আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার কিংবদন্তী রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের ৭৭তম জন্মদিন: ‘একটি লাশের পাশে সমগ্র বাংলাদেশ’
লিখেছেন লিখেছেন হাসান ১৮ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:২৪:৫২ রাত
১৯ জানুয়ারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৭৭তম জন্মদিন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী থানার বাগবাড়িতে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে গভীর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের হাতে ৪৫ বছর বয়সে তিনি নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন।
সৈনিক জিয়া মহান। রাষ্ট্রনায়ক জিয়া মহত্তর। তিনি গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন ভিশনারি এক স্বপ্নদ্রষ্টা। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব; মুক্তিযুদ্ধের সেই ব্র্যাকেটবন্দী দেশগুলো—যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন আর ভিয়েতনামের মতো।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষনজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম,পরিশ্রমপ্রিয়তা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলি এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে তা জোটেনি। মাত্র ছয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ওপর ছিল প্রচণ্ড আস্থাশীল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার ওপর মানুষের এই আস্থায় কোনো চিড় ধরেনি।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী থানার বাগবাড়িতে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মনসুর রহমান কলকাতায় একজন কেমিস্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। শৈশব ও কৈশোরের একটি সময় গ্রামে কাটিয়ে পিতার সাথে কলকাতায় এবং দেশ বিভাগের পর করাচিতে চলে যান জিয়াউর রহমান। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার সাথে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার কোম্পানি যুদ্ধে সবচেয়ে অধিক খেতাব লাভ করে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জন্য তিনি নিজেও একটি পিস্তল উপহার পান। সৈনিকজীবনে তিনি যেমন চরম পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন ঠিক জাতীয় সব সঙ্কটকালেও শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যখন নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নেতারা যে যে দিকে পারেন আত্মগোপন কিংবা পালিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বিশ্বসম্প্রদায়কে বাংলাদেশের মানুষের এ ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে সমর্থনের আবেদন জানান। ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে তিনি একটি সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে সমরনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন।
জিয়াউর রহমান
বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি
অফিসের কার্যকাল : ২১শে এপ্রিল, ১৯৭৭ – ৩০শে মে, ১৯৮১
প্রধানমন্ত্রী : শাহ আজিজুর রহমান
পূর্বসূরী : আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম
উত্তরসূরী : জাস্টিস আব্দুস সাত্তার
জন্ম : জানুয়ারি ১৯, ১৯৩৬ ভারত বগুড়া জেলা, বঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু : মে ৩০, ১৯৮১ (৪৫ বছর) বাংলাদেশ চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
জাতীয়তা : বাংলাদেশী
রাজনৈতিক দল : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল
দাম্পত্য সঙ্গী : বেগম খালেদা জিয়া
পেশা : সামরিক রাজনীতিবিদ
ধর্ম : ইসলাম
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৬ - ৩০ মে, ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি, একজন সেনাপ্রধান এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।
জন্ম ও শৈশব
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়। ভারতবর্ষ বিভাগের পর (১৯৪৭) তাঁর জন্মস্থান পূর্ব পাকিস্তানের অংশে চলে আসে এবং তাঁর পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান। তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জিয়ার সামরিক জীবন
১৯৫৩ সালে তিনি কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সেখানে দুই বছর চাকুরি করেন, তারপর ১৯৫৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ঐ সময়ই ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের বালিকা, খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরষ্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের অন্যতম। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত মেডাল লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।
“ This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, on behalf of Bangobondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.”
মেজর জিয়া এবং তাঁর বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁরা বেশ কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়নত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধপরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জিয়ার সামরিক জীবন
স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব
১৯৭৫ সালের এই দিনে সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে নস্যাৎ হয়ে যায় প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্র। আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ। এদিন সিপাহী-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে আনেন তত্কালীন সেনাপ্রধান ও স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।
১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী দল সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দি করে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা সাধারণ জনগণ ও সিপাহীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে, বিশেষত সিপাহীদের কাছে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ এক বিপ্লব, যা ইতিহাসে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে স্থান লাভ করেছে। দেশবাসী সেদিন জিয়ার হাতেই তুলে দিয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয়, ‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে ভণ্ডুল হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা। এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর-গ্রামেও পৌঁছে যায়।’
৭ নভেম্বর সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লেখেন, ‘১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। এই কাজগুলো করল বামপন্থী জাসদ। এ সময় রাজনৈতিক দল জাসদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর আবরণে। একটি ব্যাপারে ডান ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলই একমত ছিল। আর তা হচ্ছে, খালেদ মোশাররফ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে ঘৃণিত বাকশাল ও মুজিববাদ ফিরিয়ে আনতে চাইছে।’
৭ নভেম্বরের ভোরের দিকে জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ল। সারা ঢাকা শহরে এই ‘সিপাহী বিপ্লব’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাত ১টার মধ্যেই সিপাহীরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিল। একদল জওয়ান গেল জেনারেল জিয়ার বাসভবনে। চারদিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেলেন জেনারেল জিয়া। নৈশ পোশাক পরা অবস্থাতেই জিয়াকে উল্লসিত জওয়ানরা কাঁধে করে নিয়ে গেল ২ ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টারে। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন বিহ্বল হয়ে পড়েন জিয়া। নাম না জানা অনেক জওয়ানের সঙ্গে আলিঙ্গন, করমর্দন করেন তিনি।
গ্রন্থটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘রেডিওতে ক্রমাগত সিপাহী জনতার বিপ্লবের ঘোষণা এবং জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখলের খবর শুনে হাজার হাজার লোক স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে এলো। তিনদিন ধরে তারা বিশ্বাস করছিল যে, ভারত খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে তাদের কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন করছে। এখন সেই দুঃস্বপম্ন কেটে গেছে। সর্বত্র জওয়ান এবং সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করল, রাস্তায় নামল। সারারাত তারা স্লোগান দিল, ‘আল্লাহ আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ।’ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মতো এদেশের মানুষ আবার জেগে উঠেছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়া
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার পর ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন,
“ I will make politics difficult for the politicians.”
১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করে তা জনপ্রিয় করে তোলেন। বাংলাদেশে বহু সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের মতের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান।
আইনশৃঙ্খলা
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা-বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবেলা করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাঁকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
বহুদলীয় গণতন্ত্র
নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং অবাধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির গণতন্ত্রায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এইভাবে, তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং রাষ্ট্রপতির পদে নিয়োজিত থাকেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপারসন (Chairperson)। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক ছিলেন। বিএনপির সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫% সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহবায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আঃ মালেক উকিলএর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন
জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:
# সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।
# জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
# বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া।
# দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব।
# সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারী সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন।
# গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান।
# গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন।
# গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা।
# হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ।
# ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।
# নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ।
# কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি।
# কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ।
# যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।
# ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ।
# বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন।
# তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
# জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ।
# তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি।
# দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে 'সার্ক' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ।
# বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।
# জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন।
# শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিশেষ একটি কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী ভারত সহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার দুটি মূল দিক ছিল সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে আসা ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা। জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাতীত প্রাচ্যের আরেক পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তাঁর পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্কে স্বাধীনতার পর থেকেই শৈতল্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা জিয়াই রচনা করে গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পূণর্গঠনের কাজ অনেকটা তরান্বিত করেছিলেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রাগারের দিকে তাকালে সেই সত্যই প্রতিফলিত হয়। সামরিক পূণর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উন্নত কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে জিয়া রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রাথমিক ভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তাঁর উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।[৪] কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগীতার বদলে সহযোগীতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।
মৃত্যু
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে যারা জিয়ার বিরোধীতা করত তাদের সাথে জিয়ার নির্মম ব্যবহারের কারণে জিয়ার অনেক সমালোচনা করা হত। যদিও জিয়া অনেক জনপ্রিয় ছিলেন, জিয়ার পুনর্বাসনে কয়েকজন আওয়ামী লীগের লোক তার প্রচুর বিরোধীতা করে। এসব বিক্ষোভের দূরকল্পনা থাকার পরেও জিয়া তার দলের স্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ঘঠিত কলহ থামানোর জন্য ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রামে আসেন এবং সেখানে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে থাকেন। তারপর ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে বীর উত্তম মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। জেনারেল জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটে।
একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ
মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতে শোকে মুহ্যমান ছিল গোটা জাতি। তাঁর কফিনের পাশে অবস্থান নিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। ঢাকার সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। রাজধানী ঢাকার সব পথই সেদিন মিশে গিয়েছিল এক মোহনায়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় শহীদ জিয়ার মরদেহ আনার পর তার জানাজায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। সবার চোখে ছিল কান্না আর হৃদয়ে শোকানুভূতি। বিপথগামী সেনাসদস্যরা ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাঁর মরদেহ সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশে পাহাড়ের ঢালুতে কবর দেয়। হত্যাকারীরা ওই কবরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আরও রাখে ওই ঘটনায় নিহত কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ রাখা হয় ওই দুজন সেনা অফিসারে মাঝে।
১ জুন বেলা ১১টায় জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ তোলা হয়। ওইদিন বিকাল পৌনে ৪টায় বিমান বাহিনীর একটি বিমানে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয়। এ সময় এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয় শহরজুড়ে। বিমানবন্দর থেকে জিয়াউর রহমানের কফিনটি একটি সামরিক যানে সেনানিবাসের প্রেসিডেন্ট ভবনে আনা হয়। সেনানিবাসের ১ নং গেট থেকে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু্ই পাশে বিমান বাহিনীর সদস্যরা শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। আর গেটের বাইরে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে আনার পর এখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বেগম খালেদা জিয়া, তাঁদের দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান, আত্মীয়-পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকাল ৫টায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিন সংসদ ভবনে নেওয়া হলে সেখানেও তাঁর মৃতদেহ একনজর দেখার জন্য শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণের দেখার সুবিধার জন্য এদিন (১ জুন) রাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ফলে রাত ৯টা পর্যন্ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য পুরনো জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। মানুষের ঢলে এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, মহাখালী রেলগেট, বাংলামোটর এলাকা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এসব এলাকা ও আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাতে মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুরা পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের লাশ একনজর দেখার জন্য ভিড় জমায়।
পর দিন ২ জুন সকাল ১১টা পর্যন্ত কফিনটি তেজগাঁও সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাখা হলে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেখানে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অগণিত মানুষ শহীদ জিয়াকে শেষবারের মতো একনজর দেখেন। এদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। এসব খবর ওই সময়ের দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। একই সঙ্গে পত্রিকাগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামে জিয়াউর রহমানের অসামান্য অবদান, একটি নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনা, একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিয়াউর রহমানের সাফল্য ইত্যাদি উল্লেখ করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
২ জুন দৈনিক আজাদ ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ’ শিরোনামের খবর ৮ কলামজুড়ে প্রকাশ করে। আর দৈনিক ইত্তেফাক এদিন ‘ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃতদেহ : অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ এবং ‘রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জিয়ার লাশ চাপা দেওয়া হয়’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। এর পরদিন অর্থাত্ ৩ জুন দৈনিক আজাদ প্রধান খবর হিসেবে—‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান
পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ দাফন’- শিরোনামে ৮ কলামে প্রকাশ করে। এর পরদিন ৪ জুন বৃহস্পতিবার দৈনিক আজাদ ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ইন্তেকালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত শোক প্রস্তাব গৃহীত : বিশ্ব এক বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক হারাইল’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে। আর এদিন দৈনিক ইত্তেফাক ‘সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত : জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের বিশিষ্ট সাধক জাতীয়তাবাদী চিন্তার অগ্রনায়ক’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশ করে।
এসব প্রতিবেদনে বলা হয়—আধুনিক বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মরহুম প্রেসিডেন্ট একজন নিঃস্বার্থ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত সত্, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, ধর্মপ্রাণ, সদালাপী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। অনুরূপ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় বিরল। দৈনিক ইত্তেফাক এবং আজাদে প্রকাশিত কয়েকটি রিপোর্ট তুলে ধরা হলো—
একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ
স্টাফ রিপোর্টার : চট্টগ্রামে বিপথগামী কতিপয় সেনার হাতে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ গতকাল ঢাকা আনয়নের পর এক বর্ণনাতীত মর্মান্তিক শোকাবহ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ ঢাকা পৌঁছেছে—এখবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নামিয়া পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলামোটর, আসাদগেট এবং মহাখালী রেলগেটের দিক হইতে জনতার স্রোত সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ক্রমে জনতার শ্রোতের মুখে ফার্ম গেট হইতে মহাখালী গেট পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া যায়। জনতার ঢেউ ছুটিয়া চলিয়াছে একদিকে। মনে হইয়াছে রাজধানী তথা সারা বাংলাদেশের মানুষ জড়ো হইয়াছে একটি কফিনের পাশে। রাষ্ট্রপতি জিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। তবে তিনি তার জনতার উদ্দেশে হাত উঁচাইয়া তাহাদের প্রতিউত্তর দেন নাই। লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে দেহরক্ষীদের চোখ এড়াইয়া অকস্মাত্ গাড়ি থামাইয়া স্বীয় গমন পথে অপেক্ষমাণ খাটিয়া খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোর সহিত হাত মিলান নাই। অথবা এই কথাও বলেন নাই আপনারা কেমন আছেন।
তিনি আসিয়াছেন। কিন্তু চির নীরব। চিরনিদ্রায় শায়িত। কফিনের অভ্যন্তরে। কফিন জাতীয় পতাকা এবং পুষ্পে পুষ্পে আচ্ছাদিত।...
গতকাল বিকাল ৫টা হইতে লাশ জাতীয় সংসদ ভবনে রাখা হইয়াছে। আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত কফিন সংসদ ভবনে রাখা হইবে। ( দৈনিক আজাদ : ৩ জুন মঙ্গলবার ১৯৮১)
ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ : অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি
(ইত্তেফাক রিপোর্ট) : এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশে গতকাল (সোমবার) চট্টগ্রাম হইতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ ঢাকায় আনয়ন হয়। নিহত প্রেসিডেন্টকে একনজর দেখার জন্য সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল নামে।
গতকাল (সোমবার) অপরাহপ্ত পৌনে ৪টায় চট্টগ্রাম হইতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মরদেহের কফিন লইয়া বিমান বাহিনীর একটি বিমান কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় তেজগাঁও বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করিয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কফিনটি শ্রদ্ধাসহকারে গ্রহণ করেন। বিমান হইতে কফিনটি বিমান বাহিনীর সদস্যগণ একটি খোলা সামরিক যানে উঠাইয়া নেন এবং কফিনটি পুষ্পস্তবকে সজ্জিত করা হয়। কফিনের সহিত বিমানে বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মহিবুল হাসান, উপমন্ত্রী মিসেস কামরুন্নাহার জাফর এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ডক্টর মিসেস আমিনা রহমান আগমন করেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে শোকে মুহ্যমান দেখা যাইতেছিল।
প্রেসিডেন্টের কফিনটি লইয়া সামরিক যানটি সেনানিবাসের প্রেসিডেন্ট ভবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করিলে বিমান বাহিনীর সদস্যগণ ‘গার্ড অব অনার’ প্রদর্শন করেন। সেনানিবাসের ১নং গেট হইতে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু্ই পার্শ্বে বিমান বাহিনীর সদস্যগণ শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া সম্মান দেখান। এই সময় ১নং গেটের বাহিরে হাজার হাজার মানুষ প্রতীক্ষাকুলভাবে দাঁড়াইয়াছিলেন।
কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে লইয়া যাওয়ার পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বেগম জিয়াউর রহমান, তাঁহাদের দুই পুত্র, আত্মীয়-পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সকলেই কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন।
সংসদ ভবনে : জনসাধারণের দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশের কফিনটি গতকাল অপরাহেপ্ত সাড়ে ৫টায় সংসদ ভবনের সম্মুখে লইয়া আসা হয়। সেখানে প্রথমে সংসদ সদস্যরা শোকাহত চিত্তে কফিনের সম্মুখে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রাষ্ট্রপতির মরদেহ আনার খবর রাজধানীতে ছড়াইয়া পড়িলে একঘণ্টা সময়ের মধ্যে এয়ারপোর্ট রোডে অগণিত লোক রাস্তায় নামিয়া আসেন। পুলিশ শোকাহত লোকজনকে সারিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করে। বাংলামোটর হইতে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যায়। আগামীকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত কফিনটি সংসদ প্রাঙ্গণে রাখা হইবে। জনসাধারণের দেখার সুবিধার্থে গতরাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়।
সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়, রাত ৯টা পর্যন্ত নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে প্রচণ্ড ভিড় পরিলক্ষিত হয়। কফিন রাখা জায়গার দিকে মানুষের লাইন এয়ারপোর্ট রোডের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আগাইতেছিল। একদিকে ফার্মগেট এবং অন্যদিকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এসব ও আশপাশের এলাকায় মানুষের ভিড় অঘোষিত মিছিলের মতো পরিলক্ষিত হয়।
রাত পর্যন্ত মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুদের পর্যন্ত ভিড় করিতে দেখা যায়। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দীন হোসেন, আওয়ামী লীগের (মিজান) মিজানুর রহমান চৌধুরী, মুসলিম লীগের খান এ সবুর, জাসদের মেজর (অব.) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, একতা পার্টির সৈয়দ আলতাফ হোসেন, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সিদ্দিকুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির নাসিম আলী গতকাল সন্ধ্যায় সংসদ ভবনের সম্মুখে শায়িত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২ জুন মঙ্গলবার ১৯৮১)
শহীদ জিয়ার জানাজার উপর কয়েকটি দুর্লভ ভিডিও
১৯৭৫ সালে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, প্রকৃতপক্ষে সে সময় দেশে কোনো সরকার ছিল না। কোথা থেকে কী হচ্ছে তা জানতে পারছিলেন না কেউ। চার দিকে এক অনিশ্চয়তা-বিশৃঙ্খলার মাঝে আধিপত্যবাদের শ্যেন দৃষ্টিতে উৎকণ্ঠিত ছিল সারা জাতি। ইতিহাসের সেই বিশেষ ক্ষণে সিপাহি-জনতার মিলিত প্রয়াসে জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন এবং নেতৃত্বের হাল ধরেন।
তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি বাংলাদেশের মানুষের উপযোগী একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটান। দেশে সমন্বয়ের রাজনীতি চালু করে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিতে এক দিকে যেমন চরম বামপন্থীরা স্থান পায় তেমনি চরম ডানপন্থীরাও জায়গা করে নেন। একটি উদার ও মধ্যপন্থী দল হিসেবে বিএনপিকে গড়ে তোলেন তিনি, যা বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল। তার অমরকীর্তি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করা। এ ছাড়াও তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস জোগান তিনি। তাকে নিয়ে অনেকেই আজকাল ইঙ্গিতে কটু কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু জীবদ্দশায় কেউ কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেননি। তার মতো সাদামাটা জীবনযাপনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ কেন সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ইতিহাসে খুব বেশি নেই। তার চরিত্রে কোনো কপটতা ছিল না। সময় ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তিনি নেতৃত্বে এসেছেন। কাউকে উৎখাত কিংবা উচ্ছেদ করে তিনি আসেননি। এখানেই জিয়াউর রহমান ও অন্যদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। তিনি যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তা বোঝা গিয়েছিল ঢাকায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত তার নামাজে জানাজায়। সেদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল ‘একটি লাশের পাশে সমগ্র বাংলাদেশ।’
আমাদের পথ- জিয়াউর রহমান
আমাদের দুনিয়া এবং জগৎকে আমরা ইংরেজিতে বলি ইউনিভার্স। এটার সৃষ্টি কিভাবে হলো, কেন হলো তা আজ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকেরা বলতে পারেননি। তারা বলেন, বিগ ব্যাং (Big Bang অর্থাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত ও বিরাট শব্দ)। একটা বিগব্যাং হলো এবং দুনিয়া সৃষ্টি হলো, জগতের সৃষ্টি হলো। কিন্তু বিগ ব্যাং কে সৃষ্টি করল এর জবাব আজ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকেরা দিতে পারেননি। এর জবাব দিয়েছে মৌলভি সাহেবরা এবং তারা বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা।
যেখানে জবাব বিজ্ঞান দিতে পারেনি সেখানে ধর্ম দিয়েছে এবং সে জন্যই সায়েন্স ও ধর্ম কমপ্লিমেন্টারি। আমাদের ধর্মে বিজ্ঞান সম্বন্ধে বলা রয়েছে, শিক্ষা সম্বন্ধে বলা রয়েছে, জ্ঞান সম্বন্ধে বলা রয়েছে। আপনারা একটা কথা শুনেছেন, আল্লাহ তায়ালা রিজিক দেবে। এটা ভুল কথা নয়। কিন্তু রিজিক যে দেবে তার জন্য কাজ করতে হবে। কাজ না করলে ফল পাবেন না।
বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক পুরনো। এ মাটির নিচে যে আছে অজস্র ধনদৌলত তা অতীতে আমরা সন্ধান করিনি। ফলে আহরণ করতে পারিনি কিছুই। আমাদের বিজ্ঞানীরা হতে চান অফিসার, তারা খোঁজেন চেয়ার-টেবিল। তারা মাঠঘাটে যেখানে প্রকৃত গবেষণা চলে সেখানে যেতে চান না। এটাই হলো বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য। এই দুর্ভাগ্য আমাদের নিজেদের তৈরি করা। আমাদের মাটিতে সব কিছু রয়েছে। জিওলজি সম্বন্ধে আমার সামান্য স্টাডি রয়েছে। আমি ইদানীং পড়েছি। আমি এগুলো আগে জানতাম না। এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মাটিতে স্থল এলাকা এবং পানি এলাকা অর্থাৎ সমুদ্র এলাকায় গ্যাস তো আছেই, তেলও রয়েছে। তেল মাটির স্থল এলাকায় রয়েছে, পানিতে রয়েছে এবং প্রমাণ আপনারা আগামী দিনগুলোতে পাবেন। বেশি দিন লাগবে না।
গ্যাস আমরা পেয়েছি। কারণ গ্যাস হলো হালকা এবং এটা ওপরে থাকে। তেল একটু ওজনদার, নিচে থাকে। কিন্তু আমরা সেই গভীরতায় যাইনি। ১৯২৩ সালে সিলেটের এক জায়গায় তেল পাওয়া গিয়েছিল। তা কেবল এক হাজার মিটার অর্থাৎ তিন হাজার ফুট নিচে ছিল। আমাদের পাচ হাজার থেকে সাত হাজার মিটার নিচে যেতে হবে এবং আমরা নিঃসন্দেহে তেল পাবো যে তেল আমাদের এতো পীড়া দিচ্ছে। কেবল সেখানেই শেষ হয় না গল্প। সমুদ্র এলাকায় বঙ্গোপসাগরে আমরা চাপ দিয়েছি। রাজনৈতিক চাপ দিয়েছি। বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা এ বিষয়ে সম্যক তথ্য বের করলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, যে স্ট্রাকচার আছে জমির নিচে, এগুলোতে হাইড্রো-কার্বন অর্থাৎ তেল পাওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিদেশী তেল কোম্পানিগুলো, অনেকে যারা চলে গিয়েছিল তারা এখন এসে ড্রিলিং অনুমতি চাচ্ছে। এই জমির নিচে আমাদের যে শেখানো হয় এটা আছে, এটা নেই, এগুলো সব বিদেশী চক্রান্ত। আমাদের অতীতে যেভাবে বোকা বানিয়েছে তা এখনো বানিয়ে চলেছে। আর আমরা সেটা মেনে নিচ্ছি। আমাদের স্থির লক্ষ্য থাকলে সব কিছুই হবে এবং সেই স্থির লক্ষ্য হবে রাজনৈতিক। আপনারা শুনেছেন, আমাদের শেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম অঞ্চলে গ্যাস পাওয়া যাবে না। অথচ কিছু দিনের মধ্যে আপনারা সে গ্যাসও পেতে যাচ্ছেন। পশ্চিম-দক্ষিণ থেকে উত্তর-পূর্ব দিক একটা লাইন টানলে এখন বিদেশীরা বলছে সেখানে তেল পাওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের প্রিয় সিলেট ভূমিতে তেল পাওয়া যাবে অচিরেই, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে তা বের করতে হবে এবং আল্লাহ তায়ালার হুকুমও সেভাবে রয়েছে।
জীবনটাই ভাঙা গড়ার
সমুদ্র থেকে জমি ঊঠানোর ব্যাপারে আমাদের সমস্যা আছে। সমাধানেরও উপায় আছে। নেদারল্যান্ডস থেকে আমাদের দেশ একেবারেই আলাদা। কিন্তু সমস্যারও সমাধান আছে। সেটা অন্যভাবে করতে হবে। নেদারল্যান্ডস থেকে এক্সপার্ট আনলে তারা এর সমাধান দিতে পারবেন না। কারণ তাদের মন তো নেদারল্যান্ডসে। তারা এখানে কাজ করতে পারবেন না। সম্ভব নয়। মনে রাখবেন, জীবনটাই গড়ার ও ভাঙার। যতো গড়বেন তত সমস্যা বাড়বে, যত ভাঙবেন তত সমস্যা বাড়বে। সমুদ্র থেকে জমি উদ্ধার করতেই হবে এবং আমরা তার পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমরা অনেক জায়গায় ভুল করব। ভুলভ্রান্তি থেকেই আমাদের শিখে নিতে হবে।
জেলে অঙ্গদলের বিরাট সম্মেলন হলো। আমি তাদের বললাম, খালি মাছ ধরছেন, কিন্তু উৎপাদন করছেন না। জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। ৩০ বছর আগের তুলনায় জনসংখ্যা দ্বিগুণ। এক সপ্তাহে যদি আপনাদের মধ্যে কেউ এক সের মাছ খেতেন এখন সেখানে আধা সের মাছ খেতে পারেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। কারণ নদীগুলো ভরে গেছে।
চাবিকাঠি গ্রাম
আপনারা মাছ খালি খেয়েই চলছেন, উৎপাদন করছেন না। এ জন্য মাছের এই অবস্থা। আপনারা ভাঙছেন, গড়ছেন না। একটু আগে বলেছি জীবনটা হলো ভাঙার এবং গড়ার। খালি ভেঙে যাচ্ছেন, গড়ছেন না। আমাদের দেশের মাটির নিচে অনেক জিনিস রয়েছে, কয়লা রয়েছে। এক বছর আগে পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এগুলো পাওয়া যাবে না। কিন্তু এখন পাওয়া যাবে, সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে এবং জামালগঞ্জ থেকে কয়লা উঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা কয়লা উঠিয়ে নিতে পারব। তেমনিভাবে অনেক কিছু রয়েছে আপনারা জানেন এবং এর আগেও অনেকবার আমি বলেছি, রাজনীতি ও অর্থনীতির চাবিকাঠি গ্রাম। এটা প্রমাণ করা নিষ্প্রয়োজন। আমাদের রাজনীতি আমরা গ্রামে নিয়ে গিয়েছি। ফল আপনারা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছেন। কারণ আমাদের বিপ্লব বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশের সব মানুষকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাই আমাদের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী পুরুষ, মহিলা, যুবক, ছাত্রছাত্রী, শিশু পর্যন্ত এর অন্তর্ভুক্ত করেছি। কেননা দেশটি সবারই।
শিশুমনে বীজ বপন
শিশুমন থেকেই তাদের আগামী দিনগুলোর জন্য গড়ে তুলতে হবে। আমাদের রাজনীতি আজ কিংবা দুই দিনের রাজনীতি নয়। আমরা এ রাজনীতি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাই চিরকালের জন্য এবং তার ভিত্তি শিশুমনেই দিতে হবে। তার ভিত্তি দিতে হবে ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হলে আমরা অন্য ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারব না। আমি আগেই বলেছি, আমাদের রাজনৈতিক চাপের ঠেলায় বিজ্ঞানীরাই এখন তাদের মতামত, থিওরি পাল্টানো শুরু করেছেন। তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে আপনারা নিশ্চিত হয়ে বিশ্বাস করতে পারেন, আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির চাবিকাঠি গ্রামেই হবে। কারণ আপনারা দুই-তিন বছরের মধ্যে বীজ বপন করে দিয়েছেন। স্বনির্ভর গ্রাম সরকার থেকে শুরু হয়েছে আমাদের পার্টির গ্রামীণ সংগঠন।
একই পেটের ভেতর
এখন অর্থনীতির চাবিকাঠি- রাজনীতি ছাড়া অর্থনীতি হয় না। অর্থনীতি রাজনীতি ছাড়া করা যায় না। অর্থনীতি ছাড়া, রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়া, প্ল্যান ছাড়া রাজনীতি পৃথকভাবে ইন আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে যাবে। রাজনৈতিক মুক্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে সামাজিক মুক্তি আসতে পারে না। কিন্তু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক, এ তিনটি একই সাথে কাজ করে একই পেটের ভেতরে। সেভাবে আমরা এগিয়ে চলছি। আপনারা বলেছেন, আমরা সমাজে সুষম বণ্টন আনতে চাই। কিন্তু বণ্টন যে আনবেন, আনার আগে তো প্রথমে যে জিনিস বণ্টন করবেন সে জিনিসটা বানাতে হবে। জিনিস না থাকলে বণ্টন কী দিয়ে করবেন? সৃষ্টি করতে হবে যেখানে যাদের বেশি আছে। তারা যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে। যাতে ব্যাপারটা স্বর্তঃস্ফূর্তভাবে হয়ে যায়। কারণ আমরা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবসাধন করছি। এ সম্বন্ধে আমি অতীতে অনেক বলেছি, আজ বেশি বলা নিষ্প্রয়োজন।
পকেটকেন্দ্রিক জ্ঞান নয়
সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটা ভেবে দেখা যাক। ভিখারি হিসেবে থাকলে আমাদের সার্বভৌমত্বের মধ্যে যথেষ্ট খুৎ থেকে যাবে। ভিখারি হয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায় না। তাই আমাদের স্বয়ংসম্পন্ন হতে হবে। আমাদের অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আজ বেশ কয়েক বক্তা বক্তব্য রাখলেন। যারা বক্তব্য রেখেছেন তারাও খুব মূল্যবান কথাবার্তা বলেছেন এবং আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আপনারা এসব বিষয়ে যে জ্ঞান অর্জন করলেন, জানলেন, আলোচনা করলেন তা কাজে লাগাবেন। যে জ্ঞান কাজে লাগানো যায় না, যে জ্ঞান পকেট কেন্দ্রিক সে জ্ঞান অর্থবিহীন। আমাদের জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে। আমাদের পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পার্টিতে একতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। একটা সংগঠনের মধ্য দিয়ে আনতে হবে। সেটিই আমাদের উদ্দেশ্য। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আপনারা যেভাবে ইন্টারেস্ট নিচ্ছেন সেভাবে আপনাদের মধ্যে চিন্তাধারার পরিবর্তন আসছে। আমাদের যে লক্ষ রয়েছে তা আমরা অবশ্যই বাস্তবায়িত করতে পারব। আগামীকাল রয়েছে আমাদের ক্যাডার বাহিনীর ওপর আলোচনা, বক্তব্য এবং কালকের আলোচনায় বক্তব্য খুবই তাৎপর্যবহ হবে। অনেক ঝগড়া-বিবাদ হবে বলে আমি আশা করি। আমি আশা করি, আপনারা খুব চিন্তা করে তৈরি হয়ে আসবেন এবং আপনারাই এ সম্বন্ধে বক্তব্য রাখবেন। [সংক্ষেপিত]
টা ই ম লা ই ন
১৯৩৬ : বগুড়ার বাগবাড়িয়ায় ১৯ জানুয়ারি জন্ম।
১৯৫৩ : কাকুল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান।
১৯৫৫ : সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ
১৯৬০ : খালেদার সঙ্গে বিয়ে
১৯৬৫ : পাক-ভারত যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ
১৯৭০ : ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে ট্রান্সফার।
১৯৭১ : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের অধিনায়ক। স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত।
১৯৭২ : ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে পদোন্নতি।
১৯৭৩ : মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি।
১৯৭৫ : চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত। ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিযুক্ত।
১৯৭৬ : প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৭৭ : রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৭৮ : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাগদলের প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ী। একই বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৭৯ : জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সামরিক আইন প্রত্যাহার।
১৯৮১ : চট্টগ্রামে এক সামরিক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত।
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময় সংক্ষিপ্ত—পাঁচ বছরের একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব কাজ করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই পাঠান সম্রাট শেরশাহের অনেক মিল খুঁজে পাই। শেরশাহের শাসনভার ছিল এমনই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জনকল্যাণে, সাধারণ মানুষের মঙ্গলে তাঁর কীর্তিগুলো ছিল যেমন অভিনব, তেমনই অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা আজও তাঁর দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু—সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়-সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা জাতিকে তার সত্যিকারের পরিচয় এবং তার আপন স্বাধীন স্বকীয়তার পরিচিতি তিনি উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। সে পরিচিতি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি ঘটিয়ে ছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তাঁর মন, মনন ও চেতনা—তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। তাই তাঁর প্রিয় গান, যা তিনি আপন মনে গুন গুন করে গাইতেন, ‘আমার জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
দোয়া করি, মহান আল্লাহ উনার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাত নসিব করুন। আমীন
তথ্যসূত্র:
- আমাদের পথ- জিয়াউর রহমান
- আহামেদ, এমাজুদ্দীন; ইসলাম, মাজেদুলl; মাহমুদ, শওকত; শিকদার, আব্দুল হাই (২০১০). তারেক রহমান : অপেক্ষায় বাংলাদেশ. প্রকাশক: জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশান. (ঢাকা). pp. ৩৮৯. আইএসবিএন 984-760-141-0.
- Banglapedia, Shahid Ziaur Rahman
- Banglapedia, Foreign Relations of Bangladesh
- লিওনার্ড, টমাস এম. Encyclopedia of the developing world, Volume 3, p.1440 to p.1444
- জাতীয় দৈনিকসমূহ
বিষয়: বিবিধ
৯৪৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন