নিউক্লিয়ার যুগে বাংলাদেশ :: রিস্কি বাট নেসেসারি :: তেমন ভয়ের কিছু নেই....
লিখেছেন লিখেছেন salam ২৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৭:৪৭:০০ সকাল
পাবনা জেলায় অবস্থিত রুপপুর পরমানু বিদ্যুত কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ-রাশিয়ার নিউক্লিয়ার পাওয়ার এগ্রিমন্টে নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো আজকে "কার স্বার্থে রূপপুর পরমাণু প্রকল্প?" শিরোনামে একটি অনুবাদকৃত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে..... লেখাটি মূলত পিটার কাস্টার্স নামক এক ডাচ ভদ্রলোকের, ডেইলিস্টার লোকটিকে তাদের ইন্টারন্যাশনার কলামিষ্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে [url href=" http://www.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=265964" target="_blank"মূল লেখাটি ছেপেছে"[/url] ... সকালে ঘুম থেকে উঠে বাংলায় এই রিপোর্টটি পড়ার পর অনেকেই ভয় পেয়ে যেতে পারেন… বাংলা রিপোর্টে যে কয়েকটা বিষয়কে বিপজ্জনক বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সে বিষয়ে দুএকটা কথা বলা আবশ্যক মনে করছি.... প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি মূল লিখক কোন পরমানু বিশেষজ্ঞ নন, আমি নিজে এই বিষয়ের ছাত্রও নই.... নিউক্লিয়ার সাইন্স আর পাওয়ার প্ল্যান্ট রিটেলেড সাধারন জ্ঞানের আলোকেই দুএক লাইন লেখার প্রচেষ্টা.....
১. Questions on Rooppur nuclear deal রিপোর্টের কোথাও পিটার সাহেব এটাকে ভয়ানক বিপজ্জনক কিংবা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে এমন কিছু বোঝাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়নি..... বরং শুধুমাত্র "ভয়ের কারনে এটার বিরোধিতা করতে হবে" এমন দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে দেশী সাইন্টিস্ট এবং ইকোনমিস্টদের ইতিবাচক অবস্থানকে যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন.....
২. ড. কাস্টার্স বলতে চেয়েছেন, পুরো ডিলটাতে কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে.... সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে পরমানু চুক্তির সাথে সাথেই কেন এক বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র চুক্তি হতে হবে???? পেছনে কী তাহলে গোপন কিছু আছে??? এটা অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে বিতর্ক চলছে....
৩. পরমানু বিদ্যুত কেন্দ্রের অপারেশন, মেইন্টেনেন্স এবং ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়গুলো হাইলি সেনসিটিভ হওয়ার এতে সেফটি রেগুলেশন্সও অন্যান্য যেকোন প্রযুক্তির তুলনায় অনেক শক্তিশালী এবং কঠোর.... পুরো প্রযুক্তির ভয়াবহ দিক হচ্ছে তেজষ্ক্রিয় পদার্থের ক্ষতিকারক বিকিরন কোনভাবে লিক, ড্যামেজ বা যে কোন এক্সসিডেন্ট মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা..... এটা ছড়িয়ে পড়লে কত ভয়াবহ হতে পারে তা বুঝার জন্য এক http://en.wikipedia.org/wiki/Chernobyl_disaster" target="_blank" target="_blank" rel="nofollow">"চেরনবিল" এর দূর্ঘটনাই যথেস্ঠ...
৪. মূল লিখাটি তিনটি সেইফটি ইস্যুকে হাইলাইক করে কিছু বার্নিং কুশ্চেনকে সামনে নিয়ে এসেছে....
ক. 'নিউক্লিয়ার ফুয়েল রড' কে কূলিং করা হবে পানির মাধ্যমে, যে পানি কয়েকধাপে রিসাইকেল হওয়ার পর ফেলে দেয়া হবে প্রকৃতিতে, যা নদীনালা খালবিল পর্যন্ত পৌঁছাবে.... ঐ পানিতে থেকে যাওয়া তেজষ্ক্রিয়তার মাত্রা মানুষের জন্য হুমকি না হলেও জলজ প্রানীর জন্য হুমকি স্বরুপ... এতে জীববৈচিত্র ব্যহত হতে পারে এবং আশে পাশের জেলেরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবারও সম্ভাবনা থাকবে..... পিটার সাহেব যেহেতু এই বিষয়ের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট নন, তাই তিনি পরিত্যক্ত পানিতে তেজষ্ক্রিয়তার মাত্রা কতটুকু, তা প্রাণীজগতের জন্য ক্ষতিকারক কিনা, হলে তা কতটুকু তা নিয়ে কোন বিস্তারিত অলোচনা করেন্নি.... বরং বুঝাতে চেয়েছেন এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় রিসার্চ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া জরূরী.....
খ. যে প্রশ্নটা অত্যন্ত ভয়াবহ, তা হচ্ছে ফূয়েল রডের ব্যবহারের পর ভয়াবহ মাত্রার তেজষ্ক্রিয়তা সম্পন্ন যে অংশ বর্জ্য হিসেবে ডাম্প করতে হবে তা কোথায় ডাম্প করা হবে???? এই বর্জ্য এতই ভয়াবহ যে এর ক্ষতিকর প্রভার পরবর্তী দশ হাজার বছর পর্যন্তও থাকতে পারে..... সারা পৃথিবীতে একটি উপযুক্ত স্থানের সন্ধান করা হচ্ছে বছরের পর পর... কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি.... সেটা এন্টার্কটিকা হোক, বা সমুদ্রের নিচে তলদেশ হতে মাইলের গভীরে হোক, কোনভাবেই এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে বিশ্ব মুক্ত থাকবেনা.... স্পেস এ ডাম্প করা হলেও তা বিমান যাত্রীদের জন্য ক্ষতিকর হবে.... তাই এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ অত্যন্ত শক্তিশালী স্টোরেজ ট্যান্ক বা সিলিন্ডার বানিয়ে কেউ সাগরে কেউ নির্জন কোন স্থানে টেম্পরারিলি ফেলে রেখেছে.... এমন ঘটনাও ঘটেছে যে আমেরিকান এক শক্তিশালী মাফিয়া বহু বছর ধরে স্টোরেজ হয়ে থাকা এসব বর্জ্য বেআইনিভাবে সোমালিয়াতে ডাম্প করেছে.... অতিমাত্রায় তেজস্ক্রীয় এসব বর্জ্য রিসাইকেল করে পূনরায় পাওয়ার প্ল্যান্টে বা অন্য কোথাও ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়েও রিসার্চে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে, কিন্তু আশাব্যঞ্জক তেমন কোন ফল পাওয়া যায়নি....
প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে যাওয়ার আগে কোরিয়া, চীন, ফ্রান্স, ইউএস, সুইজ্যারল্যান্ড সহ কয়েকটি দেশের সাথে এই বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়, একমাত্র রাশিয়া ছাড়া কেউ এর দায়দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি.... রাশিয়া এই বর্জ্যকে কন্টেইনারের মাধ্যমে ফেরত নিয়ে যাবে....ড. কাস্টার্স এখানে প্রশ্ন তুলেছেন, রাশিয়া বর্জ্য ফেরত নিতে যাওয়ার পথে প্ল্যান্টের মধ্যে টেম্পরারি স্টোরিং, ট্রান্সপোরটেশন ইত্যাদি কার্যক্রমেও তো একটা রিস্ক থেকে যায়... এ প্রশ্নটা আমার কাছে খুব হালকা মনে হয়েছে... অনেকটা এরকম: সাঁতার কাটতে পানিতে নামলে ডুবে মরার ভয় আছে, কুমিরের ভয় আছে, পানি খেয়ে পেট ভর্তি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে...ইত্যাদি...
গ. শেষ প্রশ্নটি সম্পতি ঘটে যাওয়া জাপানের দুটি এক্সিডেন্টের উপর ভিত্তি করে উত্থাপন করা হয়েছে.... আগের দুটি পয়েন্ট থেকে এটা পরিস্কার হয়েছে যে অতিরিক্ত তাপকে এক্সট্রাক্ট করা হয় শীতলীকরন করার মাধ্যমে .... যা একটি কন্টিনিউয়াস প্রসেস.... যদি কোন কারনে কূলিং প্রসেস ফেইল করে তাইলে ডিজাস্টার!!!!... জাপানে যেটা হয়েছিল, ভূমিকম্প হওয়ার কারনে ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়, বিকল্প হিসবে জেনারেটর চালু হওয়া কথা, যা কূলিং প্রসেস কে কন্টিনিউ করতো.... কিন্তু দূর্ভাগ্য, ভুমিকম্পের সাথে সূনামি থাকায় পানির উচ্চতা এত বেশী ছিল যে তা জেনারেটর রুমকে ফ্লাডেড করে ফেলে, ফলে বিকল্প বিদ্যুত পাওয়া যায়নি, কূলিং প্রসেসও ফেইল করে.... এর পর যা হওয়ার তাই হলো!!!!!!
এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, বাংলাদেশে বন্যা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার..... এখানে প্ল্যান্ট ডিজাইনে এই ইস্যুকে বিবেচনা করা হয়নি বা হবেনা, এরকম সফিস্টিকেটেড টেকনোলজির ক্ষেত্রে এমনটা ধারনা করা আমার কাছে এবসার্ড মনে হয়... তবে ড. কাস্টার্স প্রশ্নটি তুলে বিষয়টা যে জনসাধারন সবার সামনে এনেছেন, তার জন্য তিনি বড়সড় একটা ধন্যবাদ পাবার দাবীদার! সর্বোচ্চ সেফটি স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা হোক, এদাবী দেশের সকল নাগরিকের প্রাণের দাবী হওয়া উচিৎ.... কারন কিছু একটা ঘটলে তাকে সামাল দেয়ার মত আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ধারে কাছেও আমরা নেই.....
৫. এবার দেখা যাক, প্রথম আলোর কেরামতি.... এরা কিভাবে সবকিছুকে বদলে দিতে চায়, তার একটা ছোট্র নমুনা ...
ক. প্রথমেই হেডিংটা দিয়েই বিরাট একটা প্রশ্ন দাঁড় করানো হয়েছে, যাতে মনে হবে এটা বুঝি দেশের স্বার্থ রক্ষা না করে অন্যকিছু করবে... কিন্তু ডেইলিস্টার দেখুন, সেখানে হেডিংটা ভিন্ন, পজিটিভ এবং যৌক্তিক......
খ. প্রথম বাক্যটা দুইটা পেপার থেকে তুলে দিলাম, দেখুন কোনরকম ভিন্নতা পান কিনা??? প্রথম আলো>> "রূপপুরে দুটি পরমাণু জ্বালানিকেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে তেমন প্রশ্ন ওঠেনি।" আর ডেইলিস্টারের ভাষা>>Few critical questions have been raised so far by Bangladesh's intellectual community regarding the deal towards the construction of the two nuclear power plants in Rooppur.
গ. "রূপপুর প্রকল্প ও প্রতিরক্ষা চুক্তি আসলে কতটা বাংলাদেশের স্বার্থে হয়েছে? জরুরিভাবে বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার।" এ হচ্ছে প্রথম প্যারার শেষ লাইন.....আর স্টারের বক্তব্য: "Yet whether the Rooppur deal and the sequential defence deal -- both involving huge sums of public money -- are really in the interests of Bangladesh is a question that need to urgently be scrutinised.".... পরমানু চুক্তির পরপরই সমরাস্ত্র চুক্তি কতটুকু বাংলাদেশের জনগনের স্বার্থ রক্ষা করবে সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে... রুপপুর প্রকল্পের স্বার্থকতার ভুত শুরুতেই পাঠকের মাথায় এমনভাবে ঢুকে আছে যে পাঠক এই লাইনে এসে ভুলেই যাবে যে স্বার্থরক্ষার বিষয়টা সমরাস্ত্র চুক্তি নাকি রুপপূর প্রকল্পের সাথে জড়িত.......
ঘ. "২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় আরেকটি পরমাণু বিপর্যয়ের পর রাশিয়ায় একটি তথাকথিত ‘স্ট্রেস টেস্ট’ করা হয়। তাতে দেখা যায়, জাপান ও রাশিয়ার রি-অ্যাক্টরগুলো একই রকম কিছু মৌলিক ত্রুটিযুক্ত।" .... এখানে পরের লাইনটি পুরোই মিসলিডিং মনে হচ্ছে... মূল লেখায় এমন ইঙ্গিতবাহী তেমন কিছু পাইনি...... শুধু রাশিয়া আর জাপান কেন, সূনামি প্রবন এলাকায় প্ল্যান্ট থাকলে বিশ্বের যেকোন জায়গায়ই পাওয়ার সাপ্লাই কমপ্লিটলি ফেইল করার চান্স থাকবে, যদিনা জেনারেটর অনেক উঁচুতে স্থাপন করা হয়, অথবা ওয়াটার প্রুফ করা হয়.... তবে জাপানের ঘটনার পর সবারই টনক নড়েছে এব্যাপারে নূতন করে সেফটি রেগুলেশন এডপ্ট করার..
সবকথার শেষকথা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরমানু বিদ্যুতের বিকল্প নেই.... পুরো জিনিসটা হাইলি সেনসিটিভ হওয়ার কিছুটা রিস্ক থাকবেই.... ওটা হিসেব করেই আগাতে হবে..... রিস্কি হলেও এই নেসেসিটি'কে পাশ কাটানোর কোন অল্টারনেটিভ আছে বলে মনে হয়না..... সৌদি আরব সম্প্রতি ৪০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েক ডজন রিয়েক্টর স্থাপন করার দিকে আগাচ্ছে, টার্কি ২৫(সম্ভবত) গিগাওয়াটের প্ল্যান্ট বসানোর প্রাথমিক ডিল আরীভা-মিটসুবিসি কনসোর্টিয়ামের সাথে সেরে ফেলেছে.... সৌদি বিদ্যুত মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, জাপানের ঘটনার পর সৌদির কী পরমানু বিদ্যুতের দিকে যাওয়া ঠিক হবে?? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রে জাহাজ চলাচল কী বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, কোন বিমান দূর্ঘটনার পর কী আকাশে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে?? বরং টেকনোলজি আগের চেয়ে আরো আপডেটেড এবং সফিস্টিকেটেড হয়েছে যাতে আগের দূর্ঘটনার পূনরাবৃত্তি না ঘটে....
বিষয়: বিবিধ
২১৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন