এক নজরে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও বিচার কার্য যারা পরিচালনা করছেন

লিখেছেন লিখেছেন নয়ন খান ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৯:০৮:৩৮ সকাল



পূরনো লেখা নতুন করে কিছু অংশ দিচ্ছি। লেখাটা বিভিন্ন পত্রিকা ও ব্লগে এসেছিল "কেমন হল ট্রাইব্যুনাল গঠন?" নামে।

পাঠক এবার আসুন, আমরা এক এক করে নীরবে দেখে নেই নিরপেক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ এই টীমের প্রতি জন সদস্যকে। কারণ, এঁদের মাধ্যমে ই বাংলাদেশের ৩৮ বছরের পাপমোচন হবে। আর বহির্বিশ্বে হবে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। কেমন নিরপেক্ষ আমাদের সম্মানিত আইনজীবি মহোদয়বৃন্দ?

ট্রাইব্যুনাল:

চেয়ারম্যানঃ বিচারপতি মো. নিজামুল হক

সদস্যঃ বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদ

বিচারপতি নিজামুল হকঃ

হাইকোর্টের একজন ল’ইয়্যার তিনি। আওয়ামীপন্থী আইনজীবি সমিতির সক্রিয় সদস্য । ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের আইনজীবি সমন্বয় পরিষদের সেক্রেটারী ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ সালে হাসিনার প্রথম শাসনামলে ১৯ জন বিতর্কিত দলীয় আইনজীবিদের সাথে তিনিও হাইকোর্টের বিচারপতি র পদ অলংকৃত করেছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর মহামান্য প্রেসিডেন্ট তাঁর পেশাগত কাজে অদক্ষতা ও দলীয় কর্মকান্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নিয়োগ বাতিল করে দেন। তাঁর সব জুনিয়রই বলেন, হক সাহেব একজন সফল প্রো আওয়ামী আইনজীবি। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন শাসনামলে ব্যারিস্টার শফিকের সাথে শেখ হাসিনা মুক্তি মামলায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টিতে আসেন।

বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরঃ

বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলার কো-জাজ ছিলেন তিনি। বিএনপি-জোট আমলে (২০০১-২০০৬) হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ট্রাইব্যুনালের একজন সদস্যপদে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হলেও পেশায় তিনি চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুলের চেয়ে সিনিয়র। ওয়্যারেন্ট অব প্রসিডিং অব হাইকোর্ট অনুযায়ী তিনি এ পদে নিয়োগ পেতে পারেন না।

অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদঃ

প্রাক্তন জেলা জজ । আওয়ামী আইনজীবি পরিষদের সাথে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ এই পদে জহির সাহেবের মতো একজন অনুগত বিজ্ঞ আইনজীবিকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে।

আইনজীবী প্যানেল:

সদস্য সংখ্যাঃ ১২

প্রধান (চিফ প্রসিকিউটর) গোলাম আরিফ টিপু।

সদস্য: সৈয়দ রেজাউর রহমান, গোলাম হাসনাইন, রানা দাশগুপ্ত, জহিরুল হক, সৈয়দ হায়দার আলী, খন্দকার আবদুল মান্নান, মোশারফ হোসেন, জিয়াদ-আল-মালুম, সুলতান মাহমুদ, নুরুল ইসলাম, ও সানজিদা খানম।

১) গোলাম আরিফ টিপুঃ

২০০৮ সালে রাজশাহীর পিপি ছিলেন। জাহানারা ইমাম কর্তৃক গণআদালতের আইনজীবি প্যানেলের অন্যতম প্রাক্তণ সদস্য ছিলেন গোলাম আরিফ টিপু। প্রতীকি সাক্ষীর ভিত্তিতে সেই বিচারে কয়েকজনকে তিনি মৃত্যদন্ড দিয়েছিলেন। আওয়ামী প্যানেল থেকে নির্বাচন করে তিনি রাজশাহী বার কাউন্সিলে জিতেছেনও। ফেলো আইনজীবিরা তাঁকে ন্যাপ থেকে আসা একজন কট্টরকমিউনিস্ট বলে জানেন। ব্যক্তিগত জীবনে নিকটাত্মীয়-স্বজনদের মসজিদে নামাযের জন্য যাতায়াতকেও নিরুৎসাহিত করেন টিপু।

২) সৈয়দ রেজাউর রহমানঃ

আইনজীবি মহলে সুপরিচিত আওয়ামী মুখ। আওয়ামী লীগের ঢাকা বার কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট।

৩) গোলাম হাসনাইনঃ

প্রাক্তণ ছাত্রলীগ নেতা। বার মহলে তাঁর বন্ধুবান্ধবরা তাঁকে একনিষ্ঠ ও সক্রিয় আওয়ামী লীগার হিসাবেই জানেন।

৪) রানা দাশগুপ্তঃ

চট্টগ্রাম জেলা কোর্টের আইনজীবি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা। এলাকায় দাশগুপ্তকে এক বাক্যে জন্মগত আওয়ামী লীগের ভোকাল ও নামজাদা সাম্প্রদায়িক আইনজীবি হিসেবেই সবাই জানেন।

৫) জহিরুল হকঃ

সুপ্রীম কোর্ট আওয়ামী লীগ জাজদের নেতা। সক্রিয় লীগ কর্মী।

৬) সৈয়দ হায়দার আলীঃ

সুপ্রীমকোর্টের ল’ইয়্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন নেতা হায়দার এখন একনিষ্ঠ আওয়ামী লীগার। ১৯৯৬-২০০১ হাসিনার শাসনামলে অন্ধ দলীয় আনুগত্যের জন্য ডেপুটি এটর্নি জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

৭) খন্দকার আবদুল মান্নানঃ

ঢাকা বারের সদস্য। আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী বলে সমধিক পরিচিত।

৮) মোশারফ হোসেন কাজলঃ

এডভোকেট মোশাররফ হোসেন একজন ডিস্ট্রিক্ট ল’ইয়্যার। প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা। আওয়ামী লীগের গেলবারের শাসনামলে পিপি ছিলেন। নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় লীগ অফিসে বোমা হামলায় দুইজন নিহত হওয়ার মামলায় দলীয় আইনজীবি হিসেবে লড়েছেন। দুই বছর আগেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনজীবি হিসেবে কাজ করেছেন জনাব কাজল।

৯) জিয়াদ-আল-মালুমঃ

জিয়াদ যুব লীগ নেতা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করেন। যদিও এলাকাবাসীর কাছে এর প্রমাণ নেই। গত পাঁচ বছর ধরে ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের মেয়ে নির্মূল কমিটি নেত্রী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের সাথে কাজ করছেন। সুপ্রীম কোর্টে আগে থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্দোলন করেছেন। ইস্যুটি তাঁরই প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আনতে সক্ষম হয়েছেন বলে কিছুদিনে আগেও দাবী করতেন। তিনি আওয়ামী লীগ বাদে তাবৎ রাজনৈতিক দলকেই যুদ্ধাপরাধীদের দল বলে কোর্টে প্রচার করেন।

১০) সুলতান মাহমুদঃ

প্রো-আওয়ামী আইনজীবি নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত।

১১) এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজনঃ

আওয়ামী লীগ থেকে পঞ্চগড়ের নির্বাচিত এমপি। ২৮ মার্চ দৈনিক আমাদের সময়, ‘জেমজুটে সন্ত্রাসী অবরোধ অব্যাহত, এমপি সুজনের হাতে সমাধান?’ শিরোনামে লিখেছে, ‘উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম পাটকল জেমজুট অবরোধ অব্যাহত রেখেছে ইয়াকুব গং। তারা মিল গেটের দোকানে-বাজারে রাত-দিন অবস্থান করছে। লাঠি মহড়া দিচ্ছে। নতুন নতুন দাবি ও হুমকি জারি করছে। বন্ধ পড়ে আছে এত বড় মিল। কর্মহীন হয়ে গেছে তিন হাজার শ্রমিক, অথচ প্রকাশ্যে বিচরণকারী এই সন্ত্রাসীদের ধরতে বা ঠেকাতে সচেষ্ট হচ্ছে না কেউ। মিল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারিতেও ট্রাকের কাজের দাবিতে এ ইয়াকুব গং টানা দু'সপ্তাহ জেমজুট অবরোধ করে রাখে। স্থানীয় এমপি নূরুল ইসলাম সুজনের সুপারিশে মিল কর্তৃপক্ষ সেই ট্রাকের কাজের একাংশ তাদের দিয়েও দেয়। কিন্তু সে কাজটা নিতে তারা গড়িমসি করে। গত ২০-এ মার্চ, শনিবার তারা ট্রাকের গোটা কাজের দাবি নিয়ে ফেরত আসে।.........এমপির নিজ দলেরই একজন নেতা বললেন, 'এমন জুলুমের মুখে কী করে মিল চলবে?' কেউ বলতে পারছে না কবে থামবে এই অবরোধ। যদিওবা থামে, নতুন দাবিতে হুট করে কবে শুরু হবে পরবর্তী অবরোধ? অপর এক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বললেন, 'সবাই জানে কে সবকিছু করাচ্ছে। চাইলে এমপি একদিনেই সব ঠিক করে দিতে পারেন।'

১২) এডভোকেট সানজিদা খানমঃ

ঢাকা-৪ আসনে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। অবরোধ চলাকালীন সময়ে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে সিদ্ধহস্ত ছিলেন বলে আওয়ামী মহলে বেশ নামডাক রয়েছে। তখন পত্রিকায় তাঁর নাম আসত। ‘হাসিনা মুক্তি পরিষদ’র অন্যতম সক্রিয় নেত্রী ছিলেন। শেখ হাসিনাকে জেল থেকে বের করার আন্দোলনকরে লাইম লাইটে আসেন সানজিদা।

সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, ট্রাইব্যুনাল ও আইনজীবি প্যানেল গঠনের ৭২ ঘন্টা পেরুনোর আগেই সরকার আইনজীবি প্যানেলে পরিবর্তন আনছেন। রাজনৈতিক বিতর্ক এড়াতে প্যানেল থেকে সরকার পক্ষের উপরোক্ত দুইজন সংসদ সদস্যকে বাদ দেয়া হচ্ছে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন (শীর্ষনিউজ, ২৯ মার্চ)।

তদন্তকারী সংস্থা:

সাবেক জেলা জজ ও আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আবদুল মতিনের নেতৃত্বে মোট সাত সদস্যের তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জনাব আব্দুল মতিন সরকারী চাকরি শেষে বসুন্ধরা গ্রুপের আইনজীবি হিসেবে কর্মরত আছেন। এই গ্রুপের ভূমিদস্যু ও খুনসহ নানা অপকর্মের কথা শুধু জরুরী সরকারের আমলে নয় কয়েকদিন আগেও অনেক পত্রিকায় কিঞ্চিৎ এসেছে। বসুন্ধরার এইসব বাঘা বাঘা অপকর্ম জনাব মতিনের শানিত যুক্তির মাধ্যমেই আদালত থেকে পবিত্র রূপ নিয়ে বেরুচ্ছে।

সংস্থার অন্য সদস্যরা হচ্ছেন: পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবদুর রহিম, সাবেক উপমহাপরিদর্শক কুতুবুর রহমান, মেজর (অব.) এ এস এম সামসুল আরেফিন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মীর শহীদুল ইসলাম, একই বিভাগের পরিদর্শক নুরুল ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাক খান।

এরকম একদলীয় লোকদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালে কেমন আন্তর্জাতিক মানের বিচার হবে তা নিয়ে আইনজীবি মহলে বেশ হাস্যরদের সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর মত স্পর্শকাতর ও সিরিয়্যাস ইস্যু এঁদের হাতে নিষ্পত্তি করতে দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গআইন ব্যবস্থাকেই কি কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছেনা? দীর্ঘদিনের ‘পাপমোচন’ করতে গিয়ে দেশে আরেকটি অভূতপূর্ব ‘পাপলেপন’ করা হবে কিনা তা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে। আর নতুন ওই পাপের বিচার করতে হয়তো জাতিকে আরো গোটা চারেক লিপইয়্যার বর্ষ পাড়ি দিতে হবে।

বিষয়: রাজনীতি

১২০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File