জিল্লুর রহমান : এক নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক
লিখেছেন লিখেছেন হাসান ২০ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৩৬:২২ রাত
১/১১ এর পরে বিশেষ সরকারের আমলে দুই নেত্রী যখন কারাবন্দী, সেই দুর্যোগময় সময়ে ভয়াবহ চাপের মুখেও যে প্রবীণ মানুষটি রাজনীতির মাঠে পর্বতের মত অটল, অবিচল ও আপোষহীন ভূমিকা রেখেছিলেন সেই নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিককে জাতি হারাল। আমার বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি ছিল রাষ্ট্রপতির মত দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক আসনে এই নিবেদিতপ্রাণ মানুষটিকে বসানোর মাধ্যমে মরহুম জিল্লুর রহমানের সুদীর্ঘ রাজনীতিক জীবনের প্রতি সুবিচার করা।
১৯২৯ সালের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিল্লুর রহমান। তাঁর পিতা মরহুম মেহের আলী মিঞা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও তৎকালীন ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের সদস্য।
তিনি ময়মনসিংহ জেলা শহরে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি হাই স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এম.এ. ও এল.এল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জনাব জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানে জনাব জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সাথে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়।
তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান সহ প্রতিটি গণআন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন।
মোঃ জিল্লুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার কর্তৃক পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় তৎকালীন দখলদার পাকিস্তান সরকার তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদন্ড প্রদান ও সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি মহান জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি আইন জারির পর ওই বছরের ১৬ই জুলাই রাতে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতার হলে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেন। দীর্ঘ ১১ মাস শেখ হাসিনার জেলজীবন এবং চিকিৎসার জন্য আরও প্রায় ৬ মাস দেশের বাইরে অবস্থানকালে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ জিল্লুর রহমান দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল অবদান রাখেন এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে। এই নির্বাচনে তিনি ৬ষ্ঠ বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিলে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০০৯ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। একই বছর ১২ ফ্রেব্রুয়ারি শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব নেন রাষ্ট্রপতির।রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রথম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর একটানা প্রায় চার বছর মোঃ জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য থাকাকালে মোঃ জিল্লুর রহমান আবারও কারাবরণ করেন। ১৯৯২ এবং ১৯৯৭ সালে দলীয় কাউন্সিলে জনাব মোঃ জিল্লুর রহমান পর পর দুইবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।
মোঃ জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী বিশিষ্ট নারী নেত্রী বেগম আইভী রহমান ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নারকীয় গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে দু’দিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পারিবারিক জীবনে জনাব মোঃ জিল্লুর রহমান এক পুত্র এবং দুই কন্যার জনক।
মো. জিল্লুর রহমান ও খন্দকার দেলোয়ার হোসেনরা বিশ্বাসের প্রতিক। মহান আল্লাহ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দু'জনকেই জান্নাত নসিব করুন।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৩২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন