সালাফী পরিচয় দানকারী বাংলাভাষি আহলে হাদীসের প্রতি ভালোবাশ, অতপর দ্বিমত!
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ০৮ জুলাই, ২০১৭, ১০:৪৪:৪০ রাত
সালাফী পরিচয় দানকারী বাংলাভাষি আহলে হাদীসের প্রতি ভালোবাশা, অতপর দ্বিমত!
১৯৯০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় এসে সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে মেসে থাকার সময় চাপাই নবাবগঞ্জের ডালিমেকে রুমমেট হিসেবে পাই। সে আমার সাথে পূর্ব রাজাবাজার মসজিদে নামায পড়ত। হাত বাধত বুকে কিন্তু তাকে রফুলিয়াদিন করতে বা জোড়ে আমিন বলতে শুনিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আহলে হাদীসের লোকেরা বুকে হাত বাঁধে।
নরসিংদীতে আমার এক বন্ধুর বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় পথে মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেলে আমরা এক মসজিদে মাগরিবের নামায পড়ি সেখানে জীবনের প্রথম জোড়ে আমিন বলতে শুনি।
মিলাদ পড়া এবং সবিনা খতম পড়া যে বিদায়াত তাও সংগঠনের লোকদের কাছেই শুনতে পাই তাই সংগঠনভূক্ত হওয়ার পরে আমাদের বাড়িতে আর কোনদিন মিলাদ পড়াইনি। আমার মা মারা যায় ১৯৯৫ সালে জাস্ট আমার গ্রাজুয়েশানের কিছুদিন পরেই। মায়ের জন্য কোন মিলাদ পড়াইনি এবং চল্লিশাও করিনি। নিজেরাই দুয়া'দুরুদ করেছি এবং কবর জিয়ারত করেছি, তবে রমজানে বাড়ির মসজিদে ইফতার করাতাম এবং যে হুজুর তারবির নামায পড়াতেন তার খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম। মা এবং দাদার রুহের মাগফেরাতের আশায়।
পূর্ব রাজাবাজারে থাকার সময় ১৯৯৩-৯৯ প্রতিদিন জোহরের নামাযার পরে মসজিদের বোখারী শরীফ থেকে হাদীস পাঠ করে মুসুল্লিদের শুনাতাম। তখন জানতে পেরেছিলাম যে নামাযে নাওয়াইতুয়ান পড়া হাদীস সম্মতনা তাই সাথে সাথেই নাওয়াইতুয়ান পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম।
১৯৯৬ সালে ঢাকার একটা প্রাইভেট হাসপাতালে চকুরী হলে ঝিনাইদহের একজন কলীগ পাই যিনি জোড়ে আমিন বলতেন, রফুলইয়াদিন করতেন এবং বুকে হাত বাধতেন। প্রতিদিন জোহরের নামায আমরা হাস্পাতালের করিডোরে আদায় করতাম। বেশীরভাগ সময় সেই ইমামতি করত, মাঝে মধ্যে আমিও ইমামতি করতাম আবার কখনও এমডি স্যারও ইমামতি করতেন কিন্তু এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনদিন মতবিরোধ হয়নি।
১৯৯৯ সালে একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর একাউন্টেন্ট হিসিবে সৌদিআরবের দাম্মাম শহরে আসি। মনে মনে সংগঠনের ভাইদের খুজতাম কিন্তু কাউকে পাইনি। সিলেটের একজন ভাই জানালেন দাম্মামের সিটি সেন্টার সিকোতে একটা ইসলামী দাওয়া সেন্টার আছে সেখানে গেলে হয়ত সংগঠেনের লোক পেতে পারি।
পরের শুক্রবারই সেখানে যাই এবং দাঈ হিসেবে শায়খ মতিউর রহমান সালাফী সাহেবকে পাই। এবং সেখানকার ছত্রদের মাঝে বেশীর ভাগই জামায়াত শিবিরের লোক দেখতে পাই। তখন নিয়মিত জামায়াতের ইউনিটের বৈঠকেও বসা শুরু করি এবং দাওয়া সেন্টারের প্রগ্রামেও অংশ নিতে থাকি।
১৯৯৯-২০০১ সময় কালে শায়খ মতিউর রহমান সালাফির মুখ থেকে ইসলামী রাজনীতি, জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে টুশব্দও শুনিনি। মুহতারাম শায়খের আলোচনা শুনে তখন থেকেই আমি জোড়ে আমিন বলা, রফুলিয়াদিন করা এবং বুকের উপর হাত বাঁধা শুরু করি।
২০০১ এর মাঝামাঝি দেশে আসলে আমাদের বাড়ির মসজিদে নামায পরতে গিয়ে এমনটা করলে কেউ আমাকে বাঁধা দেয়নি। দু'একজন কানাফুসফুসি করত যে আমি শাফেঈ হয়ে গেছি। গ্রামের একমাত্র আওয়ামিলীগার সম্পর্কে আমার ফুফাতভাই যে কিনা জুমার নামায আর ঈদের নামায ছাড়া অন্য নামায পড়েনা। সে আমার এই পদ্ধতিতে নামায পড়ার বিরোধীতা করা শুরু করল। আমি তখন তাকে শর্ত দিলাম যে আপনি যদি নামাযে আসেন তাহলে আমি আগের পদ্ধতিতেই নামায পড়ব। সে আমার শর্ত কবুল করল আর আমিও ওয়াদা রক্ষা করা শুরু করলাম। দিন চারে মসজিদে আসার পর সে পূণুরায় নামায ছেড় দিল আর আমি পুনরায় রফুলইয়াদিন, জোড়ে আমিন বলা এবং বুকে হাত বাঁধা শুরু করলাম।
আমার শশুর একটা সিনিয়র মাদ্রাসার প্রভাষক তিনি আমাকে সরাসরি কিছু বলেননি বরং আমার বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি মাজহাব বদলে ফেলেছি কিনা? বন্ধুকে জবাব দিয়েছিলাম এর পর আর কেউই কিছু বলেনি। তবে তার পর থেকে আমি ইমামতি করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ অধিকাংশ মানুষ যেহেতু রফুলইয়াদিন করেনা, বুকে হাত বাধেনা এবং জোড়ে আমিন বলেনা সেহেতু আমি ইমাম হিসেবে এগুলো করতে গেলে কেউ আবার ফেতনা করে না বসে সেই ভয়ে।
আমার শ্যালক তখন ঢাবির স্টুডেন্ট সে আমার জোড়ে আমিন বলা নিয়ে প্রশ্ন তুল্লে আমি তাকে জবাবে বলেছিলাম, 'আমরা সবাই আমিন বলি, কেউ জোড়ে আর কেউ আস্তে আল্লাহ জোড়ে বললেও শুনেন আর আস্ত বললেও শোনেন'। বুদ্ধিমান শ্যালক আর তর্ক আগে বাড়ায়নি।
বাংলাদেশে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পরে শায়খ আব্দুর রহমান আর বাংলা ভাইদের নেতৃত্বে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলে জোট সরকার তাদেরকে শক্ত হাতে দমন করে। সাঈদী সাহেব সহ দেশের আলেম সমাজ এদের কার্যক্রমকে অনৈসলামিক বলে নিন্দা করতে শুরু করে। এমন কি রিয়াদের শিল্প একলাকার দাওয়া সেন্টারের দাঈও জুমার খুতবারয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। তখনকার পত্রপত্রিকায় পশ্চিম বংগের একজন সালাফী এর সাথে জড়িত বলেও দাবী করে। কাকতালীয় ভাবে মতিউর রহমান সালাফী সাহেবও পশ্চিম বংগের লোক।
চৌষট্টি জেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক জায়গায় বোমা ফাটানোর ঘটনার বিরোধীতা করে সাঈদী সাহেবের শক্ত অবস্থানের পরেই মতিউর রহমান শায়খ সাহেব সাঈদী সাহেবের বক্তব্যের খন্ডিত অংশের সমালোচনা করে সিডি তৈরী করে পুরা সৌদি'আরব জুড়ে ব্যপক ভাবে প্রচার করলে আমরা গণহারে প্রশ্নের সম্মুখিন হতে থাকি।
যেসব বিষয়ে শায়খ সাহেব সাঈদী সাহেবের বিরোধীতা করেছেন তা যে সর্ববৈভব সত্যের অপলাপ তা সাধারণ কর্মীদের বুঝাতে আমাদের গলদঘর্ম হতে হয়। সাধারণ সমর্থকদের একটা অংশকে তারা ভুল বুঝিয়ে সংগঠন বিমুখ করে ফেলে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত রিপোর্টকে তারা বিদা'আত বলে ব্যাপকভাবে ফেতনা ছড়ায়।
যারা সংগঠন করেন তারা জানেন যে ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখাটা সবচেয়ে কঠিন কাজ, তাই সাধারণ সমর্থক আর অলস কর্মীরা এবং দুই'একজন পালাই পালাই ভাব সদস্যও এই সুযোগে পিছটান দেয়।
এতে আমাদের টনক নড়ে কিন্তু তার পরেও আমরা ধৈর্যধারণ করি। আমাদের কোন দায়িত্বশীল পর্যায়ের লোক এগুলো নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। ওনাদের অপতৎপরতার কারনে সৌদি'আরবে সাঈদী সাহেবেরও ২/১টা মাহফিল স্থগিত করতে হয়। কোন কোন শহরে আমাদের ভাইদের পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হয় আক্বীদায় গলদ আছে বলে কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় পুলিশ আমাদের ভাইদের আক্বীদা সহী পেয়ে ছেড়ে দেয় এবং সৌদিআরবের দাওয়া সেন্টারগুলো থেকে প্রকাশিত কিতাবের আলোকে দাওয়াতি কাজ করার অনুমতি দেয় যদিও আমরা আগে থেকেই এখাকার প্রকাশিত বই পড়ি এবং বিলে করে আছিলাম।
আমাদের হটাতে চরম ভাবে ব্যার্থ হয়ে তারা এখন সরাসরি ইক্বামতে দীনের বিরোধীতা শুরু করে দিয়েছে অথচ এর আগে তাদের মুখে এমন কথা শুনিনি।
এতকিছুর পরেও তাদের ভালবাসি কারণ তারা অন্তত দেওয়ানবাগী রাজারবাগীদের মত শিরক বিদা'আত করেনা বরং মানুষকে শিরক বিদা'আত মুক্ত করার জন্য কাজ করে। যা আমাদের কাজের সহায়ক। তাদের অনেক শায়খের সাথে আমার ব্যক্তিগত কথা হয়েছে যারা মতিউর রহমান সাহেবের সাথে দ্বিমত পোষন করেন, তবে কিছু কিছু আছে যারা মতিউর রহমানের অন্ধ অনুসারী তারাই মূলতা ফেত্নার আসল হোতা।
তাদের সাথে কিছু কিছু বিষয় দ্বিমতের কারণ হল তারা রাসূল (সঃ) এর ইকামতে দীনের দায়িত্ব পালনের মত কাজ থেকে আমাদের বিরত রাখতে চায়।
তাদের কিতাবেও পরষ্পপর বিরোধী অনেক কথা আছে। একজনের এলখার সাথে আর একজনের লেখার মিল নাই এমনকি কিছু কিছু বিষয়ে সম্পূর্ণ উলটা কথাও আছে।
তাদের আক্বিদার কিতাব যেটা মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহবের লেখা সেখানে অনেক জ্বাল জয়িফ হাদীস আছে।
সূরা ফাতেহা পড়া, বুকে হাত বাঁধা আর রফুলইয়াদিনের ব্যাপারে এখতেলাফ আছে আর তারাও শিউর করে বলতে পারছেনা যে এগুলো না করলে নামায হবেনা। তাহলে বাড়াবাড়ি কেন? বরং তাদেরকে কাউন্টার প্রশ্ন করে দেখেছি যে জবাব দিতে পারেনি।
যেমনঃ সূরা ফাতেহা ছাড়া নামায নাই এই হাদীসের ব্যাখ্যায় যদি তাদের মত মেনে নেই তাহলে যে ব্যক্তি রুকুতে এসে নামাযে শরিক হল তার ঐ রাকা'আত কাউন্ট হবে কিনা? তারা বলে কাউন্ট হবে আর এটাই সর্ব সম্মত মত। তাহলে সে যে সূরা ফাতেহা পড়তে পারলনা তার সমাধান কি? আবার কোন মোক্তাদির যদি বে খেয়ালে সূরা ফাতেহা ছুটে যায় এবং রুকুতে গিয়ে মনে হয় তাহলে সমাধান কি? কোন সমাধান তারা দিতে পারেনি।
সর্ব শেষ এখন যা দেখছি তারা গণতন্ত্রকে হারাম বলে জোড়েসোরে ফতোয়া দিচ্ছে আবার গণতান্ত্রীক ভাবে বা ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় যাওয়াদের আনুগত্ব করার জন্য জোড় দাবী জানাচ্ছে! তাদের এই কাজ কি স্ববিরোধীতা নয়?
তাদের মঞ্চে যখন ইসলাম বিরোধী লোকদের বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য শুরু করতে দেখি তখন আশাবাদি হই কিন্তু যখন দেখি 'জয় বাংলা জয় বঙ্গ বন্ধু বলে বক্তব্য শেষ করছে তখন হতাস হই আর ভাবি এটা সহী আক্বদার দাবীদার আহলে হাদীসের লোকেরা কোন হাদীসের আলোকে করছে?
আসল ব্যাপারটা যে ভালো লেভেলের আড়ালে বড় ধরণের প্রতারণা তা এখন মোটামুটি দিবালোকের মত স্পষ্ট। তাদের এই তৎপরতা যদি বুঝের অভাবে হয় তাহলে আল্লাহ সঠিক পথ দেখান আর যদি জেনেবুঝে হয় তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে তাদের ফেতনা থেকে হেফাজত করুন। তবে এর জন্য মুসলিম থাকাই যথেষ্ট আহলে হাদীস বা অন্য কোন নাম ধারণের দরকার আছে বলে মনে হয়না।
বিষয়: বিবিধ
৯৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন