ থেকেই আন্দোলন করি আল্লাহ আমাকে কবুল করে নি...।। তোমার রক্ত আল্লাহ কবুল করেছে, তোমার রক্ত আল্লাহ কবুল করেছে..... এই কথা বারবার বলেন আর খুব কাঁদতে থাকেন।
আমি অবাক হই। আম্মু আব্বুর থেকে মোবাইল নিয়ে নেন, জিজ্ঞাসা করেন বাবা তোর কি অবস্থা? আমি বললাম হু, ভালো। আমি প্রানপনে নিজের কন্ঠকে ধরে রাখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আব্বুর ভেঙ্গে পড়া দেখে আমার কন্ঠ আর্দ্র হয়ে আসলো। আম্মু আমাকে সান্তনা দিতে লাগলেন এবং বারবার বলতে লাগলেন কোন সমস্যা হবে না, কোন সমস্যা হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে......ইত্যাদি। আমি আর কোন কথা বলতে পারি নি..................।।
.......চলবে.......
বিষয়: বিবিধ
২৮৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন