জীবিতেরা সব চলে এসেছিলো মৃত্যু থেকে পালিয়ে, কিন্তু মৃতেরা?
লিখেছেন লিখেছেন লাল বৃত্ত ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০২:৫৫:২১ রাত
আমার রুমে ২টা তেলাপোকাকে আমি প্রায় সময়ই একই সাথে ঘুরাঘুরি করতে দেখি। একটা যদি বিছানায় তো অন্যটা বালিশে, একটা যদি বইয়ে আরেকটা খাতায়, একটা ফ্লোরে আরেকটা দেয়ালে, একটা এলসিডিতে আর অন্যটা তখন মাউসের আশে পাশে ঘুরাঘুরি করছে-মনে হয় সঙ্গী আর সঙ্গিনী। আমরা বর্তমান মানুষরা এর বেশী কিছু ভাবতে শিখিনি।
ওরা আমাকে বেশ ভালোবাসে। রুমের দরজা খুলে দিলে বেরিয়ে যায় আবার ফিরে আসে- ফিরে আসে। সন্ধ্যায় বসে লিখছি এমন সময় আমার হাতের আঙ্গুলে একটা তার সরু শুর দিয়ে শুরশুরি দিলো। আমি তাকালেই ঘুরে চলে যায়। ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে চোখ ঘসে ঘসে ওয়াশরুমের পথে যেতে যেতে হঠাৎ আবিষ্কার করি আমি ঠিক উলটো করিডোরে হাটি, ঘুরে ফিরি আবার ওপথে। হাতে পায় চোখে অজুর কোমল স্পর্শে আমি যেনো সকালের আকাশ চুইয়ে পড়া সুবহের শিশির।
পায় জ্বলা অনুভব করে দেখি ওরা আমার পায়ের আঙ্গুলের ডগার নরম চামড়া খেয়ে ফেলেছে। আমি বেশ উপভোগ করি। ইয়াল্লাহ!! বা হাতের বুড়ো আঙ্গুলের চামাড়াও লাল হয়ে আছে। ওদেরকে বিদেয় করে দেবো ভাবি। আবার ভাবি ওরা আমার কতটুকুই বা ক্ষতী করলো? আমরা মানব জাতি এর চেয়ে কত বেশী ক্ষতিকরদের সাথে বন্ধুত্ত্ব করি- আবার উপকারীদের সাথে করি শত্রুতা। বিচিত্র!!
পথে নামতেই বৃষ্টিও আমার সাথে পথ চলতে চায়। আনমনা হই- ভিজে যায় চটি জোড়া- ভিজে যায় বুকের ভেতরের বহুদিন ধরে শক্ত হতে থাকা দলা পাঁকানো শুকনো মাটি- কাঁদা হয়ে যায় নিমেষেই। আজকাল ওর কথা বেশ বক বক করি সবার কাছে, বুঝি সবাই বিরক্ত হয়, আবার বলি নাহ!! কিছু সৌন্দর্য হয়তো থেকেই যায় যেসব কখনোই মানুষকে ক্লান্ত করেনা।
ছিঁড়ে গেলো, মাত্র গতমাসেই কিনলাম। আজমপুরের ফুটপাথের যে সারি সারি দোকানগুলোতে ভির লেগে থাকে সাধারন মানুষদের ওখান থেকে ১৮০ টাকায় নেয়া। নাহ!! আজ ভার্সিটিতে যাবোনা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তার পানিতে গোড়ালী চুবিয়ে হাটবো। কেবল হাটবো, আর হাটবো। কোথাও হয়তো কাঁদা মাটি পায় আঠালো হয়ে ভালোবাসায় জড়াবে- আবার এক দলা জমে থাকা কিঞ্চিৎ ময়লা পানিতে পা টাকে এপাশ ওপাশ করে চুবিয়ে ঐ কাঁদাগুলোকে ঝেড়ে দেবো। জীবন থেকে কি এভাবে অন্ধকারকে ধুয়ে ফেলা যায়?
হাটতে গিয়ে বুঝলাম যতটা সহজ মনে হয়েছিলো ততটা সহজ নয়। বল্টু (বুড়ো আঙ্গুল আর অন্যান্য আঙ্গুল গুলোর মধ্যিখানে জুতোর পেটের সাথে যে সংযোগ) ছিঁড়ে গেলে হাটার সময় মানুষ শারিরীক চলমান বিষয়কে পুরপুরি উপেক্ষা করে যাচ্ছেতাই ভাবে হাটতে পারেনা। যার ফলে আমার পায়ের পাতাটাকে প্রতি কদমেই উঁচু করে রাখতে হচ্ছিলো। জুতোটা বারবারই খুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।
একটা ছেঁড়া জুতো পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাটার অনুভুতিগুলো অনেকটাই নদী ভাঙ্গা মানুষদের কাছাকাছি। তারা যেমন ধুয়ে যাওয়া অতীতের সকল সুখের কথা ভেবে অশ্রুর সমাবেশ ঘটায় তেমনি আমিও আমার ভেসে যাওয়া দুখের কথা ভেবে সুখাশ্রুর বিনিত প্রকাশে ভিজিয়ে দেই তোমাদের নিষ্ঠুর শহরের পিচ আর পাথর।
ওদেরকে আমি দেখেছিলাম ওখানে- যেখানে পায় এসে উন্মাতাল মেঘনার অবুঝ পানিগুলো আছড়ে পড়ে। তুলাতুলি। মহান পৃথিবীর এক নিভৃত কোনের কিছু দুঃখি মানুষের চোখে অতীতের বিবর্ণ স্মৃতির ধ্বংসাবশেষের কিছু ছায়া আমাকে সহ্য ক্ষমতার শেষ কোনো প্রান্তে এনে ছেড়ে দেয়- যেখানে বিশাল শুষ্ক মরুতে আমি হাতড়ে বেড়াই ভেজা কোনো আপনজনের আঁচল।
খালি পায় মাটিতে দাড়িয়ে আট বছরের শেফালী- ঐতো ঐখানে যে মাঝি নৌকোটাকে নিয়ে জাল মেরে মাছ ধরছে ওখানেই ছিলো বিশাল সুপারী বাগান। চিকন লম্বা লম্বা গাছগুলোর আড়ালে কত সুর্যে লুকোচুরি খেলা- কতো গোল্লাছুট আরো আরো কিছু জীবনের স্পর্শ। চালতার ভর্তা- গাবের ভর্তা—ঝাল ঝাল আহ!! পুঁইফল ভেঙ্গে হাতে রঙ মেখে কত বৌবৌ খেলা-খুব বেশি দিন হয়নি। মাত্র ৩৫দিন আগেও এখানেই ছিলো ওদের জীবনের সব গান। সবাই বলতো – আইতাছেরে সর্বনাশা মেঘনা। খাই খাই করে সব খেয়ে ফেল্লো- জামালদের ঘরটা যেদিন হুরমুর করে ভেঙ্গে গেলো সেদিন শেফালিদের বারান্দায় বসে সেই ভাঙ্গা ঘরের দিকে তাকিয়ে জামাল কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলো। চোখের সামনে- নাহ!! সে পারেনি তার খেলার সাথীকে সান্তনা দিতে। পারবে কি? তার ছোট্ট হৃৎপিন্ডটাও চেঁপে ছিলো অজানা বেদনার কিওক্রাডাং। ঠিক যেন বুঝে উঠছিলোনা কি কারনে নদী তাদের সাথে এমন করেছিলো। যতদুর মনে পড়ে একদিন একটা মোটা লাঠি দিয়ে নদীর পানিতে খুব জোড়ে কিছু আঘাত করেছিলো। বেশ মজা লাগছিলো। ছিটকে পানিগুলো দুপাশে ছড়িয়ে পরছিলো- খিলখিল হাসি আর আরো বেশি কিছু খুশির বাহার নিয়েই সে করেছিলো এসব। নদী কি এজন্যই জামালদের ঘর খেয়ে এর পর ওদের ঘর খেতে ধেয়ে আসছে? ও তো এর চেয়ে বড় কিছু ক্ষতি করেনি নদীর। বাল্য কিশোরীয় মনে কত আশংকা খেলা করছে।
এবারে ঈদে গিয়েছিলাম তুলাতুলি। কেবল সুখ কেনো? মানুষের দুঃখের সাথে নিজেকে মেশানোর কেবল একটা আকাংখাই তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার শহর থেকে মাত্র বিশটাকা রিকশা ভাড়া। মামীর নানুবাড়ী ভেঙ্গে যাবে। তারা সবাই ঘরদোর গুছিয়ে চলে আসছে নিরাপদে। নদীর আঘাতের প্রচণ্ডতা থেকে বাঁচাতে বিশাল বিশাল ব্লক দেয়া হয়েছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে রঙ করতে আসা ঈদের অতিথিদের হাসি মুখ দেখছিলাম। তারা সবাই নদীর তির ঘুরতে এসেছে। সুন্দরীরা কেউ কেউ হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। সেইসব কলকাকলী ছাপিয়ে আমার দৃষ্টি তখন পাড়ে দাঁড়ানো শেফালি আর তার দৃষ্টির শুন্যতায় ঘুরোঘুরি করছিলো। শেফালি ঘোলাটে চোখে চেয়ে আছে উত্তাল পনি ভরা নদীতে মিশে যাওয়া অতীতের সুখময় মায়ের বকুনি আর দুরন্ত কৈশরী ভাবনার মাটিগুলো মিশেছে এমন ঘোলাটে পানিতে।
লোকমান এখন কি করছে? ওর কি অবস্থা?
যখন ছোটবেলায় বেড়াতে আসি তখন ওকে দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। ও কেমন ছিলো সেটা জানতে ইউটিউবে মাউস ম্যান লিখে সার্চ দিলেই ওর মতো হাজার হাজার মানুষের ভিডিও চলে আসবে। ওর ছোট্ট মাথাটায় কদম ফুলের মতো শক্ত চুলগুলো দেখে দেখে ভাবতাম ওর ঐ চুলের ঠিক দু ইঞ্চি নিচে যে মগজটা আছে ওটা অপূর্ণ। অপুষ্ট। স্বজনদের সম্পর্কে তার অনুভুতিগুলো কেমন? শারিরিক ভাবে সে একজন মানবাকৃতির ই ছিলো। কিন্তু মাউসের মতো কিচির মিচির করে অদ্ভুত কোনো ভাষায় সে অবিরাম তার অভাব অভিযোগ গুলো বর্ণনা করে যেতো। হয়তো তার অন্য কোনো গ্রহে যাওয়ার কথা ছিলো। পথ ভুলে সে চলে এসেছিলো মানব পৃথিবীতে। আমাদের কেউ বুঝতোনা ওর সেই ভাষা। যখন পৃথিবীর কেউ তার জবাব দিচ্ছিলোনা ওর অজানা দূঃখ বোধ তাকে চেপে ধরতো বোধহয়। মাথাটাকে মাটির সাথে ঠকতে ঠুকতে কপালের উচ্চতায় কালো করে ফেলতো। একজনই হয়তো একজনই তাকে অকৃত্তিম ভালোবাসার আচলে জড়িয়ে রাখতেন। তার সকল ভাষাই যেনো চোখ দেখে পড়তে পারতেন। কখন তার ক্ষুধা লাগবে—আদর আর ভালোবাসায় খাইয়ে দিতেন জীবনের ভিষণ দূঃখময়ী মা।
অপরিশ্রমী পেশীহিন কোমল সেই রোমশ শরীরে সে জীবনটাকে বেশীদিন বইতে পারেনি। মানুষদের পুর্নাঙ্গ মানুষিকতার অপুর্নাঙ্গ ভালোবাসা নিয়ে সে একদিন বিদায় নেয়। ঢাকায় বসে শুনেছিলাম সেই সংবাদ। ভাবলাম যাক- ভালো থাকার কোনো এক জগতে সে চলে গেছে।
ওর কবরে অনেক সুখ। কিন্তু ওর কবরটা এখন কোথায়? পানি তো ওকে রেহাই দেয়নি। নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আমার সেই অশ্রু কেউ দেখেনি। আমি কেবল খুঁজে যাচ্ছিলাম- একটা কোনো চিহ্ন। কিন্তু তা থাকার কথা নয়। লোকমানের দেহের অবশিষ্টাংশ নিশ্চই মেঘনার ঘরে আপন করে ঠাঁই পেয়েছে। স্বজনদের অনেকেই হয়তো ভুলে গেছে। যাওয়ার সময় কেবল একজনেরই বুক কেঁপেছে। যার পেটে সে অনেকটা সময় আপন হয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। কত রঙ্গীন স্বপ্ন ছিলো অনাগত সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে- আকাশের মতো সেখানে সেই যুবতী বধু আশার স্বপ্ন উড়য়ে ছিলো। নীল যন্ত্রণা নিয়ে ছেড়েছিলো বসত ভিটে। সেই সাথে লোকমানের কবর।
দূরে বেড়ী বাঁধের উপর আরো দুটি চক্ষু নেকাবের আড়ালে নীরবে অশ্রু ঝড়াচ্ছে। আমি টের পাই। একজন নারী খুঁজে যায় সন্তানের কবর অথৈ জলের সমারোহে।
এসব লিখতে বসে আমার জ্বিনের ভেতরে ঘর ভাঙ্গার মড়মড় শব্দ শুনছি। আমার দাদার বাড়ী এভাবেই একদিন ভেঙ্গেছিলো বহু বছর আগের একটি বিকেলে, যখন সূর্য বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আমি দেখিনি—আমার আব্বু দেখেছিলেন তবে তিনি তখন অনেক ছোট। কিন্তু সেই দেখা এখনো আমার জ্বিনের ভেতর খেলা করে—তাই পরম বেদনা আর নিজের সাথে মিলের কারনে দুঃখী সেই মানুষগুলোকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলাম ঈদের আনন্দকে ছুটি দিয়ে। ঘরের মাঝে এক হাটু পানি নিয়ে এদের ঈদ কেটেছে। এরা ধিরে সরে আসছে যেভাবে একদিন নিজের জমাজমি সব নদীর কোলে ফেলে দাদা আমার ছুটে এসেছিলেন শহরের উপকন্ঠে।
জীবিতেরা সব চলে এসেছিলো মৃত্যু থেকে পালিয়ে, কিন্তু মৃতেরা?
অবাক হয়ে আবিষ্কার করি অঝোড় বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই এখন ইলশে গুড়ি হচ্ছে। আমি ওভার ব্রিজে দাড়িয়ে ভেজা শহরের জীবন নদীর আঘাতে দৌড়ুতে থাকা মানুষগুলোকে অবলোকন করে যাই। আজ আর ফুটপাথের দোকানগুলো খুলবেনা। ওরা হয়তো যার যার খুপড়ীতে কাঁথা মুড় দিয়ে বৃষ্টির শব্দে নিজেদের অভাবি সুখকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে।
থাক। কাল কিনবো জুতো। আজ ফিরে যাই আমার তেলাপোকার সংসারী সহচার্যে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন