ধারাবাহিক গল্পঃ ০১ বড় ছেলের বড় মেয়ে
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:০৯:৩১ সন্ধ্যা
ধারাবাহিক গল্পঃ ০১ বড় ছেলের বড় মেয়ে
০১
থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেটের মত ভাসমান নৌকায় দেশের সর্ব বৃহৎ পেয়ারার বাজার ঐতিহ্যবাহী ভিমরুলী, আটঘর, কুড়িয়ানা বাজার যে জেলায় অবস্থিত তা দক্ষিণ বঙ্গের নদী বিধৌতা ঝালোকাঠি।
যেখানে গেলে বাগানে ঢুকে ইচ্ছেমত পেয়ারা খাওয়া যায় বিনে পয়সায় এবং কিনে নেয়া যায় স্বজনদের জন্য খুব সস্তায়।
পেয়ারা আর ইক্ষুর মৌসুম শেষ হলে আসে আমড়ার মৌসুম যা সিলেটের কমলার চেয়েও বিখ্যাত, যেকারণে সিলেটবাসি এক সময় শ্লোগান দিত, ‘আমড়ার চেয়ে কমলা ভালো, আমড়া কেন বিভাগ হল’?
ঝালোকাঠির সুপারির কথা নাহয় নাইবা বললাম, কারণ ঝালোকাঠির সুপারি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও যেখানে বাংলাদেশীদের অবস্থান আছে সেখানেই পানের পিকের সাথে উন্নত বিশ্বের সুরম্য অট্টালিকাগুলোতে দেশীয় ছাপ একে দিচ্ছে স্বগৌরবে!
সেই জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে খেটে খাওয়া মা বাবার কুঁড়ে ঘরে চাঁদ মুখ নিয়ে যে ছেলেটি কিছুক্ষণ আগে দুনিয়ায় এসেছে মা-বাবা আদর করে তার নাম রেখেছে আলাল।
দিন যায়, রাত যায়, আলাল বড় হয়। বড় হতে হতে আলালের বয়স যখন ১৫ বছর তখন আলাল আর একা নয়। ততদিনে খেলার সাথী হয়ে আলালের ভাই দুলাল, বোন আলালী, দুলালী আর সবার ছোট্ট ভাই হেলালও দুনিয়ায় এসে হাজির!
দুমুঠো খেয়ে পরে ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল আলালদের সংসার। কিন্তু কিভাবে যে কি হল! ৭৪এর দুর্ভিক্ষে সব এলোমেলো হয়ে গেল।
সন্তানদের মুখে দুমুঠো নুন ভাত দেয়ার মত যখন আর কোন উপায় রইলনা তখন আলালের বাবা একে একে হালের বলদ, দুধের গাভি এবং ঘরের টিন পর্যন্ত বেচে দিতে বাধ্য হল।
৭৫এ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হল বটে কিন্তু আলালদের দুঃখ ঘুচলনা। ঘুচবে কি করে? আলালদের গাভী তো এখন আর দুধ দেয়না, বলদ তো হাল বায়না, ঘরের চালে তো টিন নেই, সবই তো ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাতে সেই ৭৪এই পানির দামে বিক্রি হয়ে গেছে!
মুক্তিযুদ্ধ করেও আলালের বাবা সার্টিফিকেট পায়নি যা দেখিয়ে সরকারী সামান্য সাহায্য পেতে পারত! অথছ অনেকেই যুদ্ধে নাগিয়েও এমনকি উপযুক্ত বয়স হওয়ার পরেও খাটের নিচে লুকিয়ে স্রেফ একদিন ট্রেঞ্চ খুড়বে বা ড্রন বানাবে এমন স্বপ্ন দেখতে দেখতেই যুদ্ধের নয়মা পার করে দিয়েও স্রেফ সার্টিফিকেটের বলে সরকারী বিভিন্ন সহায়তা হাতিয়ে নিচ্ছে এমনকি স্বাধীনতা পদক পর্যন্ত!
পেটের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিভানোর জন্য আলালের সনদ বিহীন মুক্তিযোদ্ধা বাবার যখন বসত ভিটা বিক্রি করা ছাড়া আর কোন উপায়ন্ত ছিলনা তখন সে মাত্র পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র।
সদা হাস্যজ্জ্বল বাবার মুখে অনেকদিন হল আলাল হাসি দেখেনা। স্নেহময়ী মায়ের মুখটাও সদা বেজার! পরনের একমাত্র মলিন শাড়িটা যেকোন মূহুর্তে ছিড়ে গেলে দ্বিতীয় কোন বস্ত্র জুটবে কিনা সেই ভয়ে সে সদা তটস্ত। এমতাবস্থায় ১৫ বছরের আলালের কি করা উচিৎ তা ভেবে সে কোন কুল কিনারা করতে পারছিলনা।
প্রতিদিন বিকেলে আলালদের বাড়ির সামনে দিয়ে বহতা বিসাখালী নদীর বুক চিরে দানব আকৃতির যে দুইটি জাহাজ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, আর সকালে ঢাকা থেকে যে দুটি জাহাজ ঝালোকাঠিতে ফিরে আসে তা আলালকে আর আগের মত প্লূকিত করেনা।
আলালকে যেদিন তার বাবা প্রথম স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিল, সেদিন ঢাকা থেকে আসা একটি জাহাজও আলালদের সমান্তরালে নদীর বুক চিরে ঝালকাঠির দিকে যাচ্ছিল। আলাল তন্ময় হয়ে কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সাহেব লোকগুলোকে এবং তাদের পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের দেখে পুলকিত হচ্ছিল।
সেদিন বাবা বলেছিল, “চিন্তা করিসনা বাপ, তুইও লেখা পড়া করে বড় হয়ে ঢাকায় চাকুরী করবি, আর সাহেব হয়ে বৌ বাচ্চা নিয়ে এমনি করে দেশে ফিরবি”।
চলবে............
বিষয়: সাহিত্য
৯২৭ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার লিখার ১ম ইপিসোড খুব ভালো লাগলো, মনে হয় সামনে অনেক অজানা কিছু জানবো, হয়তো অনেকগুলো কষ্টের কথা নিজের সাথেও মিলে যাবে....।
দোয়া রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন