আমরা ভুলে যাই
লিখেছেন লিখেছেন লাল বৃত্ত ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২, ০৯:০১:৫৩ রাত
সুনসান নীরব নদীতে গুড়ি গুড়ি ঢেউ জাহাজের পাটাতনে আছড়ে পড়ছিল, সাথে কিছু চিপসের কিংবা চানাচুরের প্যাকেট ও সাদা কাগজের বাদামের ঠোঙ্গা। দূরে বহুদূরে মিটমিট করা কিছু হলুদ আলো কালো আলকাতরার মত নিশ্চুপ অন্ধকারের গায় লেগে লেগে ছিল। মনে হল সেগুলো নদীর ও-ই পাড়ের কোন হাট বাজার। রাত ৮টার বেশী কোন ক্রমেই বাজতে পারেনি। জাহাজের ডেকে ঢাকা মেডিক্যালের বারান্দার মত শুয়ে আছি অন্যান্য যাত্রীদের পাশে নিজের বিছানাটা বিছিয়ে। মাথার ওদিকটা ৪হাত দূরে ৪জন বসে কার্ড খেলছে, বুক থেকে ২ হাত উপরে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নিকোটিন। টিভিটায় বিরক্তিকর প্রচণ্ড শব্দে মুনমুন কিবা ময়ূরীর সাথে মিশা সওদাগরের আদিম লীলার আওয়াজ হচ্ছে। বারবার হাতের বইটার দিকে মনটাকে শক্ত করে টেনে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়।
পায়ের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র পায়ের আঘাতে চমকে উঠি। একেবারে দুধের শিশু, আউল আউল কি সব বেহেসতী ভাষা বলছে আর ঠোট বেয়ে গড়িয়ে পড়া রহমতের আঠালো পানি টুপ করে আমার পায় এসে পড়ছে। ঠিক এই সময়েই আস্তে করে জাহাজটা এক দিকে কাঁত হয়ে যাবার উপক্রম হল। বাচ্চার মা বাচ্চাকে খপ করে টেনে ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললেন।
আকাশের সব তারাগুলো কালে মেঘের বিবর্ণ আস্তরণে ঢেকে গেছে অনেক আগেই। বাতাসে একটানা শো শো শব্দ, মনে হল লক্ষ লক্ষ সাপ তার জিহ্বা বের করে এক সাথে হিস হিস শব্দ তুলছে। দুরের আলোগুলো সব কোথায় চলে গেল? তীরের কোন নাম নিশানা নেই। ইয়া উঁচু উঁচু ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে জাহাজের গায়, বিশাল নদীতে নিজের অস্তিত্ত্বটা খুবই ক্ষীণ মনে হল। ছোটবেলায় সিন্দাবাদের জাহাজের ঝড়ে পড়ার দৃশ্য দেখে আমাদের ঐ প্ল্যলেস্তার খসে পড়া মফস্বলের দু রুমের বাসার বাথরুমে বড় গামলা পানিতে পূর্ণ করে প্লাস্টিকের বাটি বসিয়ে নিচের পানিতে হাত দিয়ে হেব্বি জোড়ে নাড়া দিতাম। বাটিটা একবার এদিকে কাঁত হয়ে যেত আরেকবার ওদিকে কাঁত হয়ে যেত। বাটির ভেতরে থাকতো কোন ক্ষুদে অসহায় পিঁপড়া, যাকে সিন্দাবাদ কল্পনা করে বেশ আমোদিত হতাম। এখন মনে হয় আমিও ঠিক ঐ পিঁপড়ার মতই ক্ষুদ্র স্রষ্টার এই প্রলয়ে।
টিভিটা একটা নির্জীব বাক্সে পরিণত হল, ভেঙ্গে গেলো তাসের আসর, দিকে দিকে উৎকণ্ঠিত নারী পুরুষ উত্তেজিত আর ব্যকুল হয়ে বাঁচার রাস্তা দেখতে পাগল প্রায়। সবাই জোরে জোরে দোয়া-ইউনুস, দরুদ, আর স্রষ্টার নাম নিচ্ছে। আমিও বিড়বিড় করে স্রষ্টার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। এবার মাফ করে দিলে আর জীবনেও তোমার অবাধ্য হবোনা, এমনটাই ছিল। ঠিক তখন মনে পড়লো সেই আয়াত, যেখানে ঝড়ে বিধ্বস্ত জাহাজের লোকেরা বলেছিল এই মুসিবত থেকে উদ্ধার করলে তারা স্রষ্টার দেখানো পথেই চলবে, আর যখন তারা মুক্তি পেলো, ভুলে গেলো বিপদকালীন সংকল্প।
আনসাররা লাঠি হাতে ছুটে এলো, বিক্ষিপ্ত নারীপুরুষদেরকে মাঝখানে বসিয়ে দিচ্ছে, নয়তো ছুটোছুটির ফলে জাহাজ কাঁত হয়ে ডুবে যেতে পারে। ঢেউয়ের ঝাপটায় ভিজে চুপচুপ হয়ে গেছি, প্যান্ট বেয়ে বেয়ে পানি ঝরছে। বিছানা ব্যাগ সব ভিজে গেছে। ঠকঠক করে ভাইব্রেট করা মোবাইল ফোনের মত ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছি।
তাবলীগের একদল লোক জিকর শুরু করলেন, এবং একজন সু উচ্চ কণ্ঠে আজান শুরু করলেন। আজান শোনার সাথে সাথেই হয়ত সবার হৃদয়ে আবার মৃত্যু ভয়টা জেগে উঠেছে, উথাল পাথাল এই মাঝ-দরিয়ায় ঝড়ের শব্দ, নারীদের গোঙ্গানি, আর শিশুদের প্রচণ্ড চিৎকারের সাথে আজান মিলিয়ে এক অপার্থিব হাশরের শব্দ শুনছিলাম। তুমুল গতিতে সারেং জাহাজটাকে চালিয়ে যাচ্ছেন, গতি কমলেই বাতাস এক থাপ্পড়ে উলটে ফেলে দেবে, ওদিকে কোথাও কিনার দেখা যাচ্ছেনা। হৃৎপিণ্ড হাতুড়ী পেটা করছিল। মনের ক্যানভাসে পুরাতন সিনেমার মত ভেসে উঠছিল স্বজনদের মুখ। আর কোনদিন দেখা হবেনা তাদের সাথে, হাসিমুখে কত দিনরাত- ফিরবেনা এইসব আর।
সব কিছু শেষ হওয়ার মত করেই এক সময় থেমে যায় বাতাসের আক্রোশ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সবাই। এবং গতানুগতিক ভাবেই আমরা ভুলে যাই আমাদের বিপদকালীন তওবা এবং সংকল্পের কথা, নিমজ্জিত হই সীমাহীন অবাধ্যতায়।
আজ ফেইসবুকের একটি আলোবহনকারী গ্রুপে সন্ধ্যাবাতি আপুজির "আপনাদের কারো কি এমন কোন ঘটনা ঘটেছে যেখান থেকে বের হওয়ার পরে মনে হয়েছে যে আপনি ওই সময়ে মারা যেতে পারতেন? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি ওই ঘটনায় থাকা অবস্থায় মৃত্যু চিন্তা হয়েছে?" প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ঘটনাটি লিখলাম, ভাবলাম আপনাদের সাথেও শেয়ার করি।
ছবিঃ গুগল
"খুপরি থেকে"
বিষয়: সাহিত্য
১০৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন