কুরবানী

লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২১ আগস্ট, ২০১৭, ০৬:১১:১৮ সন্ধ্যা

কুরবানী (গল্প)

সেলিম সাহেব একজন চেতনাধারী ব্যক্তি। সব কিছুতেই তার চেতনার ব্যরমিটারের পারদ দ্রুত উপরে উঠে যায়। ব্যবসায়িক চিন্তা আর ধার্মিকতার কারণে সে সামনে না আসতে পারলেও শাহাবাগে তার সমর্থন ছিল অকুণ্ঠ। এজন্য সব মহলেই তার বেশ কদর। শাহাবাগীরা তাকে চেনে বিরিয়ানী যোগানদাতা হিসেবে, ব্যবসায়ীক মহল চেনে ঋণ খেলাফি আর কালোবাজারী হিসেবে আর এলাকার মানুষ তাকে চেনে দানবীর ধার্মিক হিসেবে।

রোজার ঈদে জাকাতের কাপড় দেয়া, কুরবানীর সময় লাখটাকা দামের গরু দিয়ে কোরবানী করা, মহল্লার হুজুরদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়ে হাদিয়া দেয়া এবং এতিম খানায় চামড়া দিয়ে সাহায্য করার ক্ষেত্রে সে অন্যদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে। ধর্মীয় ব্যপারে সঠিক ধারণা না থাকলেও চেতনা এবং আবেগে আর দশজনের চেয়ে এগিয়ে।

ইদানিং সে সোসাল মিডিয়ায়ও বেশ এক্টিভ। প্রতিবেশী দেশ থেকে তেড়ে আসা বন্যার পানিতে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ভেসে গেলে অন্যান্যদের মত সেও বেশ আবেগী হয়ে ওঠে, বলা যায় একটু বেশীই আবেগী হয়ে পরে এবং তার চেতনার ব্যারো মিটারের পারদও বেশ উপরে উঠে যায়। এমন অসহায় মানুষের সাহায্য করা সবার নৈতিক দায়িত্ব তাই সেও পিছিয়ে থাকবে কেন? এদিকে কুরবানীর ঈদও সন্নিকটে তাই কুরবানী দেয়াও জরুরী এবং তাকে শুধু গরু কেনার জন্যই কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা বাজেট করতে হবে, তাছাড়ে অন্যান্য খরচতো আছেই।

কিভাবে দুইটা জিনিসকেই সামাল দেয়া যায় যখন এমন ভাবছিলেন তখনই তার ফেজবুক টাইমলাইনে একটা স্ট্যাটাস দেখে বলে ফেলেন, ইউরেকা, পেয়েছি। তার চেতনাবাজ শাহাবাগী ফেবু ফ্রেন্ডদের কেউ কেউ কুরবানীর টাকা বন্যার্তদের মধ্যে বিলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে! অগ্রপশ্চাত না ভেবেই সেও ফেবুতে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। অনেকেই তাকে সাধুবাদ জানালো আবার কেউ কেউ সমালোচনাও করল। তবে যারা সমর্থন করেছে তারা প্রায় সবাই তারমত চেতনার সৈনিক আর যারা সমালোচনা করেছে তার দৃষ্টিতে তারা চেতনা বিরোধী।

আগেই যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার কুরবানীর টাকা বন্যার্তদের সাহায্যে ব্যায় করবে তাই টাকা গুলি কোথায় দিলে বন্যার্তদের কাছে পৌছবে সেজন্য যখন ভাবছিল তখনই বিটিভির নিউজে দেখাল যে প্রধানমন্ত্রী ত্রান তহবিল খুলেছেন আর অনেকেই সেই তহবিলে নগদ এবং চেকের মাধ্যমে দান করছেন যাদের মধ্যে কেউ কেউ তার পরিচিত চেতনার সৈনিক। তার একজন ব্যবসায়িক পার্টনারকে দেখল ৫ লক্ষটাকার একটা চেক দিতে। পরের দিন আরো বৃহত্তর পরিসরে প্রধানমন্ত্রী নিজের কার্যালয়ে নিজের হাতে ত্রান গ্রহণ করবেন বলেও জানিয়ে দেয়া হল। সেলিম সাহেব ভাবল এটাই সুযোগ। এক ঢিলে কয়েক পাখি শিকার করার এর চেয়ে আর সুন্দর সুযোগ কি হতে পারে? প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতও হবে আর কুরবানীর টাকা ত্রান তহবিলে দিয়ে বানভাসি মানুষের সাহায্যও করা যাবে পক্ষান্তরে নিজের পকেট থেকে একটাকাও যাবেনা।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পরের দিন অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে সেলিম সাহেব যথারীতি লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। পরিচিত অনেককেই দেখে বেশ পুলকিত হল। তার সামনে যখন মাত্র ৪/৫জন লোক বাকী তখন খেয়াল করে দেখল যে সবার হাতেই ৫/১০ লাখ টাকার চেক। এমতাবস্থায় তার ১ লক্ষটাকা বেশ বেমানান। প্রধানমন্ত্রীর একদম কাছাকাছি নাহলে হয়ত কোন এক অজুহাতে লাইন থেকে চামে কেটে পড়তে পারত কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নাই। হাজারো চিন্তা তার মাথায় ভর করছিল, আর ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে কখনযে তার সিরিয়াল চলে এসেছে তা খেয়ালও করেনি।

প্রধানমন্ত্রীর সামনে গিয়ে সেলিম সাহেব অপ্রস্তুতভাবে চেকটা আগে বাড়িয়ে দিল। প্রধানমন্ত্রী তার হাত থেকে চেকটা নিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ফটো তুল্লেন। চেকটা অর্থমন্ত্রীর হাতে দিলে তিনি খেয়াল করে দেখলেন চেকে টাকার অংক বসানো নেই। তিনি জানতে চাইলেন কতটাকা লিখবে? সেলিম সাহেব এক লাখ বললে অর্থমন্ত্রী বললেন এক লাখ কোন টাকা হল? দশ লাখ লিখ। সেলিম সাহেব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাণ্ডুর মত মুখ মলিন করে দশ লাখ টাকা লিখি দিয়ে এল।

ব্যাংকে তার অত টাকা নাই, চেকটা বাউন্স হলে আর এক ঝামেলা। মান সম্মান সব ধুলয় মিশি যাবে। বন্ধু বান্ধবের কাছেও থেকেও আশানুরূপ সারা পাওয়া যায়নি। সবাই কুরবানীর গরু কেনা, গরীব মিসকিনকে সাহায্য করা এবং বন্যার্তদের জন্য কিছু ত্রান পাঠানোর কাজে ব্যস্ত তাই কারো কাছেই এই মুহুর্তে ধার দেয়ারমত কোন টাকা নেই।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল অনেক দিন ধরে রক্ষিত শেয়ারগুলোই বেচে দেয়ার। শেয়ার বাজার ধসে তার কোটি টাকার শেয়ারের মূল্য ১০ লাখ টাকায় এসে ঠেকেছে। যাই হোক শেয়ার পরেও কেনা যাবে কিন্তু কোন ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেয়া চেক বাউন্স হতে দেয়া যাবেনা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ঈদের আগে সাধারণত শেয়ার বাজার মন্দা থাকে তাই সেলিম সাহেবকে ১০ লাখ টাকার শেয়ার ৮ লাখ টাকায় বিক্রি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।

যেখানে ১ লাখ টাকায় গরু কিনে প্রতিবছর সেলিম সাহেব কুরবানী দিয়ে নাম কামায় এবার কুরবানী না দিয়ে সেই এক লাখ টাকা বন্যার্তদের দেয়ার নিয়ত করে ইতি মধ্যেই ১২ লাখ টাকার গলায় দড়ি লেগে গেছে, তাই মনে মনে ভাবছে সিদ্ধান্তটা ঠিক নেয়নি। এক লাখ টাকার গরু না কিনে যদি ৫০/৬০ হাজার টাকার গরু কিনে কুরবানী দিত আর ৫০/৬০ হাজার টাকা বন্যার্তদের সাহায্যে স্থানীয় ত্রাণ তহবিলে দান করত যেমনটা তার অন্য কয়েক বন্ধু করেছে, তাহলে কুরবানীর হকও আদায় হত আবার বন্যার্তদের সাহায্যও হত। কুরবানী না দেয়ার সিদ্ধান্ত সেলিম সাহেবের জন্য হীতে বিপরীত হল।

কালকে কুরবানী তাই আশেপাশের সব বাসার নিচেই কুরবানীর গরু বাঁধা। সব বাচ্চারা কুরবানীর গরু দেখছে আর আনন্দ করছে। কেউবা গরুকে ঘাস দিচ্ছে আবার কেউবা পানি। গরুগুলোও ঘাস এবং পানি পেয়ে বাচ্চাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আবার কখনো কখনো বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্য ফোস করে উঠছে। অন্য বাচ্চাদের সাথে সেলিম সাহেবের ছোট্ট মেয়ে আলোও খেলছিল। কেউ কেউ তাদের গরুর কথা জিজ্ঞেস করলে আলো বলছিল কালকে তার আব্বু গরু কিনে আনবে। তার কথায় সবাই হো হো করে হেসে দিল। কালকেতো কুরবানী। কালকে কি কেউ গরু কিনে নাকি? বাচ্চা মেয়েটার মাইন্ডে খুব লাগল তাই সে গাল ফুলিয়ে কাদতে কাদতে কাজের মেয়ের সাথে নিজেদের বাসায় চলে গেল।

সন্ধ্যার পরে ঘটল অন্য ঘটনা। প্রতিবারের মত গ্রাম থেক ২/৩জন লোক এসেছে যারা প্রতিবছরই আসে। কুরবানীর গরুর চামড়া ছাড়ানো, গোস্ত বানানোর কাজ তারাই করে। এজন্য তারা ৫/৭ হাজার টাকা পায় এবং উপরি হিসেবে গোস্তও পায়। অন্যান্যরা স্থানীয় লোকদের ৪/৫ হাজার টাকা দিয়ে এ কাজটা করালেও সেলিম সাহেব তার নিজের গ্রামের লোকদের দিয়ে এ কাজটা করায়। তাতে অনেক গুলো লাভ আছে। গ্রামের লোক গুলো কাজের বিনিময়ে ৫/৭ হাজার টাকা এবং কুরবানীর গোস্ত পেয়ে খুব খুশি মনে গ্রামে ফিরে গিয়ে সেলিম সাহেবের খুব প্রশংসা করে যা তাকে গ্রামে অন্যান্য দের চেয়ে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায়। যেহেতু তাদেরকে মানা করা হয়নি তাই তারা এসে হাজির! সেলিম সাহেবের সম্মান এবার ধুলায় মিলিয়ে যাবার পালা। এমতাবস্থায় তার কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছিলনা। বাসার দাড়োয়ান এসে গ্রাম থেকে আগত লোকদের নিচে তার রুমে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পারিয়ে রাখল।

যেহেতু কুরবানী দিচ্ছেনা এবং গরুও কিনেনি তা ঈদেরদিন সকালে সেলিম সাহেবর কি নামায পড়তে যাওয়া উচিৎ নাকি ঘরেই থাকা উচিৎ তা ভেবে পাচ্ছিলনা। বাবার এই দোটানা ভাব দেখে তাকে ঈদের নামায পড়তে ঈদ্গাহে যেতে বলে ছেলে সামির নিজে বাসা থেকে বেড়িয়ে সোজা গরুর হাটে চলে গেল। নামাজ পড়ে সেলিম সাহেব বাসার সামনে আসতেই ছেলেকে গরুর দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, লজ্জা আর আবেগে আত্মহারা হেয়ে গেলে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চেতনা ঝেড়ে ফেলে আবেগী কান্যায় বুক ভাসিয়ে দিল। বাবার সম্মান আর ছোট্ট বোনের মুখে হাসি ফোটাতে সামির নিজের জমানো ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে গরুটা কিনে নিয়ে এসেছ।

বাপ ছেলে যখন গভির আলিঙ্গে আবদ্ধ তখন বরাবরের মত এতিম খানার ছাত্ররা গরু জবেহ করার জন্য ইয়া বড় ছুড়ি নিয়ে হাজির। যথারীতি গরু কুরবানী হল এবং যারা গোস্ত বানাতে এল তারা গোস্ত বানাল এবং সন্ধ্যায় যথারীতি স্থানীয় মসজিদের হুজুরেরাও এল। সবাইকে যথাযথ ভাবে আপ্যায়ন করা হল। যদিও বরাবরের মত এবার যারা গোস্ত বানাতে এসেছে তাদের টাকা দিতে চাইল কিন্তু তারা বলল এবার তারা টাকা নিবেনা। তাদের ভাগের টাকাটাও যেন বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। একই কাজ হুজুরেরাও করল। তাদেরকে সেলিম সাহেব যে হাদিয়া দিত এবার তারতো তা নিলইনা বরং তাদের পকেটা যা সামান্য টাকা ছিল তারা তাও বের করে দিলেন এমনকি বাসার দাড়য়ান এবং কাজের বুয়াও তাদের বেতনের একটার একটা অংশ সেলিম সাহেবের হাতে তুলে দিল বন্যার্তদের সাহায্য করার জন্য। ছোট্ট মেয়ে আলো যে ঈদী পেয়েছিল সেও তা বাবার হাতে তুলে দিল বন্যার্তদের জন্য।

সেলিম সাহেব জীবনের ৫০ বছরে ১০০টা ঈদ করেছে কিন্তু এই মুহুর্তে সে যতটা আনন্দিত তা আর কোন ঈদেই পায়নি। আগের প্রতিটা ঈদই ছিল তার কাছে একটা চেতনা এবং বাহুল্যের ফ্যাশন কিন্তু এবারের ঈদটাই তার কাছে মনে হচ্ছে ত্যাগের। ছেলের বুদ্ধি মত্তায় যদি গরু কিনে কুরবানী করা না হত তাহলে সেলিম সাহেবের সম্মান বলে কিছুই থাকতনা আর একটা এবাদত থেকেও বঞ্চিত হতে হত, সর্বপরি কুরবানীর যে অনুভুতি তাও কোনদিন জানা হতনা। তাই সে সবার সামনে ঘটনা খুলে বলল এবং তওবা করল ভবিষ্যতে আর কোনদিন চেতনার অতিসয্যে এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিবেনা বরং ধর্মীয় আবেগ অনুভুতি নিয়েই প্রতিটা আমল করবে।

বিষয়: বিবিধ

৮৮০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383835
২২ আগস্ট ২০১৭ দুপুর ১২:০৪
হতভাগা লিখেছেন : বন্যার্তদের দেখভালের জন্য সরকারের প্রশাসনিক যন্ত্র আছে । বোঝাই যাচ্ছে যে তাদের সেই কাজ করার মত গার্থডস্‌ নেই বা তারা চুরি করার ধান্ধায় নিয়োজিত।

এদের চেয়ে কাক্কু ও তার প্রশাসন অনেক বেশী ইফিশিয়েন্ট ছিল । এখনকার মত তখন এত বেশী মিডিয়া ছিল না যে শুধুই বক বক করে। লোক দেখানো হলেও এরশাদ পানিতে নেমেছিল।

বন্যার্তদের জন্য এখন সবচেয়ে বেশী জরুরি হচ্ছে খাদ্য ও আশ্রয়স্থল । তাদের যে গবাদি পশু আছে সেগুলো কুরবানী উপলক্ষে কিনে নিলে তাদের লাভ বৈ ক্ষতি হবে না।

কুরবানী না করে সে টাকা যাদের মাধ্যমে দেওয়া হবে তারা নিশ্চিতভাবেই সেগুলো মেরে দেবে। এসব থেকে উচ্ছিষ্ট পাবার লোভেই মুলত সুশীলেরা উদগ্রীব হয়ে আছে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File