ফিরে দেখা অতীত
লিখেছেন লিখেছেন লোকমান ১০ মে, ২০১৪, ০৪:৫০:৫৩ বিকাল
আজ কয়েক দিন যাবত কিছুই ভালো লাগছে না। অতীতে ফেলে আসা দিনগুলো খুব মনে পড়ছে। আসলে প্রবাস জীবনটাই এমন কখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে আনন্দ লাগে, আবার কখনো অতীতের দিনগুলো মনে করে খুব কষ্ট লাগে। পিছনে ফেলে আসা দিনগুলো আজ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বারবার। সোনালী দিনগুলো মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে। হায় কতই না মধুর ছিল সেই দিনগুলো। বাঁশ বাগান থেকে মারবেল খেলে এসে বাবার বকা খাওয়া তখন খারাপ লাগলে ও আজ মনে হয় সেই দিনগুলোই মজার ছিল। আর মাষ্টার কাকাদের পুকুরে গোছল করতে গিয়ে বাঁশের দুই মাথায় দুইজন বসে নৌকা চড়ানো, পানির নিচে পা দিয়ে বালু গর্ত করে কুপ বানানো উফ্ কতই না মজার ছিল। তবে আমি বেশী বড় গর্ত করতে পারতাম না। সবচেয়ে বড় গর্ত করতে পারত শামছূ। গর্ত করা শেষ হলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম আর চারিপাশ থেকে বালু এসে আমাদের পা আটকে যেত। মাস্টার কাকা যখন আমাদের উপস্থিতি টের পেত তখন কাকা কঞ্চির লাঠি নিয়ে আমাদের দৌড়াত আর আমরা লুঙ্গি ফেলেই দৌড়ে ধান ক্ষেতের দিকে চলে যেতাম। প্রবাসে বসে সেই কথা গুলো বারবার মনে পড়ে। আজ ও সেই পুকুরটি আছে তবে মাষ্টার কাকা আর দুনিয়াতে নেই। (আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুক)।
মাষ্টার কাকার একটি তরমুজ ক্ষেত ছিল। অনেক তরমুজ হত। রাসেল আর আমি সেই তরমুজ চুরি করে খাল পাড় যেয়ে খাইতাম। কত্ত মজা লাগতো বলে বুঝাতে পারব না। (রাসেল হল মাষ্টার কাকার বড় ছেলের ছেলে অর্থাৎ আমার ভাতিজা হয়। সমবয়সী হওয়ায় সব সময় বন্ধুর মত চলাফেরা করতাম) তবে আমরা কিন্তু বড় চোর ছিলাম না। মাত্র একটা তরমুজ চুরি করতাম আবার তা নিজেরাই খেয়ে ফেলতাম। বলুন তো একে কি চুরি বলা যায়? তা আবার রাসেলের দাদার ক্ষেতের। এসব কীভাবে ভুলে থাকব এই প্রবাসে?
বিকেল বেলা সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ত গাছপালা আর মানুষের ছায়া বিশাল আকৃতি ধারন করত ঠিক তখন গ্রামের গাঁ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সরপিল আকারের কাঁচা রাস্তাটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত টহল দেয়া যেন আমাদের দৈনন্দিক ডিউটি ছিল। যখন ঘরামী বাড়ির মোড়ে পৌছতাম তখন ঢালী বাড়ীর দিকে বারবার তাকাইতাম পিচ্চি একটি মেয়েকে দেখার জন্য। ঐ বাড়িতে পিচ্চি একটি মেয়ে ছিল, মেয়েটি খুব সুন্দর করে হাঁসতো আর আমাদের সাথে দুষ্টামি করত। সেই মেয়েটি আজ বড় হয়েছে ওর নাকি বিয়ে ও হয়েছে শুনেছি। বিকেল বেলা আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম আর হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা নেমে আসত। সন্ধ্যার হিমেল হাওয়া আমাদের গায়ে এসে পরশ বুলাত। পাখিদের কিচির মিচির আওয়াজ আর মুয়াজ্জিনের সু-মধুর আজানের ধ্বনি বাতাসে ভেসে আসত। সাদা বকের দল মাথার উপড় দিয়ে উড়ে যেত বাঁশ ঝাড়ে। গাঁয়ের ছোট কুটিরে সন্ধ্যা বাতি জ্বলে উঠতো মিটমিট করে। আমরা ততক্ষণে বাড়ি এসে হাত পা ধুয়ে নিজ নিজ পাঠে মন দিতাম। এসব কথা আজ বারবার মনে পড়ে।
এখন শীতকাল খেজুর রসের দিন। আজ অনেক দিন যাবৎ খেজুরের রস পান করা হয় না। মরুর দেশ সৌদি আরবে অনেক খেজুর গাছ থাকলে ও এ দেশের খেজুর গাছে রস হয় না। এখানে গাছি পিছনে মাটির হাড়ি ঝুলিয়ে গাছে উঠেনা রস নামাতে। আমার আজ খুব শখ জাগে এক টুকরো পাট খড়ি নিয়ে গাছে উঠে হাড়িতে নল বসিয়ে রস পান করতে। আর ভোর বেলা খেজুরের রসে ভিজানো পিঠা খেয়ে ঠকঠক করে শীতে কাঁপতে। কতই না মজার দিন ছিল।
এখন ছোট বোন দুটি (সালমা/শারমিন) খাবার নিয়ে বসে থাকেনা ভাইয়া আসলে একসাথে খাবে বলে। এখানে নেই মায়ের আদর বাবার শাসন। এখানে নেই ভাতিজা ভাতিজি আংকেল বলে ডাকার জন্য। আজ কতদিন হল ভাগিনা ভাগ্নিদের মামা ডাক শুনি না। শোনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। আগের চেয়ে বড় হয়েছি, দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছি। অনেক কিছু পেয়েছি হারিয়েছি তার চেয়েও বেশী। পাওয়ার আনন্দ আজ পরজিত হারানোর বেদনার কাছে।
টাই স্যুট পড়ে অফিসে যাওয়া, চেয়ারে বসে দোল খাওয়া, হিসাব কিতাবের বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে কম্পিউটারে Excel File ওপেন করা নাহ্ আমার কিচ্ছু ভালোলাগে না। অফিসে বসে চা, কফি, গাওয়া খেতে আমার ইচ্ছে করে না। আমার মন চায় রাস্তার পাশে দাড়িয়ে ঝাঁল মুড়ি আর চঁটপঁটি খেতে। অফিসে বসে স্যার ডাক শুনতে চাই না আমি। আমি চাই রোদেলা দুপুরে ক্রিকেট খেলে এসে মায়ের বকা খেতে। এ/সি আর আলোকসজ্জা রুমে বসে টিভি দেখতে মন চায় না আমার। আমার মন চায় সন্ধ্যা রাতের শীতল হাওয়ার উঠানে বসে দাদির কাছে চাঁদ মামার গল্প শুনতে আর নারিকেল গাছের পাতা ভেদ করে আসা চাঁদের আলোয় আলোকিত উঠান দেখতে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমার এই আশাগুলো আর কখনো পূরণ হবে না, দেখবে না আলোর মুখ। কেননা অতীতকে তো আর ফিরে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার পাগল মন তো সে কথা মানতে নারাজ। আমি যতই আমার মনকে বুঝাইতে চাই আমার পাগল মন ততই রঙ্গের ঘোড়া দৌড়াইতে চায়। আর চিৎকার করে বলতে থাকে বিধাতা ফিরে দাও সেই অতীত, ফিরিয়ে দাও সেই সোনালী দিনগুলি যেখানে নেই কোন চিন্তা ভাবনা আর না পাওয়ার বেদনা। যেখানে আছে শুধু সুখ আর অনাবিল শান্তি।
বিষয়: বিবিধ
৩৬০৪ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
'অতীত দিনের স্মৃতি, কেউ ভুলে না কেউ ভুলে'
গানটি শুনুন আর স্মৃতি পুনরায় রোমন্থন করুন। অথবা এখানে দেখুন।
ধন্যবাদ আপনাকে শেয়ার করার জন্য---
করত সবাই আদর,
বড় হয়ে এখন মাথায়
হাজার কাজের বহর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন