মৃত্যুঞ্জয়ীর ফাঁসির সেল - স্বার্থান্বেষী
লিখেছেন লিখেছেন নয়ন খান ০৫ মে, ২০১৬, ১২:৪১:২৯ রাত
রাত ঠিক সাড়ে ৩টা। ফ্লোরে বিছানো কম্বলের উপর এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে। মাথার নীচে কয়েক ভাজে মোড়ানো আরেকটি গুমোট গন্ধের কম্বল। বয়স সত্তর পেড়িয়ে আশি ছুঁই ছুঁই। ডান কাতে শুয়ে মুখের নীচে হাত গুঁজে দিয়ে পড়ে আছে নিথর হয়ে। বার্ধক্য যেন শরীরের শক্তিটুকু গিলে ফেলতে চাইছে। পিঠের লম্বা হাড়টা টেনে সোজা করতে আবার সেই জোয়ান বয়সের শক্তি খুঁজতে হয় ইদানীং। দিনে দিনে দেহের ব্যথা গুলো প্রশ্রয় পেয়ে রোগের খুটা গেড়েছে।
প্রতিদিনের মতো আজো সময়মত ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে তাকাতেই পাশে থাকা মোটা ফ্রেমের চশমাটা হাতাচ্ছেন। চশমাটা চোখে কোনমতে পড়েই ছোট্ট ঘড়িটা হাতে নিলেন। শুয়ে থাকার ইচ্ছা কিছুটা টেনে ধরতে চাইলেও রুটিনবাঁধা প্রতিদিনকার নিয়ম এড়াতে বৃদ্ধ নাড়াজ। সব শক্তি একত্র করে ডান হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন। কিছুক্ষণ দম নিয়ে রুমের উপর ঝুলতে থাকা হলদে লাইটের দিকে তাকিয়ে তন্দ্রাভাব কাটানোর চেষ্টা করলেন। হাটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে দু পা সামনে বাড়িয়ে বাথরুমে বাম পা বাড়িয়ে দিলেন।
আট ফিট বাই আট ফিট সাইজের ছোট্ট কনডেম সেলের মধ্যেই সব। দিনরাত সব এক হয়ে যায় এই রুমের মেঝেতেই। বাথরুম বলতে একটা কোমডের চারপাশে কয়েকটা ইটে গাথা কোমড় সমান ওয়াল। বালতিতে রাখা পানি অর্ধেকে এসে নেমেছে। ওজুর জন্য মগে পানি তুলতেই হাতটা কেপে উঠলো। চারদেয়ালের খাঁচায় মনের জোর সামান্যও কমেনি তার কিন্তু দেহের জোরের সাথে বৃদ্ধ কোন ভাবেই পেরে উঠছেনা। মাঝরাতে ওজুর পানিটুকু হয়তো একটু উষ্ণ হতে পারতো। পাশে একজন মানুষ পরম ভালবাসায় পানি টুকু ঢেলে দিতে পারতেন দু হাত ভরে। পবিত্রতায় ভেজা শরীরটা মুছে দিতে তোয়ালেটা হাতে তুলে দিত পারতো কিন্তু তার সবই এখন বৃদ্ধ লোকটির কাছে রোমন্থনের খোঁড়াক।
কোনমতে ওজু শেষ করে দড়িতে ঝোলানো গামছা দিয়ে আলতো করে শরীরটা মুছে নিলেন। গায়ের চামড়া গুলো কিছু কিছু জায়গায় ঝুলে পড়েছে। হাতের আঙুলের হালকা স্পর্শ গামছার সাথে পানি গুলো শুষে নিলো। জায়নামাজটা বিছিয়ে সাদা পাঞ্জাবীটার গায়ে পড়ে মাথায় সাদা সূতোয় বোনা টুপিটা চেপে দিলেন। হলুদ লাইটের আবছা আলোতে সফেদ শুভ্রতা ছেয়ে গেল সারা দেহে। ধবধবে সাদা দাড়ি গুলো থেকে যেন পবিত্রতা ঠিকরে পড়ছে।
প্রশান্তচিত্তে দাঁড়িয়ে গেলেন নামাজে। ঠোট দুটো নাড়তে নাড়তে একাগ্রতায় ঢুবে গিয়ে প্রভুর বন্দনায় মাতলেন। এতক্ষণের দুর্বল মানুষটিকে এখন যেন বীরের মতো লাগছে। প্রত্যেকটা শব্দ জপে যাচ্ছিলেন অকুণ্ঠ উচ্চারণে। ঠিক যেন সেই বর্ণাঢ্য জীবনমালার মহাপুরুষের ফের জাগরণী প্রত্যাবর্তন। লক্ষ লক্ষ প্রতিশ্রুতিশীল জনশক্তির সিপাহসালা যেন আবার দাঁড়িয়েছে জনসমুদ্রে বজ্রকন্ঠে ভাষণের মঞ্চে, আবার যেন মন্ত্রীসভার আপোষহীন নীতিকর্মের রুপকার হয়ে, আবার যেন বিশ্বজনীন আদর্শিক পরিবর্তনের অন্যতম অভিভাবক হয়ে।
অকুণ্ঠিত দেহটায় যেন এক আধ্যাত্মিক শক্তি ভর করেছে। দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কি এক রহস্যময় কিতাব জপছেন। ঘামে আর চোখ থেকে গড়িয়ে আসা পানিতে সাদা পাঞ্জাবী ভিজে গায়ের সাথে লেপটে আছে। সেদিকে বৃদ্ধের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে একের পর এক সিজদাহ দিয়েই চলেছেন। এবার একটু থামলেন। সিজদাহ থেকে আর মাথা তুলছেন না। যেন প্রভুর এক নাছোড়বান্দা গোলাম।
মনের জমে থাকা কষ্ট গুলো শেয়ার করার কোন মানুষ নেই এই ঘরটিতে। একান্তই একা একা মানুষটি। কালো পোষাকে দরজার বাইরে থাকা প্রহরীদের কেবল পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। ছোট্ট ফাসির সেলে জীবনের ফেলে আসা সময় গুলো আর নিজের হাতে গড়া মানুষ গুলোই ভাবনায় ঘুরপাক খায় সারাদিন। মন খুলে কথা বলার মতো জায়গা তাই শেষ রাতের এই জায়নামাজ। প্রায় দশমিনিট পেড়িয়ে গেছে এখনো ওভাবেই পড়ে আছে সিজদায়। মাথাটা মাটিতে ঠেকিয়ে অবুঝ শিশুর মতো বলছে, হে পরাক্রমশালী, আমার জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত সম্পর্কে তুমি জ্ঞাত। আমার কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য সবই তোমার জন্য উজাড় করেছি। তোমার বাণীর প্রতিটি সত্য উচ্চারণ চিৎকার দিয়ে দুনিয়ার প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়েছি। তুমি তোমার গোলামের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। শাহাদাতের মোহনীয় পেয়ালায় আমার ঠোট ছোঁয়াবার সুযোগ দাও। সব অপবাদ থেকে মুক্তি দাও। আমি যদি আদর্শবাদী দলের নাবিক হয়ে আমার ভাগ্যবান সহযাত্রীদের মতো নির্ভীক চিত্তে ফাসির মঞ্চ ডিঙিয়ে তোমার অতিথি হতে পারি তাহলে এই সত্যের পাল আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। আমার স্ত্রী, সন্তানের মায়াময় ভালবাসার মোহ আমার অন্তর থেকে তুলে নাও। আমার অশ্রুভেজা শোকার্ত পরিবার আর সংগঠনের তুমি অভিভাবকত্ব গ্রহণ করো। শাহাদাৎ ভিক্ষা দিয়ে এই গোলামকে গৌরবান্বিত করো. . . . .
সিজদায় পড়ে থাকা মানুষটির আর্তনাদে ফাসির সেলের ইট সুরকী যেন ঝড়ে যেতে চাইছে। মাটিতে লুটিয়ে থাকা বৃদ্ধের দেহটা কান্নার কম্পনে কাঁপছে। লোহার দরজার ওপাশ থেকে অভিশপ্ত ফাসির মঞ্চ ধসে যেতে চাইছে মজলুমের হৃদয় বিদারী আর্তনাদে। কান পেতে ফাসির মঞ্চ শুনতে থাকে মৃত্যুভয়হীন মানুষটির প্রভুর সাথে শেষ রাতের নিবিড় আলাপন। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। এই বৃদ্ধের আগেও এমনি ভাবে সাহসী মানুষের প্রভুর সাথে পরম সখ্যতার সাক্ষী হয়েছে অভিশপ্ত এই ফাসির মঞ্চ। সে মৃত্যুকে জয় করার স্পর্ধা দেখানোর হিম্মত দেখছে। আর নিরবে বলেছে সত্যিই এরা মৃত্যুঞ্জয়ী।
বিষয়: বিবিধ
৭৩৬৭৮ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন