মানুষের ভাবনার এমন বৈকল্য এবং দ্বীমুখিতা কেন?
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ০৩:১৯:০৮ দুপুর
মানুষের ভাবনার এমন বৈকল্য এবং দ্বীমুখিতা কেন?
যখন কোন শিল্পী আল্লাহর নামে গান গায় তখন আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই।
যখন কোন খেলোয়াড় ৪/৬ বা ১০০ রান হাকিয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে তখন আমরা তার তারিফ করি।
যখন কোন কবি আল্লাহর নামে কবিতা লেখে তখন আমরা তার প্রশংসায় পঞ্চ মুখ হই।
যখন কোন অভিনেতা তার অভিনয়ের মাধ্যমে ইসলামী ভাবধারা ফুটিয়ে তুলে তখন আমরা প্লুকিত হই।
কিন্তু
যখন কোন রাজনৈতিক নেতা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয়, আল্লাহর আইন এবং সত লোকের শাসন কায়েম করতে চায় তখন আমরা তার বিরোধিতায় লেগে যাই!
শুধু কি বিরোধিতা বরং তাকে এবং তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকেই মিটিয়ে দিতে চাই আর সেজন্য তাদের জান মাল ধ্বংস করতেও কুণ্ঠিত হইনা। বিরোধিতা যে শুধু প্রতিষ্ঠিত সরকারই করে তা নয় বরং সমাজের নেতৃত্ব দানকারী সরকারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এমনকি আলেম সমাজও পিছিয়ে থাকেনা!
তারা নানামূখি প্রশ্নবানে জড়জড়িত করে এবং এই আন্দলনে যেন কেউ শরিক নাহয় সেজন্য বাধার প্রাচীর দাড় করায়।
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ্য ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাইয়েদ আবু আ'লা মওদূদী নিজেই এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেনঃ
"সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদীঃ আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে সাধারণত বলা হয় যে, আমরা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার দাওয়াত দিয়া থাকি। হুকুমতে ইলাহিয়া শব্দে স্বতঃই এক প্রকার ভুল ধারণর সৃষ্টি হয়- অনেকে আবার ইচ্ছা করিয়াই ইহাকে কেন্দ্র করিয়া ভুল ধারণা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করে।
সাধারণত লোকে মনে করে, কিংবা তাহাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করা হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্র বলিতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা মাত্র বুঝায়। আর বলা হয় যে, বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্হার পরিবর্তে সেই বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
তাহার পর যাহারাই এই রাষ্ট্র ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করিবে, যেহেতু তাহারাই উহার পরিচালনভারও লাভ করিবে, সেহেতু খুব সহেজই বুঝনো হয় যে, আমরা হুকুমত দখল করিতে চাই।
অতঃপর দ্বীনদারীর ওয়ায শুরু হইয়া যায়। আমাদেরকে দুনিয়ার বা পার্থিব স্বার্থবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ মুসলমানদের তো দ্বীন- ইসলাম এবং পরকালের জন্যই কাজ করা দরকার, দুনিয়ার জন্য নহে।
দ্বিতীয়তঃ ইহাও বলা হয় যে, হুকুমত তো দাবী করার বস্তু নহে, ইহা তো ধার্মিক জীবন যাপনের ফলে খোদার তরফ হইতে উপহারস্বরূপই মানুষ লাভ করিয়া থাকে।
বস্তুত আমাদের সম্পর্কে এইসব কথাবার্তা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝিয়াই বলা হয়।
কোথাও বিশেষ চালাকীর সহিত ইহা প্রচার করা হয় শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, আমাদেরকে না হইলেও আল্লাহর অনেক বান্দাহকেই হয়তো এই উপায়ে সত্যের এই মহান আন্দোলন হইতে বিরত রাখা সম্ভব হইবে।
অথচ আমাদের বই পুস্তক উদার ও মুক্ত দৃষ্টিতে পাঠ করিলে প্রত্যেকেই অতি সহজেই বুঝিতে পারেন যে, নিছক একটা রাস্ট্র-ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠাই আমাদের উদ্দেশ্য নহে।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পরিপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই বিপ্লবের জন্যই আল্লাহ তাআলা নবী প্রেরণ করিয়াছেন। তাহাদের আহবান ও আন্দোলনের ফলে সব নবীরই নেতৃত্বে এক উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করা।
আমাদের দাওয়াতকে সহজ ও সুস্পষ্ট ভাষায় পেশ করিতে হইলে ইহাকে নিম্নলিখিত তিনটি দফায় পেশ করা যায়ঃ
১. আমরা সাধারণত সকল মানুষকে এবং বিশেষভাবে মুসলমানদেরকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার আহবান জানাই।
২. ইসলাম গ্রহণ করার কিংবা উহাকে মানিয়া লওয়ার কথা যাহারাই দাবী অথবা প্রকাশ করেন, তাহাদের সকলের প্রতি আমাদের আহবান এই যে, আপনারা আপনাদের বাস্তব জীবন হইতে মুনাফিকী ও কর্ম-বৈষম্য দূর করুন এবং মুসলমান হওয়ার দাবী করিলে খাঁটি মুসলমান হইতে ও ইসলামের পূর্ণ আদর্শবান হইতে প্রস্তুত হউন।
৩. মানব-জীবনের যে ব্যবস্হা আজ বাতিলপন্থী ও ফাসিক কাফিরদের নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন করিতে হইবে এবং নেতৃত্ত্ব ও কর্তৃত্ত্ব আদর্শ ও বাস্তব উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর নেক বান্দাহদের হাতে সোপর্দ করিতে হইবে।
উল্লিখিত তিনটি বিষয়ই যদিও সুস্পষ্ট, তবুও দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইহার উপর ক্রমাগত ভুল ধারণা ও অবসাদ-উপেক্ষার আবর্জনা পুঞ্জীভূত হইয়াছে বলিয়া আজ কেবল অমুসলমানই নহে- মুসলমানদের নিকটও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে।
আল্লাহর বন্দেগীর বিভিন্ন রকম অর্থ করা হয়। কেহ মেন করে, মুখে মুখে আল্লাহকে "আল্লাহ" এবং নিজেকে আল্লাহর বান্দাহ মানিয়া লওয়াই যথেষ্ট। নৈতিক, বাস্তব কর্মজীবনে এবং সমষ্টিগত ক্ষেত্রে আল্লাহকে না মানিলে এবং তাহার দাসত্ব স্বীকার না করিলেও কোনরূপ ক্ষতি নাই।
অথবা আল্লাহকে অতিপ্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টিকর্তা, রেযেকদাতা এবং মাবুদ স্বীকার করিতে হইবে এবং বাস্তব কর্মজীবনের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের ক্ষেত্র হইতে আল্লাহকে অপসারিত ও বেদখল করা অসংগত হইবে না।
আল্লাহর বন্দেগী সম্পর্কে আর একটি ধারনা এই যে, জীবনকে ধর্মীয় ও বৈষয়িক- এই দুইভাগে বিভক্ত করা চলে এবং কেবল ধর্মীয় জীবনে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত ও হালাল-হারামের কয়েকটি শর্ত পালনের ব্যাপারে আল্লার বন্দেগী করিলেই চলিবে।
কিন্তু বৈষয়িক ব্যাপারে তামাদ্দুন, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প- সাহিত্যের ক্ষেত্রে মানুষ আল্লাহর বন্দেগী হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকিবে। এই ক্ষেত্রের জন্য হয় নিজেরা কোন নীতি রচনা করিয়া লইবে, কিংবা অপর লোকদের রচিত নীতি অবলম্বন করিবে।
আল্লাহর বন্দেগী সম্পর্কে সাধারণ প্রচলিত এই সমস্ত ধারণাকেই আমরা ভ্রান্ত মনে করি এবং ইহা নির্মূল করতে চাই।
কাফিরী জীবন-ব্যবস্হার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই যতখানি, ততখানি কিংবা ততোধিক তীব্রতার সহিত বন্দেগীর এই ভুল ধারণাসমূহের বিরুদ্ধেও আমাদের সংগ্রাম।
কারণ, উল্লিখিত ধারণসমূহে দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি এবং রূপকেই সম্পূর্ণ বিকৃত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। আমাদের মনে কুরআন মজীদ এবং উহার পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী গ্রন্হ, শেষ নবী এবং পৃথীবির বিভিন্ন অংশে প্রেরিত অন্য নবীগণ এক বাক্যে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার পর যে আহবান জানাইয়াছেন, তাহার অর্থ এই যে, মানুষ আল্লাহকে পূর্ণরূপে ইলাহ, রব, মাবুদ, শাসক, মালিক, মনিব, পথপ্রদর্শক, আইন রচয়িতা, হিসাব গ্রহণকারী এবং প্রতিফলদাতা মানিবে এবং নিচের সমগ্র জীবনকে ব্যক্তিগত (private), সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয়, তামাদ্দুনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও আদর্শমূলক ব্যাপারসমূহকেও পূর্ণরূপে আল্লাহর বন্দেগীর ভিত্তিতেই সুসম্পন্ন করিবে। কুরআন মজীদে( ) “পূর্ণরুপে ইসলামের মধ্যে দাখিল হও” বলিয়া এই কাজেরই নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
অর্থাৎ নিজেদের জীবনের কোন একটি দিক বা বিভাগকেই আল্লাহর বন্দেগীর বাহিরে রাখিতে পারিবে না। পরিপূর্ণ সত্ত্বা লইয়া আল্লাহর গোলামী ও দাসত্ব কর, জীবনের কোন একটি দিক বা কোন একটি কাজকেও তোমরা আল্লাহর বন্দেগী হইতে মুক্ত রাখিও না, আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানকে পরিত্যাগ করিয়া, স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী হইয়া অথবা কোন স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী মানুষের অনুসারী ও অনুগামী হইয়া চলিও না।
বস্তুত আল্লাহর বন্দেগীর এই অর্থই আমরা প্রচার করিয়া থাকি।
এইরূপ বন্দেগী কবুল করার জন্য আমরা মুসলিম সকল মানুষেকই আহবান জানাইয়া থাকি।"
বিষয়: রাজনীতি
৭৯৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন