গোধূলির আমারে ডাকে
লিখেছেন লিখেছেন লাল বৃত্ত ২৬ জানুয়ারি, ২০১৩, ১২:৩২:৫২ রাত
সন্ধ্যার লাল রঙগুলো সূর্য থেকে গলে গলে ঐ লেকের মধ্যে গিয়ে পরছে, শহরের শেষ প্রান্তের এই লেকে কমলা রঙের টলমল প্রতিফলিত অগ্নি গোলকের গোধূলি দেখে মনটা খুব বিষণ্ণ নয়ে পরে। এই যা, এখানে আসি মন ভালো করতে, অথচ পৃথিবীর তাবৎ রূপই আমাকে গম্ভীর ও বাক্যহীন একটি বৃক্ষে রূপান্তরিত করে। মাথার ভেতর অলিতে গলিতে ভাবনার চাষ হয়, আর মন কৃষক সেখানে বীজ বপন করে অসমাপিত চিন্তার।
লেকের ডান পাশেই বিরাট যায়গা নিয়ে কবরস্থান, দ্বিপ্রহরের শেষ প্রান্তে স্রষ্টার তরে সিজদা শেষে যখন ছোট ম্যচবাক্সের মত মসজিদটা থেকে বের হই তখন আমি আর এনাম ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। চারপাশে কবরের নৈশব্দটা। বিরাট লোহার গেইট গলিয়ে বাইরে থেকে একজন ভদ্র মহিলা আর তার কৈশোর অতিক্রমকারী-নী কন্যাকে নিয়ে কিছু ফুলগাছ হাতে প্রবেশ করলেন। দাঁড়ি ওয়ালা কালো রকমের বিষণ্ণ চেহারার গোরখোদক আর দুজন মাঝারি গোছের মানব দূরে নতুন কবরটার পাশে দাঁড়িয়ে বেড়াটা ঠিক করে দিচ্ছিল।
রমণী হয়ত তার প্রিয়জনের কবরে এই ফুলগাছ রোপণ করে দিয়ে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন। খুব বেশী আবেগী হলে ঝরঝর করে কেঁদেও ফেলতে পারেন। ওরা দূরে যাচ্ছে... কবরের খুব কাছাকাছি। মেয়েটির মুখ অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে বিষাদগ্রস্ত। সন্ধ্যার শীতার্ত হালকা বাতাসে তার পার্লার থেকে ঘসে মেজে আনা বাদামী চুলগুলো মৃদুভাবে উড়ছে। আমরা হেঁটে চলেছি সময় থমকে দাঁড়ানো এই মানুষগুলোর মৃতদেহ রাখার প্লটগুলোর মাঝে আড়াআড়ি করে সাড় বাঁধা রাস্তায়। খয়েরী ইট পায়ের তলায়। দু চারটা খুচরো শুকনো পাতা খড় অথবা বেড়ে ওঠা অযত্ন আগাছা।
দামী মার্বেল পাথরে ঘেরাও করে রাখা কবরগুলো দেখে মনে প্রশ্ন জাগে- কি থেকে এই মৃতদেহ কে রক্ষার প্রচেষ্টা?? এখানে ঘেরাও করা পাঁচিল আর সার্বক্ষণিক রক্ষণাবেক্ষণকারী থাকার পরেও? কি প্রয়োজন?? মানুষের জীবনই যেখানে অরক্ষিত সেখানে মরণকে এতো সাজিয়ে কি লাভ? কোনটার বাউন্ডারির পাশে আবার বসার জন্য কংক্রিটের চেয়ার। দোয়া করার জন্যই বোধহয়। সাদা মর্মরের পাশেই লাগোয়া কিছু কবরে কেবল বাঁশের বেড়া।
দুজনের হাতের ফুলগাছগুলোকে এতক্ষণে কবরের উপর সুন্দর করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বসন্তে মৃতদেহের জীবাশ্ম থেকে নির্যাস নিয়ে এই গাছে ফুল ফুটবে, আর স্বজনরা এসে সেই ফুলগুলোকে দেখে স্বজন দেখার অভাব মেটাবে। প্রথমে ঘন ঘন আসবে, এরপর সপ্তাহান্তে, মাসান্তে, বছরান্তে এবং এভাবে এক সময় অনিয়মিত হয়ে যাবে তাদের আসা। অতঃপর বাকি সবার মতই পৃথিবী ভুলে যাবে আমি অথবা আমরা এখানে ছিলাম।
গাছ আর কবর যেন কিভাবে খুব বেশি জড়াজড়ি হয়ে থাকে। দাদার কবরকে দেখাতে আব্বু বলতেন ঐ যে ঐ গাছটা দেখছো না?? ওটার নিচেই তোমার দাদার কবর। ভাবলেই মনের চোখে দেখি, আমি আর আব্বু, দুজন মানুষ, গোরোস্থানে ঢুকেছি, সরু পথ ধরে হেঁটে হেঁটে এক স্থানে থেমে যাই। এরপর আব্বুর ইশারা, আর আমাদের দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কবরটাকে জান্নাতের বাগান বানানোর জন্য আবেদন জানাই। এরপর আমরা একসময় ভুলে গিয়েছি, নিজেদের জীবনের ব্যস্ততায় মৃতদের রক্ত শরীরে বহমান থাকা সত্বেও আর যাওয়া হয়না খুব একটা।
ইনামকে বলি, দেখছ?? আল্লাহ কি ষড়যন্ত্র করেছেন? সে আঁতকে উঠে বলে “কি??” বললাম আল্লাহ মানুষকে এতোই ভালো বাসেন যে তিনি চান মানুষ মৃত্যুর পরেও মানবতার কল্যাণে কাজ করুক। প্রশ্ন ফেরত আসে, কিভাবে??
বলি: মৃত মানুষের জন্য পৃথিবী থেকে সকল আউটপুট বন্ধ, কিন্তু বলবত থাকে সৎ কর্মশীল সন্তানের কল্যাণকর কাজের সওয়াব আর সাদাকাতুয যারিয়াহর একদম আন-লিমিটেড প্যাকেজ। তার মানে কেউ যদি তার সন্তানকে একজন সৎকর্ম-শীল, মানবতার জন্য প্রাণোৎসর্গ-কারী মানুষ বানিয়ে যায় তাহলে ঐ ভালো কাজগুলোর পার্সেন্টিজ জমা হবে একাউন্টে। আর তার করে যাওয়া ঐসব কাজ, যেমন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইয়াতিমখানা নির্মাণ সহ সকল ধরণের মানবকল্যাণমুলক কাজ, যেগুলোর মাধ্যমে মানুষ অনন্তকাল ধরে উপকৃত হবে- সেগুলোও পরকালীন মুক্তির জন্য বিশাল একটি অর্জন হয়ে থাকবে।
ভেবে অবাক হই, এরপরেও কেন মানুষ অন্যের অধিকারে হামলে পরে? কেন খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, অনাচার এইসব জঘন্য কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে?? তাহলে মানুষ তার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বেখবর?? সে কি এই জায়গাটা চিনেনা?? এই যে, কবরস্থান। যেখানে তাকে ফিরতেই হবে...
বিশালাকারের লৌহ কপাট পার হয়ে বের হয়ে আসি। মাঝখানে পথ, বাঁ এপাশে কবরস্থান আর ডানপাশে উঁচু উঁচু ভবন। ইনামকে জিজ্ঞেস করি... কোনখানে প্লট/ফ্লাটের দাম বেশি? ইনাম তার সরু আঙ্গুলগুলো কবরের দিকে নির্দেশ করে... ভবন দেখিয়ে বলে- এখানে একশ অথবা নিরানব্বই বছরের জন্য বিক্রি হয়... আর ওখানে সময়টা আন-লিমিটেড।
গোধূলির দিকে অবাক তাকিয়ে দেখি, সে আমারে ডাকে... অদ্ভুত এক সন্ধ্যা আমাকে ঘিরে আদিম নৃত্য করে... আমি চলে যাই।
বিষয়: বিবিধ
১১৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন