ধারাবাহিক গল্পঃ০২ বড় ছেলের বড় মেয়ে
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০১:২৩:০৯ দুপুর
ধারাবাহিক গল্পঃ০২ বড় ছেলের বড় মেয়ে
হঠাৎ পিঠে চাপর দিয়ে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে আলাল কি করছিস”?
সম্বিত ফিরে পেয়ে যাকে দেখল সে তার মামাতো ভাই জয়নাল।
জয়নাল ভাই তার চেয়ে ৫ বছরের বড়। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। টানাটানির সংসার তাই ঢাকার কবি নজরুল কলেজে রাত্রীকালিন সিফটে বিএতে ভর্তি হয়েছে, আর দিনে সিটি ওয়েল মিলে কারণিকের চাকুরী করছে। ছয় মাস পর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই প্রথম বাড়ি ফিরল।
জয়নাল বড় একটা ঢাকাইয়া পাউরুটি নিয়ে ফুফুর সাথে দেখা করতে এসেছে। জয়নালের ফুফু, অর্থাৎ আলালের মা অনেকদিন পরে ভাতিজাকে দেখে খুবই খুশি হলেন। দুলাল, হেলাল, আলালী, দুলালীদের মনেও খুশির বান ডেকেছে। তবে তা জয়নালকে দেখে নয়, বরং ঢাকাইয়া পাউরুটি খেতে পারবে সেই আন্নদে! এর আগেও ওরা অনেককে ঢাকা থেকে বড় পাউরুটি নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে নিজেদের বাড়ির দিকে হেটে যেতে দেখেছ, কিন্তু কোন দিন তা খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।
সবাই যখন খুশির বন্যায় ভাসছে, তখন একমাত্র আলালই গুরুগম্ভীর হয়ে জয়নালের গাঁ ঘেষে দড়িয়ে আছে!
- কিরে আলাল কি হল কি ভাবছিস?
- এমন প্রশ্নেও আলালের ভাবান্তর হল না!
আলালের মা সংসারের সুঃখ-দুঃখের বৃত্তান্ত ভাতিজাকে খুলে বলল। আলালের লেখাপড়া আর চালিয়ে নিতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করল।
- “চিন্তা করবেন না। ফুফু, আলাল যেহেতু ভালো ছাত্র, তাই আমিই ওকে পড়াব”।
- ভাতিজার কথা শুনে আলালের মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল, কিন্তু তার পরেও আলালের কোন ভাবান্তর নাই!
৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত জয়নালের ছুটি ছিল যা ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে তাই বিকেল বেলা ঝালকাঠি থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামি জাহাজে চড়ে ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে দৃঢ় পদে জাহাজ ঘাটের দিকে যাচ্ছে। অন্য দিন হলে আলালও জয়নালের সাথে জাহাজ ঘাটে যেত, কিন্তু আজ আলালের মন খারাপ। তাই ওদিকে না গিয়ে জয়নালের চোখ এড়িয়ে ভোঁ দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে জয়নাল কোথাও আলালকে দেখতে পেলনা, ওদিকে আলালদের বাড়িতে গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসার সময়ও নেই।
জয়নাল জাহাজে উঠে সুবিধামত দোতলার ডেকে একটা পাতলা কাঁথা বিছিয়ে বসে পরল। জাহাজ গুলোতে পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী বা বড় অফিসারদের জন্য ক্যাবিনের ব্যবস্থা, আর সাধারণ যাত্রীদের জন্য খোলা ডেকে কম ভাড়ায় যাবার সুবিধে আছে। সেক্ষেত্রে যাত্রীরা নিজেদের প্রয়োজন মত পাতলা কাথা, বিছানার চাদর, পাটি, মাদুর বা হোগলা বিছিয়ে বসার এবং রত্রে শোয়ার ব্যবস্থা করে। অবশ্য যাত্রীর সংখ্যা বেশী হলে অনেক সময় সে সুযোগ পাওয়া যায়না, তখন কোনমতে বসে বা অনেক সময় দাঁড়িয়ে বা খোলা ছাদে বসেও ভ্রমণ করতে হয়।
জাহাজটা নদীর বুক চিড়ে যখন ঢাকার দিকে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ করে জয়নাল দেখল একটা পোটলা হাতে আলাল তার দিকেই এগিয়ে আসছে। জয়নাল হতভম্ভ হয়ে আলালের দিকে তাকিয়ে রইল। আলালের মুখে কোন কথা নাই। ভয়ে, ইতস্ততায়, জড়সড় হয়ে জয়নালের বিছানা ঘেষে জাহাজের রেলিং ধরে এমন ভাবে দাঁড়াল, যাতে মনেই হবেনা যে সে জয়নালকে চেনে! জয়নালও কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে আলালের দিকে তাঁকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর জয়নালই উঠে গিয়ে আলালের হাত ধরে বিছানায় এনে বসাল। ততক্ষণে আলালের ভয় আর সঙ্কার বরফ যেন গলে গেলে, জয়নালের পায়ে পরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। জয়নাল কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
-কাঁদিসনা, চল ঢাকায় চল। দেখি তোর জন্য কি করা যায়। তা বাড়িতে কি ফুফুকে বলে এসেছিস”?
-হ্যাঁ বলেছি।
-কি বলেছিস?
-বলেছি, তুমিই আমাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাচ্ছ, তাই তোমার সাথে ঢাকায় যাচ্ছি। এই দেখ, মা তোমার জন্য মুড়ির মোয়া দিয়েছে।
জয়নাল এবার সত্যিই মহা চিন্তায় পরে গেল। হায় আল্লাহ্! ফুফু হয়ত ভেবেছে আমি ঢাকায় নিয়ে আলালাকে স্কুলে ভর্তি করে দিব। আমার নিজেরই চাল চুল নাই, থাকি মেসে, এমন অবস্থায় সারা রাত দু’ভাইয়ের কারো ঘুম হল না। কি ভাবে হবে? এযে অনিশ্চিৎ গন্তব্যের দিকে এক মহা যাত্রা।
বিষয়: সাহিত্য
৭২৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন