মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-দালালদের তালিকা: গোয়েবলসীয় প্রপাগান্ডায় তরুণ প্রজন্ম আসল দালালদের সম্পর্কে অন্ধকারে!

লিখেছেন লিখেছেন হাসান ২০ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:৫৬:৪২ রাত



লারেপাড়া, ঘাগর, ফরিদপুরের দীপ্তি কুমার বিশ্বাস (পিতা যতীন কুমার বিশ্বাস), মানিকপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরের শান্তি রঞ্জন শীলকে (পিতা শ্যামরঞ্জন শীল) পুলিশ দালাল আইনে আটক (পৃ-১০২) করেছিল যথাক্রমে ১৮.১.১৯৭২ ও ০৫.২.১৯৭২ তারিখে। দিগোলদী, ভোলা, বরিশালের নরেশ পালকে (পিতা মনমোহন পাল) দালালির অভিযোগে ১৭.১২.১৯৭১ তারিখেই পুলিশ গ্রেফতার করে (পৃ. ১৬৫)। ভোলা শহরের অঞ্জলী পোদ্দার, বিএকে (স্বামী রাধেশ্যাম) পুলিশ দালাল আইনে আটক করে (পৃ. ১৬৪)। রূপসী, শাহজাদপুর, পাবনার কৃষিজীবী মনোরঞ্জন দত্ত ও কৃষিজীবী সুশীল কুমার দত্তকে (পিতা নিতাইলাল দত্ত) দালালির অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে ১৭.১.১৯৭২ তারিখে (পৃ. ৩১০)। একই দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করে খাণ্ডাল, জয়পুরহাট, বগুড়ার কৃষিজীবী মঙ্গলা রামকে (পিতা ইতান রাম) ৩০.১.১৯৭২ তারিখে (পৃ. ৩১০)। বড়াইচিরা, মদন, ময়মনসিংহের শচীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বশরমাকে (পিতা ঈশ্বর চন্দ্র বিশ্বশরমা) পুলিশ দালালির দায়ে আটক করে (পৃ. ৫০৬)। রাঙ্গামাটি গার্লস হাইস্কুলের শিকিা মিস ছবি ও মিস ছায়াকে পুলিশ ২৩.১২.১৯৭১ তারিখে দালালির অভিযোগে গ্রেফতার করে (পৃ. ৫৫৪)। চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায়ের ভাই জনি রায়কে দালালির দায়ে ২২.১২.১৯৭১ তারিখে গ্রেফতার করা হয় (পৃ. ৫৫২)। কিল্লামুরা, রাঙ্গামাটির প্রদীপ ত্রিপুরাকে (পিতা ধীরেন্দ্র ত্রিপুরা) পুলিশ রাজাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে (পৃ. ৫৫১)। পাগরা, রাঙ্গামাটির অজিত কুমার চাকমা (পিতা চিক্কমতা চাকমা), নোয়াচন্দ্র চাকমা (পিতা চিদ্দা চাকমা) ও নীরোলেন্দু চাকমাকে (পিতা আনন্দমোহন চাকমা) একই দিন একই অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে। রাঙ্গামাটি ব্যাপ্টিস্ট মিশনের রেভারেন্ড শৌল্যা প্র“ (পিতা লুসাই), সুইছি প্র“ (পিতা রিউ প্র“), মিসেস ম্রাসং চিং (স্বামী রিউ সিউ হা প্র“), মিসেস হ্রই (পিতা থামলিজা লুসাই), মিস টেলার (পিতা থামলিজা লুসাই), মাস্টার চং সুই প্র“ (পিতা রেভারেন্ড সিউ হালা প্র“) ও রাঙ্গামাটি ক্যাথলিক মিশনের উইলিয়াম লুসাইকে (পিতা ভানুনা লুসাই) পুলিশ দালালির দায়ে গ্রেফতার করে (পৃ. ৫৫১)।



যে বইটি থেকে এতণ রাজাকার বা দালাল অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের তথ্যাদি উদ্ধৃত করা হলো, তার শিরোনাম : রাজাকার ও দালাল অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের তালিকা। এটির সংকলন ও সম্পাদক এ এস এম সামসুল আরেফিন (আরেফিন)। মি. আরেফিনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা এ বইটি ২০০১ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে। মি. আরেফিন একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মনোযোগী গবেষক। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরো কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। ‘রাজাকারদের তালিকা’ শিরোনামে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর রংপুর জেলার ওপর তার দু’টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। Collaborators of Pakistan Army শিরোনামে তার আরেকটি গ্রন্থ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রোপটে ব্যক্তির অবস্থান শীর্ষক তার একটি গ্রন্থ বেশ আলোচিত হয়েছে। আরেফিন চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন তথ্য সংগ্রহকারী। আরেফিনের গ্রন্থগুলোকে সাধারণভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন : ‘সকল যুদ্ধেই কমপে ২টি প থাকে। আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং শহীদদেরও তালিকা প্রকাশ করে ইতিহাসের দাবি পূরণের চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের তালিকা প্রকাশ করিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, কাদের হাতে বা কাদের উৎসাহে বাঙালি বীর সন্তানেরা শহীদ হলেন তাদের নাম জানার বা জানাবার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। তাই বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার স্বার্থে স্বাধীনতার প্রতিপদের চিহ্নিত করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক ইতিহাস রচনার জন্য এই তালিকা আগামী দিনের ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকদের পথনির্দেশনা প্রদান করবে। এই তালিকা আমাদের ইতিহাসের একটি মৌলিক ও আকর দলিল। তাই রাজাকার ও দালালদের সম্পূর্ণ তালিকা সংগ্রহের ও প্রকাশের জন্য কালপেণ না করেই আমরা এই তালিকা গ্রন্থটি প্রকাশ করছি (আরেফিন, রাজাকার ও দালাল অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের তালিকা, ভূমিকা)।’

পূর্ণাঙ্গ তালিকার জন্য ‘কালপেণ’ না করে আরেফিন যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন, আয়তনে তা ৫৬৬ পৃষ্ঠার একটি বই। এতে তিনি ৭৩০১ জন গ্রেফতারকৃত রাজাকার-দালালের তালিকা দিয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে প্রায় ৪৩৮৭ জনের কেবল পিতা বা স্বামীর নাম ও ঠিকানা দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় ২৯১৪ জনের পেশাগত বা রাজনৈতিক পরিচিতিও দেয়া হয়েছে। প্রদত্ত পেশাগত পরিচিতির উল্লেখযোগ্য হলো কৃষি, শ্রমিক, ব্যবসায়, চাকরি, পুলিশ, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক, চা দোকানদার, নাপিত, দর্জি ইত্যাদি। আর প্রদত্ত রাজনৈতিক ও ব্যক্তি পরিচয়ের মধ্যে রয়েছে আলেম, নারী, হিন্দু, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, উপজাতীয় প্রভৃতি। বর্তমান নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখযোগ্য পরিচিতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের অব্যবহিত পরে রাজাকার বা দালাল হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

রাজাকার বা দালাল হওয়ার অভিযোগে যে ৭৩০১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে আরেফিনের বই থেকে জানা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে আটককৃতদের পরিসংখ্যানটি দাঁড়ায় এমন : আলেম ৬৪ জন, নারী ৬২ জন, হিন্দু ৪১ জন, জামায়াতে ইসলামী ৫২ জন, মুসলিম লীগ ৭২ জন, উপজাতীয় ৮৮ জন। আর গ্রেফতারকৃত পেশাগত পরিচিতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিসংখ্যানটি এমন : কৃষিজীবী ১৫৭৩ জন, পুলিশ (রেল পুলিশসহ) ২২৪ জন, ব্যবসায়ী ১৫৪ জন, শ্রমিক ৭৮ জন, চাকরিজীবী ১২৮ জন, আইনজীবী ৩৮ জন, চিকিৎসক ৩৩ জন, শিক ৩৬ জন, চা দোকানদার ২৭ জন, নাপিত ২২ জন, দর্জি ১৬ জন প্রভৃতি।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের পরিচিতি ও তাৎপর্য

বাংলাদেশের নাটক-উপন্যাস-সিনেমায় এমন একটি ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে, যাতে মনে হতো দাড়ি-টুপিওয়ালা, মাওলানা-মুন্শী এবং ইসলামপন্থী-ধার্মিক ব্যক্তিমাত্রই এক-একজন রাজাকার-দালাল। কিন্তু আরেফিনের উপস্থাপিত তালিকা দেখে সে ধারণার আমূল বদল ঘটেছে। রাজাকার-দালাল হিসেবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-যুবক-যুবতী-ধর্মগুরুর নাম দেখে আমি বেশ চমকেই উঠেছিলাম। এই কি তবে বাস্তবতা ছিল? রাঙ্গামাটির ব্যাপ্টিস্ট মিশন এবং ক্যাথলিক মিশনের ধর্মগুরুরাও পাকিস্তানি দালাল? তা-ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে (রেভারেন্ড শৌল্যা প্র“, সুইছি প্র“, মিসেস ম্রাসং চিং, মিসেস হ্রই, মিসেস টেলার, মাস্টার চং সুই প্র“, উইলিয়াম লুসাই)? চমৎকৃত হওয়ার মতো তথ্য বটে। চাকমা, ত্রিপুরা, মগ, তঞ্চংগ্যা, লুসাই প্রভৃতি উপজাতীয় পরিচিতির বেশ ক’জন যুবককেও পুলিশ রাজাকার-দালাল অভিযোগে গ্রেফতার করেছে। দীপ্তি কুমার বিশ্বাস ও শান্তি রঞ্জন শীলের মতো হিন্দু যুবকের পাশাপাশি বিএ পাশ অঞ্জলী পোদ্দারের মতো হিন্দু রমণীকেও দালালির অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল বলে আরেফিনের তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে।

রাজাকার-দালাল হিসেবে আটককৃত ৭৩০১ জনের মধ্যে যাদের ন্যূনতম ঠিকানার অতিরিক্ত কোনো পরিচিতি আরেফিন পেয়েছেন বা সরবরাহ করেছেন (২৯১৪ জন), তার মধ্যে ১৫৭৩ জনই কৃষক বা কৃষিজীবী। আশ্চর্যের কথা। বিস্মিত হওয়ার মতো তথ্য। এই কৃষক বা কৃষিজীবীরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে কেনো এমন অগ্রসর রাজাকার বা দালাল হলো, যে কারণে তাদের পুলিশ আটক করতে বাধ্য হলো? এরা কি রাজনৈতিক জ্ঞানে-বিবেচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই পাকিস্তানের প নিল? এমন জ্ঞান এরা কোথায় পেল? এসব প্রশ্ন আমাকে ভাবতে বাধ্য করল এবং এসব বিষয়ে আরো স্পষ্ট ধারণা-জ্ঞান অর্জনে চালিত করল। আমি সংগৃহীত বইগুলোর কয়েকটিতে এসব প্রশ্নের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য জবাব পেলাম। এগুলো আমার বাংলাদেশের পাঠক-বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করার বিবেচনা থেকেই এ লেখা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে কারা রাজাকার বাহিনীর সদস্য হয়েছিল, এ বিষয়ে খুঁজতে গিয়ে তিনিজন ভিন্ন এবং বিপরীত আদর্শের লেখকের খোঁজ পেলাম। তারা তিনজনই রাজাকার বাহিনীতে যোগদানকারী ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট শ্রেণীকরণের আওতায় চিহ্নিত করেছেন। আবার এ তিনজনই এ বিষয়ে মোটামুটি সহমত পোষণ করেছেন। এটি একটি বিস্ময়কর বিরল ঘটনা।

ভাষা আন্দোলন খ্যাত ও চীনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী কমরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন : ‘বাঙালিদের রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার কতকগুলো কারণ ছিল। তা হলো, (ক) দেশে তখন দুর্ভিাবস্থা বিরাজ করছিল। সরকার দুর্ভিরে সুযোগ নিয়ে ঘোষণা করল, যারা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেবে, তাদের দৈনিক নগদ তিন টাকা ও তিন সের চাউল দেয়া হবে। এর ফলে বেশ কিছুসংখ্যক লোক, যারা এতদিন পশ্চিমা সেনার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত দিন কাটাচ্ছিল, তাদের এক অংশ ওই বাহিনীতে যোগ দান করল। (খ) এতদিন পাক সেনার ভয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, আত্মরার একটি মোম সুযোগ হিসেবে তারা রাজাকারের দলে যোগ দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। (গ) এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী জোর করে মানুষের সম্পত্তি দখল করা এবং পৈতৃক আমলের শত্র“তার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ গ্রহণের জন্যও এ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল (কমরুদ্দীন আহমদ, ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’, ঢাকা : নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৮২, পৃ. ১২৫)।

আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ লিখেছেন : ‘বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত প্রমাণাদি হতে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, রাজাকার-রাজাকারই; তবে সব রাজাকার এক মাপের ছিল না। প্রাথমিকভাবে রাজাকার বাহিনীতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের যুবক অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়- যারা নিজেদের ইসলাম ও পাকিস্তান রা করার ল্েয পাক সামরিক বাহিনীকে সহায়তা, বাঙালি হত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করাকে কর্তব্য মনে করেছিল। যারা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল; যারা হিন্দু সম্পত্তি দখল, লুট, ব্যক্তিগত গ্রামীণ রেষারেষিতে প্রাধান্য বিস্তার ও প্রতিশোধ গ্রহণ এবং নানা অপকর্ম করার সুযোগ গ্রহণ করেছিল। আর গ্রামের হাজার হাজার বেকার অশিতি অর্ধশিতি যুবক যাদের পে মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশ চেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না তাদের বেশির ভাগ পেটের তাড়নায় কর্মসংস্থানের জন্য এবং একই সাথে ভয় ভীতি এবং প্রলুব্ধ হয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য হয়।

রাজাকার বাহিনী সুশৃঙ্খল বাহিনী ছিল না। বরং এদের পাকবাহিনী দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। বেশির ভাগই হয়েছে বলির পাঁঠা। তাদের সামনে রেখেই পাকবাহিনী সর্বত্র অগ্রসর হয়েছে।’ (আবু সাইয়্যিদ, ‘সাধারণ মা ঘোষণার প্রেতি ও গোলাম আযম’, ঢাকা : মুক্তি প্রকাশনী, ১৯৯২, পৃ. ৭৫)।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা, বক্তা-ওয়ায়েজ ও ‘সওয়াল-জওয়াব’ ধারণার জন্য বিখ্যাত খন্দকার আবুল খায়ের লিখেছেন : ‘আমি যে জেলার লোক, সেই জেলায় ৩৭টি ইউনিয়ন থেকে জামায়াত আর মুসলিম লীগ মিলে ৭০-এর নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল দেড়শতের কাছাকাছি আর সেখানে রাজাকারের সংখ্যা ১১ হাজার, যার মাত্র ৩৫টি ছেলে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগারদের।… আমার কিছু গ্রামের খবর জানা আছে, যেখানে ৭১-এর ত্রিমুখী বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রামে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেন যে, দুই দিকেই ছেলেদের ভাগ করে দিয়ে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে গ্রামের শতকরা ১০০ জন লোকই ছিল নৌকার ভোটার, তাদেরই বেশ কিছুসংখ্যক ছেলে যোগ দেয় রাজাকারে। যেমন কলাইভাঙ্গা গ্রামের একই মায়ের দুই ছেলের সাদেক আহমদ যায় রাজাকারে, আর তার ছোটভাই ইজহার যায় মুক্তিফৌজে।… এটাই ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবস্থা।… যারা ছিল সুযোগ সন্ধানী, তারা সুযোগ পেয়েছে, ব্যস রাজাকার হয়ে পড়েছে।… এরপর এগার হাজার রাজাকার যারা নৌকা থেকে নেমে এসেছিল, তাদের সব দোষ গিয়ে আমাদের ঘাড়ে চাপল।’ (খন্দকার আবুল খায়ের, ‘১৯৭১-এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল’, যশোর : তৌহিদ প্রকাশনী (তৃতীয় সংস্করণ), ১৯৯২, পৃ. ৪৪-৪৫,৬২)।

তিন ভিন্ন ধারা-আদর্শের এই তিন লেখকের বাইরে আমি একজন গবেষকের একটি গ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেলাম। ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেমসমাজ : ভূমিকা ও প্রভাব (১৯৭২-২০০১)’ শীর্ষক ডক্টরাল থিসিসের উপস্থাপক ড. তারেক এম তওফীকুর রহমান আমার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জ্ঞানের সীমানা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছেন এবং উন্মুক্ত করেছেন। তার বইটি (অ্যাকাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লি., ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৮) বাংলাদেশী রাজনীতির ১৯৭২-২০০১ সময়কার সামগ্রিক অগ্রগতি ও বিবর্তনকেই বুঝতে সাহায্য করেছে। ডক্টরাল থিসিসের মতো একটি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের গ্রন্থ যে সাধারণ শিতি মানুষদের জ্ঞান পিপাসা মেটাতে কাজে আসতে পারে, ড. তারেকের এ গ্রন্থটি পড়ার আগে আমি তেমনটি কখনো ভাবিনি। সাধারণত ডক্টরাল থিসিসগুলো কিছু বিশেষজ্ঞ পাঠকের চাহিদা মেটাতেই উপযোগী হয়ে থাকে। ড. তারেকের এ গ্রন্থটি (তৃতীয় অধ্যায়) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা অনুধাবনে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। এমন নিরাবেগ-নির্মোহ উপস্থাপনা আমি কমই পেয়েছি। সম্ভবত ‘শিরোনামের’ বাধ্যতার কারণে ড. তারেকের উপস্থাপনা মূলত আলেমদের প্রোপটেই এগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘রাজাকার’ বাহিনীর পূর্বসূরি ‘রেজাকার’ বাহিনী তৈরির ইতিহাসসহ অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী বাহিনীর গঠন-কাঠামো বিষয়ে ড. তারেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন পাকিস্তানপন্থী বাহিনীতে কত আলেম যুক্ত ছিলেন, এ বিষয়ে ড. তারেক প্রচলিত নয় এমন জ্ঞান সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থ-মিডিয়া-নাটক-উপন্যাস-চলচ্চিত্র থেকে রাজাকার বিষয়ে পাওয়া আমাদের ধারণা হলো, আলেম-মাওলানা-হুজুর-ইসলামপন্থী মানেই রাজাকার বা পাকিস্তানপন্থী। ড. তারেকের গবেষণা এ বিষয়ে নতুন জ্ঞান সরবরাহ করেছে। আলেমদের প্রোপটে এ বিষয়ে ড. তারেক যে থিসিস উপস্থাপন করেছেন, তা হলো : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্পণ বিষয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের কোনো আলেম প্রকাশ্য বিরোধিতা করেননি। এটিকে আলেমদের ‘সাধারণ সমর্থন’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানি আলেমদের শতকরা ৯০ জন ছিলেন অরাজনৈতিক। রাজনীতি বিষয়ে ১০% আলেম কম-বেশি মনোযোগী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের মিলিটারি ক্র্যাক ডাউনের এবং বাঙালি গণহত্যার প্রোপটে এই ১০% আলেমের ৭০% (যা মূল ১০০%-এর ৭%) রাজনীতি বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নির্লিপ্ত অবস্থান গ্রহণ করেন বা মুক্তিযুদ্ধের এপ-ওপ এর কোনোটির বিষয়েই সক্রিয় না থেকে কেবল ধর্ম-কর্ম নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়েন। অবশিষ্ট ৩% আলেম (মূল ১০০%-এর) মুক্তিযুদ্ধের প-েবিপে সক্রিয় থাকেন। এ ৩% আলেমের মধ্যে, ড. তারেকের থিসিস মতে, ১.৬% থেকে ১.৮% আলেম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন বা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প নেন আর ১.২% থেকে ১.৪% আলেম মুক্তিযুদ্ধের পে বা স্বাধীন বাংলাদেশের প নেন।

আলেমদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার বিষয়টি সহজ ও সাধারণবোধ্য বিষয়। কিন্তু আলেমদের কেউ কেউ (১.২%-১.৪%) মুক্তিযুদ্ধের পে সক্রিয় ছিলেন, ড. তারেকের এ থিসিসটি আমাদের জ্ঞানের েেত্র এক নতুন সংযোজন। এটি ব্যাখ্যা ও অনুধাবনের দাবি করে। ড. তারেকের এ ডক্টরাল উপস্থাপনায় এ বিষয়ক ব্যাখ্যা পাইনি। তবে আমার জন্য সুখের বিষয়, আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে শীর্ষক একটি বই (শাকের হোসাইন শিবলি, ঢাকা : আল-এছহাক প্রকাশনী, ২০০৮) আমি ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছি। বইটিতে লেখক ৬৫ জন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা আলেমের বিবরণ দিয়েছেন এবং আরো ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা আলেমের বিবরণ প্রকাশিতব্য বলে জানিয়েছেন। শিবলির গ্রন্থটি ড. তারেকের ডক্টরাল থিসিস (১.২% থেকে ১.৪% পূর্ব পাকিস্তানি আলেম মুক্তিযুদ্ধের পকে ছিলেন) সত্যায়িত করেছে, এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ জ্ঞানগত অগ্রগতি।

যা হোক, কারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল, তা জানা ও বোঝার জন্য আলোচ্য গ্রন্থগুলো বেশ সহায়ক হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর মে মাসে গঠিত হয় রেজাকার বাহিনী। প্রথমবারের মতো, ড. তারেক সূত্রে জানা গেল, ঠিক এই ‘রেজাকার’ পরিভাষাসহ একটি বাহিনী বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম গড়ে তোলেন হায়দরাবাদের নিজাম সেই ‘পিন্সলি স্টেট’টিকে ভারতীয় আগ্রাসনের কবল থেকে রা করার জন্য। তারা ব্যর্থ হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে নেয়। ড. তারেক জানিয়েছেন, আরবি শব্দ ‘রেজা’ এবং ফার্সি শব্দ ‘কার’ সহযোগে যে শব্দটি (রেজাকার) তৈরি হয়, এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ভলান্টিয়ার’ আর বাংলা প্রতিশব্দ ‘স্বেচ্ছাসেবক’। ‘রেজাকার’ বাহিনীটি শাব্দিক অর্থেই ছিল রেজাকার বা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কোনো বৈষয়িক বিনিময় না পেয়ে এবং না চেয়েই এ বাহিনীটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে নেমেছিল। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ এ সংগ্রাম চলে আগস্ট পর্যন্ত। এরপর পাকিস্তান মিলিটারি শাসকদের জারি করা ‘রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ বলে এ বাহিনীটি হয়ে যায় মিলিটারির একটি সহায়ক বা অক্সিলিয়ারি বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যদের জন্য যথানিয়মে বেতন এবং রেশনের ব্যবস্থা করা হয়, অস্ত্রের জোগান দেয়া হয়, অস্ত্র চালনার প্রশিণ দেয়া হয় এবং সর্বাগ্রে এ বাহিনীতে প্রবেশাধিকার ‘সবার জন্য’ উন্মুক্ত ও সহজ করা হয়। রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের শর্ত ছিল : পঞ্চম শ্রেণী পাস, বয়স অন্তত ১৮ বছর ও শারীরিক সুস্থতা। এর ফলে আগস্ট ১৯৭১ মাস থেকে রাজাকার বাহিনীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নানা প্রোপটের মানুষেরা যোগ দেন-ধর্ম, রাজনীতি নির্বিশেষে। এরই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কমরুদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ ও খন্দকার আবুল খায়েরের লেখা থেকে। সামসুল আরেফিনের সংকলন গ্রন্থ থেকে অংশত জানা যায় রাজাকার দালাল অভিযোগে আটককৃত ব্যক্তিদের পেশাগত ও রাজনৈতিক পরিচয়। দেখা যায়, রাজাকার-দালাল অভিযোগে আটককৃত ব্যক্তিদের মধ্যে জামায়াত-ছাত্রসঙ্ঘ পরিচয়ে খুবই নগণ্য সংখ্যক ব্যক্তি আটক হয়েছিল। এ েেত্র আটক ব্যক্তিদের প্রায় সবাই কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ। তারা প্রধানত জীবিকার প্রয়োজনে বা খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এবং নিরাপত্তাগত বিবেচনায় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হয়েছিল। বেতনভাতার এই বাহিনীতে জামায়াত-ছাত্রসঙ্ঘের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা আর থাকেননি।

বাংলাদেশে এখনো রাজাকার বাহিনীর বিষয়ে স্বচ্ছ-সঠিক ধারণার অভাব আছে বলেই মনে হয়। ঢাকায় এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। সেখানে এই রাজাকার পরিভাষার বহুল ব্যবহার দেখছি। বাহিনী হিসেবে রাজাকার এর কোনো সদস্যকেই কেবল রাজাকার বলার কথা, বলা উচিত। তা আদৌ মানা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে কত মানুষ শহীদ হয়েছেন- মারা গেছেন, এ বিষয়েও একটি বড় ধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। এই লন্ডন শহরে বাংলাদেশী ব্রিটিশ তরুণদের সাথে কথা বলে জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন বলেই তারা বিশ্বাস করে। ঢাকার বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি, সেখানেও সাধারণভাবে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়েই স্থির বিশ্বাস। অথচ ভারতীয় সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের এক রিপোর্টে ২০০৮ সালে আমি পড়েছি, মুক্তিযুদ্ধকালে দুই লাখ ৬৫ হাজার মানুষ মারা গেছেন। আরো কিছু লেখা ও প্রকাশনায় এরকম পরিসংখ্যানই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী শহীদদের একটি তালিকা তৈরির মতো ন্যূনতম দায়িত্ব পালনেও বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। এটা গুরুতরভাবে লজ্জার বিষয়। ক’মাস আগে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বলেছেন, স্বাধীনতার ৪১ বছর পর সেই শহীদদের তালিকা প্রণয়ন খুব কঠিন কাজ। তাজুল ইসলাম তার বক্তব্যে শহীদদের তালিকা প্রণয়নের সেই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করার বিষয়ে ইতিবাচক কোনো আশ্বাসও দেননি। এ কাজটি করা গেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যাবিষয়ক অস্পষ্টতা দূর হতো। এ কাজটি বেসরকারি উদ্যোগে সম্পন্ন হবে, এমন কোনো সংবাদও জানা নেই। অথচ এ কাজটি করা উচিত শহীদদের প্রতি ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়বোধ থেকেই। তা করা না হলে অল্পসংখ্যক তালিকাভুক্ত শহীদের বাইরে অন্য শহীদের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন। এটি হতে দেয়া উচিত নয়। সুদূর এই বিলাতে বসে এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের ভাইদের কেবল উৎসাহিত করতে পারি, চাই কি কিছু বস্তুগত সমর্থনও জোগাতে পারি। মূল উদ্যোগটি ঢাকার কোনো উদ্যমী ব্যক্তিকেই নিতে হবে।

২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আ.লীগ প্রধান শেখ হাসিনা প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেই বলেছিলেন “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অলরেডি হয়ে গেছে, জনগণই নির্বাচনের মাধ্যমে এই বিচার সম্পন্ন করে ফেলেছে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের ম্যান্ডেট দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুর নিস্পত্তি করেছেন।”

পাকিস্থানি মূল অপরাধীদের ক্ষমা চাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার স্ব-প্রণোদিত হয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে অনুরোধ করতে পারল, অথচ মূল অপরাধের কথিত এ দেশীয় সহযোগিদের (প্রকৃত পক্ষে ভারতীয় আগ্রাসনের আশংকায় অখণ্ডতার সমর্থক, যুদ্ধাপরাধের সহযোগিও নয়) ওপর এত কঠোরতা, অবিচার ও জুলুমের দ্বৈতনীতির কারন একটি শিশুরও অজানা নয়।

আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাইত, তাহলে ক্ষমা চাইতে না বলে পাকিস্তানে অবস্থানরত মূল যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানাত।

তরুণ প্রজন্মের সত্যিকার প্রয়োজন ও চাওয়ার দিকে কোন নজর না দিয়ে, কিছু ভারতপ্রেমিক সুশীল মিডিয়া ও তাদের ক্রীম খাওয়া কতিপয় প্রবীন ভারের জাতি বিনাশী ইস্যুকে তরুণ প্রজন্মের ইচ্ছার নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের প্রচারনা অনুযায়ী দেশের মানুষের বিশেষ করে তরুণদের চাওয়ার পাওয়ার মত কোন স্বপ্নই হয়তো নেই। মনে হয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন নয়, তরুণ প্রজন্ম কেবল তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায়!!!?

মালয়েশিয়া যখন বলে 'এক মালয়েশিয়া', তখন স্বাধীনতার ৪১ বছর পরেও আমরা জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দু'ভাগে বিভক্ত করা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি! আজকে বিচারপতি, আইনজীবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবি, শ্রমিক, কৃষক সব জায়গাতেই ২ দলে বিভক্ত। বিদেশী শকুনদের হাত থেকে দেশের সম্পদকে রক্ষা করে সামনে এগুতে একটি শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য সময়ের দাবী। তবে তার দর্শন হতে হবে ন্যায় ও দেশ।

প্রহসনের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসহ নানা ইস্যুতে আওয়ামীপন্থী সুশীলরা হাতে-গোনা এই ৪/৫ শতাংশ ডাইল খোরের দাবীকে দেশের দেশের সকল মানুষের দাবি তথা চাওয়া পাওয়া বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। New Age এর অনলাইন জরিপে দেশের ৯৩% এবং যায় যায় দিনের জরিপে ৮২% মানুষ জামায়াতের রাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে।

নজিরবহীন ট্রাইব্যুনালগেট কেলেঙ্কারি, পদ্মাসেতু-হলমার্ক-রেলের দুর্নীতি কিংবা দিনের আলোতে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আ.লীগের সরকারের যেখানে কালেক্টিভলি সুইসাইড কিংবা লজ্জায় পদত্যাগ করার কথা, সেখানে তাদের টপ টু বোটম ভয়াবহ মিথ্যাচার ও বিরোধীদলকে উল্টো চাপে রাখার ঘটনার কাছে সম্ভবত হিটলার এমনকি শয়তানও নস্যি। আ.লীগ যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে, অন্যেরা তত সুন্দর করে সত্যটাও বলতে পারে না।

স্কাইপের মাধ্যমে প্রহসনের বিচারের বিষয়টি ফাঁস হওয়ায় মিথ্যা গল্প শুনিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ধোকা দেওয়ার দীর্ঘ অধ্যায়ের অবসান হলো। ইতিহাস বিকৃতির কারনে আ.লীগের রাজনীতির জানাজা হলো।

আ.লীগের টপ টু বোটম একেবারে ঠান্ডা মাথায় যুদ্ধাপরাধের রোগে আক্রান্তের অভিনয় করে তাদের যাবতীয় ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দেশবিরোধী অপকর্ম আড়াল করে চলেছে। প্রহসনের যুদ্ধাপরাধ বিচার হলে বা না হলে ঘোড়ার ডিম হবে!

শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের পর দেশের হত্যা-খুন কি কমেছে? দেশ কি সিংগাপুর হয়েছে? মূল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মীমাংসিত বিষয়টি নিয়ে জাতির সাথে যে প্রহসন করা হচ্ছে তাতে কিছু নিরাপরাধ মজলুমের শাস্তি দেওয়া হলে দেশ কি অপরাধ, অভাব ও সমস্যামুক্ত হয়ে যাবে?

আগ্রাসীদের ক্রীম খাওয়া সুশীল মিডিয়া ও কতিপয় প্রবীন ভারের জাতি বিনাশী ইস্যুকে তরুণ প্রজন্মের ইচ্ছার নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তরুণ প্রজন্মের প্রকৃত ইচ্ছাকে ধারন না করে, গোয়েবলসীয় কায়দায় তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার দায় তরুণদের ওপর চাপানো হচ্ছে।

তথ্যসূত্র- দালাল রাজাকার প্রসঙ্গে- ড. আহমদ হাসান

বিষয়: রাজনীতি

৩০৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File