আসিফ নজরুলের লেখা 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ' এবং আমার অর্বাচীন মন্তব্য।

লিখেছেন লিখেছেন আয়নাশাহ ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০১:৪৩:১৪ দুপুর

আজকের প্রথম আলোতে স্বনাম খ্যাত লেখক এবং বুদ্ধীজিবী ডঃ আসিফ নজরুলের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখটা বিডি টুডে এর ম্যগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছে। আসিফ নজরুল সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক এবং ডাক সাইটে লোক। আমি তার ছাত্র হবারও যোগ্যতা রাখিনা। তিনি যা জানেন এবং জানান তা আমার জন্য বিরাট এক বিষয়। তার লেখার বিপরীতে আমার মতো কেউ কথা বলুক তা নিশ্চয়ই পাঠকরা চাইবেন না।

কিন্তু আমি আজ কলম ধরেছি আসিফ নজরুল সাহেবেরই একটা সাহসী কথার জন্য। সেদিন এক টক শোতে তিনি বলেছিলেন, আইন হলো একটা কমন সেন্সের বিষয়। আইন নিয়ে চিন্তা করতে হলে আইনের পন্ডিত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তার এই কথাটাকে নিজের শক্তি ভেবে নিয়েই আজকের এই লেখা। আর কিছু না ই বা জানলাম, মানুষ হিসেবে কমন সেন্স থেকে যা আমার সেন্সে ধরা পড়েছে (জানিনা এটাকে তিনি কমন সেন্স বলে মেনে নেবেন কিনা) তা ই এখানে বিবৃত করতে চাই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তার মত হলো, কেউ এর বিরোদ্ধে কথা বলতে পারবে না। তার লেখায় তিনি বলেন "আমাদের মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া, এর ধরন, একে রাজনৈতিক সুবিধালাভের জন্য ব্যবহারের চেষ্টার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু তাই বলে এই বিচারের যৌক্তিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই।" কথাটা এখানে এমন ভাবে বলা হলো যেমন করে আমেরিকার প্রসিডেন্ট বুশ বলতেন। আমরা ইরাক দখল করবো, আফগানিস্তানকে বিরান বানাবো তাতে কেউ আপত্তি করতে পারবে না। যারাই আপত্তি করবে তারাই আমাদের শত্রু। আপনি হয় আমাদের সাথে থাকবেন নতুবা আপনিও আমাদের শত্র হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এটা কি করে গণতণ্ত্রের ভাষা হয়? আপনি আপনার চিন্তায় যাকে যুদ্ধাপরাধ মনে করেন আমার দৃষ্টিতে তা না ও হতে পারে। এর পর রয়ে গেলো আসল যুদ্ধাপরাধের সঙ্গা নির্ধারণের বিষয়টি। ১৯৭৩ সালের যে আইনটি ১৯৫ জন চিহ্ণিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত হয়েছিল তাতে তাদেরকে এবং কেবল মাত্র তাদেরকেই যুদ্ধাপরাধী বলে সঙ্গায়িত করা হয়েছিল। এর পর আসিফ নজরুল সাহেবও জানেন কি করে শেখ সাহেব ডঃ কামালকে দিয়ে ইন্দিরাজীর মনোবাঞ্চা পুরণের জন্য এই ১৯৫ জনকে ভারত মাতার কোলে সমর্পন করেছিলেন এবং তারা ইন্দিরাজীর স্বার্থে ফেরত গিয়েছিলেন। এর পর আসিফ নজরুল সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, পাশ করলেন, পত্রিকায় চাকুরী করলেন, আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেন। এর মাঝখেন কিন্তু এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চোখের সামনে অনেক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। আমি বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে না বলে ঢ বি তে সংঘঠিত অপরাধ গুলোর কথা এজন্য বললাম যে, এই দীর্ঘ সময়ে ঢা বিতে সংঘঠিত অপরাধ গুলোর একটারও বিচার হয়নি। বিচার হয়নি আরো অনেক অপরাধের। কিন্তু বিচার হতে হবে ৭১ এর চিহ্নিত অপরাধী দের সাথে যারা রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন তাদের। আশ্চর্য কথা। ঢাবিতে সাত মার্ডার যিনি করলেন তার বিচার দরকার নেই, যিনি ঐ মার্ডারের আদেশ দিলেন, অস্ত্র দিলেন, মার্ডার কারীকে আশ্রয় দিলেন ওদের কারো বিচার হোক বা না হোক, ঐ সময়ে হলে থেকে যারা ঐ মার্ডার দৃশ্য দেখলেন কিন্তু বাধা দিতে পারলেন না তাদের বিচার করতেই হবে। ওরা কেনো দেখলেন, কেনো ওরা বাধা দেন নাই? বাধা দেন নাই মানেই হলো ওরা ঐ মার্ডার কারীদের সহায়তা করেছেন। কারন তারা হল থেকে চলে যান নাই, হলে থেকে হামলা কারীদের সাহায্য করেছেন। এমন একটা কথায় কি করে কমন সেন্স থাকে?

আমাদের মুক্তি যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ এবং ভারত/রাশিয়া পন্থীরা ছাড়া এমনকি মাওলানা ভাষানী এবং তার দলের কেউও ভারতে আশ্রয় পান নি। মাওলানা ভাষানীকেও পুরো নয়মাস বন্দি হয়েই থাকতে হয়েছে। তার দলের লোকদেরকেও একই অস্থায় কাটাতে হয়েছে। অনেককেই শীমন্ত থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। তারা যেমন দেশের ভেতরেও ছিলেন অবাঞ্চিত তেমনি ভারতেও। বিএনপি'র সাবেক মহাসচীব নরশিংদির এমপিকেও দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এমনি অবস্তায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইসলাম পন্থীদের অবস্থা আরো খারাপ ছিল। তারা না পেরেছেন ভারতীয় পরিকল্পনাকে মেনে নিতে না পেরেছেন ভারতে চলে যেতে। তাদেরকে বাধ্য হয়েই হলে থাকার মতো করে দেশেই থাকতে হয়েছে এবং পাকীদের নির্যাতন নিপীড়নকে সহ্য করে দেখতে হয়েছে। এই দেখাই তাদের কাল হয়েছে যেমন হলে থেকে সাত মার্ডার দেখাটা। আপনারা এসব দেখেছেন তাই এখন আপনাদের শাস্তি পেতে হবে??

হায় আইন, হায় কমন সেন্স!

১৯৭৩ সালের ঐ আইন যখন করা হয় তখন দেশীয় অপরাধীদের জন্যও আইন করা হয় এবং সেই আইনে অনেকের বিচার এবং সাজাও হয়। লাখ লাখ লোককে জেলবন্দি করে রাখা হয়। সে সময়ের বিচারে বর্তমান বিচারের সম্মুখীন কেবল অধ্যাপক গোলাম আজম বাদে জামায়াতের কাউকেই এরেস্ট করা হয়নি, তাদের কারো বিরোদ্ধে কোনো মামলাও করা হয়নি, কোথাও কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি এমনকি পত্র পত্রিকায়ও তাদের কারো বিরোদ্ধে কোনো কথা লেখা হয়নি। গোলাম আজমের বিরোদ্ধেও কোনো অপরাধের মামলা হয়নি। তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার নাগরিকত্ব আরো অনেকের সাথে কেটে দেয়া হয়। পাকিস্তানি শাষক গোষ্টির সহায়তা কারী তখন শুধু এরাই ছিলেন না বরং তাদের চেয়ে অনেক বেশী পেশী শক্তি এবং রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন দেশের সব ইসলাম পন্থী রাজনৈতিক দল ও নেতারা। সরাসরি যারা মাঠে ততপরতা চালিয়েছেন তাদের কাউকে বিচারের সম্মুখিন করা হলোনা, কেবল দায়ী করা হচ্ছে জামায়াতের নেতৃত্বে আসীন লোকদেরকে। এটা কি করে কমন সেন্সে ধরে?

এর পর আসি আইনি ব্যখ্যায়। ১৯৭৩ সালের আইনে যেসব আপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে সেটা ঐ সময়ের ১৯৫ জনের জন্যই প্রণীত হয়েছিল। আইনের ভাষায় রেট্রস্পেক্টিভ এফেক্ট বলে একটা কথা আছে তা হলো এ যে, যে সময়ে অপরাধ সংগঠিত হয় সেই সময়ের আইনেই এই অপরাধের বিচার হবে, পরে প্রণিত আইনে নয়। যেমন একটি অপরাধের সাজা যদি ১৯০০ সালের আইনে দশ বছরের জেল হয় এবং ২০০০ সালের আইনে একই অপরাধের সাজা যদি যাবজ্জীবন দন্ড হয় তবে ১৯৯৯ সালে সংগঠিত ঐ অপরাধের সাজা যাবজ্জীবন দেয়া যাবেনা যদিও এর বিচার ২০১৩ সালে হয়। অর্থাত ২০০০ সালের আইনে ১৯৯৯ সালের অপরাধের বিচার করা যাবেনা, বিচার করতে হলে ঐ সময়ের আইনেই করতে হবে। ঐ সময়ের আইনে যদি ঐ অপরাধের কোনো শাস্তি না থাকে তবে অপরাধী খালাস পাবে যদিও ২০০০ সালের আইনে তা শাস্তিযোগ্য হয়। সে হিসাবে ১৯৭৩ সালের আইনে পাকিস্তানি সহযোগীদের বিচার করা আইনের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। ততকালীন সময়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করা তাদের পক্ষে কাজ করাকে অপরাধ বলে গণ্য তো হয়ইনি বরং তা করণীয় ছিল। তখন যে কাজকে অপরাধ বলে আইনে সাব্যস্ত করা হয়নি পরবর্তীতে আইন করে সেই কজের বিচার করা নেহাত প্রতিহিংসা পরায়নতা ছাড়া আর কি হতে পারে? এখানে শতসিদ্ধ একটা আইনকে সরকার গায়ের জোরে চালিয়ে দিচ্ছেন যা আইনের লোক হয়েও ডঃ আসিফ নজরুল তা দেখছেন না বা না দেখার ভাব করছেন।

আসিফ সাহেবের খুবই সমস্যা হলো, জামায়াত কেনো আন্দোলন করে। এইসব নেতাদেরকে ফাঁসি দিতেই হবে, কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। যদিও তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কাজ কারবার নিয়ে কিছু কথা বলেছেন তবে তার মুল কথা হলো এদের পক্ষে কেউ কথা বলতে পারবে না। জামায়াতের উচিত নিজেদের নেতাদের ফাঁসি দেবার জন্য রসিটা এগিয়ে দেয়া। মানুষ কতোটুকু অন্ধ হলে এমন কথা বলতে পারে? একটি রাজনৈতিক দলের সবগুলো নেতাকে ১০০% মিথ্যা অজুহাতে ফাঁসিতে ঝুলাবে একটা তাবেদার সরকার আর সেই দলের লোকেরা নাকি এর প্রতিবাদ না করে ফাঁসীতে সহযোগিতা করব? একেই নাকি বলে আসিফ নজরুলদের কমন সেন্স!

জামায়াত শিবির কেনো গাড়ি ভাঙ্গে, কেনো পুলিশ পিটায় এটা তার বুঝতে কষ্ট হয়। যেনো তিনি বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রাম আর দেখেন নি। চারটি বছর ধরে একটা বৈধ রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন এবগ ওয়ার্ড কার্যালয় পর্যন্ত রেব পুলিশ দিয়ে তালা বদ্ধ করে রাখা হয়েছে অথবা ছাত্র লীগকে দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দলের সাধারণ কর্মীরা নিজেদের বাড়িতে বসেও কুরআন হাদিস চর্চা করতে পারেনা, ওগুলো হয়ে যায় জিহাদি বই আর ধরে নিয়ে সাত দশ দিনের রিমান্ড। নিজেদের অফিসে নিরিহ পর্দানশীন নারীরাও রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিদিন হত্যা গুম আর নির্যাতন নিত্যদিনের ঘঠনা। আসিফ নজরুলরা এইসব কিছুই দেখেন না কিন্তু তারা গণতন্ত্র ঠিকই বুঝেন। একটা সভা সমাবেশ, মিছিল মিঠিং কিছুই করতে পারেনা জামায়াত। মিছিল বের করলেই পুলিশের পিটুনি। এমনকি প্রসক্লাবেও একটা গোলটেবিল বৈঠক করতে পারবে না জামায়াত। ঢ বি তে আসিফ নজরুলের সহকর্মীরা নিজেরা নিজেদের বাসায় আড্ডাও দিতে পারবে না। ঢা বি'র শিক্ষক হলেও তারা তখন হয়ে যান জিহাদী। আসিফরা তখন নিরব হয়ে গণতন্ত্র চর্চা দেখেন ঠিকই। দেশের কমপক্ষে ৭% লোকের (আমার মতে ১৫% এবং 'র' এর হিসাবে ২৫%) প্রতিনিধিত্ব কারী একটি সংগঠনের নেতাদেরকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রেখে এখন ফাঁসী দেবার পাঁয়তারা করবে সরকার আর সেই দলের লোকেরা বসে বসে আসিফ নজরুলের প্রবন্ধ পড়ে বাক বাকুম ডাকাবে সেকথা তিনি কি করে ভাবেন?

জানি তিনি একজন বাম চিন্তা ধারার মানুষ। জামায়াতকে শেষ করতে পারলেই তাদের পোয়াবারো। এটা তারা চাইতেই পারেন। কিন্তু তাঁর মতো কারো একথা ভাবা এবং বলা যে কতোবড়ো বোকামী যে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে হলেও তাদের কর্মাকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একেই মনেহয় বলে গাছে কাঁঠাল আর গোঁফে তেল?

বিষয়: রাজনীতি

১৪৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File