কাঁচা ধানে মই (পর্ব-০৬ শিরনামটা বদলে দিলাম)

লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২৪ জুলাই, ২০১৭, ০২:৪৮:৩৮ দুপুর

কাঁচা ধানে মই (পর্ব-০৬ শিরনামটা বদলে দিলাম)

ঘড়ির কাটায় ঠিক রত ১০টা তখনই স্থানীয় এক বাসায় শুরু হল প্রগ্রামের কার্যক্রম। শুরুতেই দার্সে কুরআন। সারাজীবন অনেক ওয়াজ মাহফিল শুনেছি কিন্তু দার্সে কোরআন কি তা জানা ছিলনা। যাহোক শুনতে হবে ধৈর্য ধরে। বন্ধুদের কথা মত কুর’আনের নামে ব্রেন ওয়াশ দেখা যাক কেমন ওয়াশ করে?

শুনলাম মোহমুগ্ধ হয়ে। সারাজীবনের ওয়াজ মাহফিলে যা শুনিনি তা শুনলাম দাড়ি গোফহীন ফুল পেন্টুল পড়া প্রায় আমার সমবয়সি কিশকায় এক ছেলের মুখে! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রতিটি হরফে, প্রতিটি পরতে কুরআনের কথা গুলো কেন যেন জীবনের সাথে ফিট হয়ে যাচিছল। দার্স শেষ হলে ভাবলাম ভালো ভালো কথার শেষে হয়ত আসল খেলা দেখাবে।

রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল আর একের পর এক আলোচনা চলছিল। ফাঁকে ফাঁকে চা বিস্কিটও ছিল। মুড়ি চানাচুড়ের কথা না হয় নাই বল্লাম। মধ্যরাতে দুইঘন্টার জন্য বিরতী দিল এবং ঘোষনা হল শেষ রাতে বাকী কার্যক্রম হবে অন্য জায়গায়। সবাই ঘুমালো কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। কান খাড়া রেখেছিলাম অন্য কিছুর আওয়াজের আশায় কিন্তু তেমন কিছু কানে আসলানা। ভাবলাম এরা মনেহয় সর্বহারাদের চেয়েও হুশিয়ার।

ঠিক রাত দুটায় সবাইকে জাগিয়ে দেয়া হল। ওযু করে সবাই প্রস্তুত, অতি সন্তর্পনে মার্চপাস্ট করে চলে গেলাম এক মসজিদের সামনে। মসজিদের কলাপসিপাল গেট খুলে গেলে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। মনে মনে ভাবলাম হায়রে শিবির! ব্যাটারা অস্ত্র দেখাবি তো দেখা তাই বলে মসজিদের ভিতরে!

আমার লক্ষ যেহেতু অস্ত্র দেখা তাই বেউকুফ সেজে রইলাম এবং তারা যা আদেশ করছে অন্যান্যের সাথে আমিও তাই করছিলাম।

সচরাচর আমরা মসজিদের যেখানে নামায পড়ি সেখানে না নিয়ে মসজিদের তিনতলায় নিয়ে যাওয়া হল। উত্তেজনায় আমার কান গড়ম হয়ে গেল। মসজিদের তৃতীয় তলায় সবাইকে কাতার বন্ধি করা হল যেমনটা নামাজে আমরা কাতার বন্ধি হই। ধিরপদে আলখাল্লা পরিহিত এক ভদ্রলোক সামনে চলে গেলেন। আরে ইনি যে মসজিদের ইমাম সাহেব। তাহলে ব্যাটা ইমামতির ছদ্দাবরনে এই কাম করে না? ঢিলে ঢালা জুব্বার আস্তিনের ভিতর থেকে এই বুঝি অস্ত্রটা বেড়িয়ে আসছে, যখন এমন অপেক্ষায় ঠিক তখনই তিনি কিবলামূখী হয়ে আল্লাহুআকবার বল্লেন। মনেমনে ভাবলাম হয়ত বিসমিল্লাহি আল্লাহুআকবার বলেই শুরু করবেন আসল খেলা।

ঠিকই তিনি যথাসময়ে আসল খেলা শুরু করলেন। আমি যেহেতু নতুন তাই প্রথমে বুঝতে না পারলেও সবার তালে তালে, তারা যেরকম করছিল আমিও সেরকম শুরু করলাম। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মনেহচ্ছিল আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে, মসজিদের ছাদ ভেঙ্গে মেঘ খন্ডগুলো আমাদের মাথায় এসে পড়ছে! ইমাম সাহেবের তর্জন গর্জন যতই বাড়ছিল আদর্শের সৈনিকদের গোঙ্গানীও সমধিক হাড়ে বেড়েই চলছিল।

কিছুক্ষণ পরে অনুভব করলাম এবার বজ্রপাত থেমে গেছে, মাথার উপর এসে পরা শিলা খন্ড গুলো গলতে শুরু করেছে। মসজিদের জায়নামাজ ভিজে যাচ্ছে। না রক্তে নয়, অস্ত্রের আঘাতেও নয় বরং কুরআনের মধুর তেলাওয়াত আর সিজদায় কন্নারত প্রতিটি কর্মীর রোনাজারীতে!! শিবিরের অস্ত্র দেখতে এসে আল্লাহর কাছে শেষ রাতে ধর্ণা দিয়ে অশ্রু বিষর্জনের যে দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম সে স্মৃতি ভোলার নয়। দুনিয়ার সব অস্ত্র শিবিরের শেষ রাতের সেই অশ্রুর কাছে যে একদিন পরাজিত হবে সে বিশ্বাস আমার সেদিনই জন্মে ছিল। (সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে৷ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে৷)

পরের দিন সকাল দশটায় পূর্ব রাজাবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম, পশ্চিম রাজাবাজার মসজিদ পাড় হতেই মিজানের মেঝভাইর বন্ধুর সামনে পরে গেলাম। সালাম দেয়ার আগেই সে খপ করে আমার হাত ধরে ফেল্ল। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার আর এক বন্ধু অন্য হাত ধরে আমাকে একটা লণ্ড্রির ভিতরে নিয়ে গেল। এবার শুরু হল জেরা। কেন শিবির করি, মাসে কয় টাকা করে পাই, রাজনীতি যদি করতেই হয় তাহলে শিবির কেন? ব্লা ব্লা ব্লা।।

পরিস্থিতি এতই নাজুক ছিল যে আমি কিছু বললেই লণ্ড্রির গড়ম স্ত্রি দিয়ে আমাকে স্যাকা দিবে। সেদিন মিন মিন করে কি বলেছিলাম তা মনে নেই তবে শিবিরের পক্ষে কোন কাজ করতে দেখলে যে আর রক্ষা নাই তা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক হুমকি ধমকি দিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। যদিও বারবার গড়ম স্ত্রি দিয়ে স্যাকা দিতে উদ্যত হয়েছিল কিন্তু টিপু ভাইদের বাসায় ভাড়া থাকা এক বড় ভাইয়ের হস্তক্ষেপে সেটা করেনি আসলে এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ছিল।

ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে পূর্ব রাজাবাজারের দিকে না গিয়ে নিজের মেসে ফিরছিলাম অনেকটা বিদ্ধস্ত অবস্থায়। পথে দেখা মুরুব্বি সংগঠনের এক দায়িত্বশীল ডাঃ শাহাবুদ্দিনের সাথে। তিনি আমার অবস্থা দেখেই আচ করতে পেরেছিলেন যে কিছু একটা হয়েছে। তাছাড়া আগের দিনের ঘটনাও তিনি জানতেন। আমাকে তার চেম্বারে বসিয়ে বিস্তারিত জেনে সাথে সাথেই শেখ কামালের বন্ধু পশ্চিম রাজবাজারের বাসিন্দা এবং হাল আমলে আমাদের সূধী মন্টু ভাইকে জানালেন। হুমকি দাতা ওয়াহিদ ছিল ছাত্র দলের জবির নেতা এবং মন্টু ভাই এর ফুফাতো ভাই।

মন্টু ভাই আমাকে ডেকে অভয় দিলেন যার ফল আমি হাতে নাতেই পেয়েছিলাম। পরের দিন ওয়াহিদের সাথে দেখা হলে আমি সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেখ করি আর সে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আগের দিনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং এও বলেছিলেন যদি আমার কাজে কেউ বাঁধা দেয় তাহলে মন্টু ভাইকে জানানোর আগেই যেন তাকে জানাই।

এক দিকে আমার সামনে এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা অন্য দিকে আব্বা রিটায়ার্ড করে ফেলেছেন এমতাবস্থায় বাড়ি থেকে টাকা আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ তাই ইসলাম ভাই একটা টিউশুনি ঠিক করে দিয়েছেন। তেজগাঁও স্কুলের একজন সনামধন্য গণিতের স্যার যিনি কিনা আল কুর’আনের ১৯ এর গাণিতিক বন্ধন বই এর লেখক তার ছোট্ট ছেলে এবং একমাত্র মেয়েকে পড়ানর। ওদের বড় দুই ভাই একজন আমার ক্লাসমেট এবং সংগঠনের কর্মী আর একজন ১০ম শ্রণীর ছাত্র ও সমার্থক। আমার ছাত্র-ছাত্রীদ্বয় যথা ক্রমে ৫ম এবং তৃতীয় শ্রেণীর।

ওরা দুজনই পড়া লেখায় খুব ভালো তাই ওদের সাথে কুলিয়ে ওঠা আমার পক্ষে অনেকটা দুরুহ! ওদের সাথে আমার একটা অঘোষিত দ্বন্দ্ব ছিল। আমার টার্গেট থাকত যেকোন মূল্যে ওদের ভুল ধরা আর ওদের টার্গেট থাকত ভুল না করা। আমি বেছে বেছে সব কঠিন অংক আর কঠিন ট্রানশ্লেশান করতে দিতাম আর ওরা সব পানির মত করে ফেলত। কালে ভদ্রে ভুল ধরে ফেল্লে নিজেদের ভুল মানতে রাজি হতনা।

একদিনতো ছাত্রটা কোনভাবেই তার ভুল মানতে রাজি হচ্ছিলনা তাই আমার মেজাজও তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিল আর বাচা যায় কোথায়? কার ছেলে, কার ভাই আর কত ভালো ছাত্র সেই তোয়াক্কা না করে মারলাম এক চটকনা। বেচারা ছোট্ট খাট হাল্কা গড়নের মানুষ তাই এক চটকনায় তিন ঘুল্লা খেয়ে আমার কাছে আর পড়বেনা বলে ঘরের ভিতরে চলে গেল। ছাত্রীটা মুখ মলিন করে বসে রইল। ওর মলিন মুখ দেখে আমার সেদিন খুব মায়া লেগেছিল। নিজের ভিতরে অন্য রকম একটা ফিলিংস অনুভব করছিলাম।

(চলবে...............)

বিষয়: বিবিধ

৭০৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383632
২৫ জুলাই ২০১৭ রাত ০১:১৩
আকবার১ লিখেছেন : দুনিয়ার সব অস্ত্র শিবিরের শেষ রাতের সেই অশ্রুর কাছে যে একদিন পরাজিত হবে সে বিশ্বাস আমার সেদিনই জন্মে ছিল। চমৎকার

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File