শামচুলের চুল (গল্প - দ্বিতীয় পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ১১ জানুয়ারি, ২০১৩, ১২:২৩:৫৫ দুপুর



(প্রথম পর্বঃ)

পীর সাহেব আবার অমাবস্যার অন্ধকার রাতে ছাড়া জ্বীন ডাকেন না। আজ সেই অমাবস্যার রাত।.


লতু শেখের আনন্দের আর সীমা পরিসীমা নাই। মাওলানা খায়রুলের কারনেই এতদিন লতু শেখ নিজ গ্রামের তৃসীমানার মধ্যেও পীর বাবার নাম পর্যন্ত মুখে নিতে পারেনি। এবার যখন মাওলানা সাহেবই পীর বাবাকে দাওয়াত করেছেন তখন এগ্রামে পীর বাবার যাতায়াত আর ঠেকায় কে? চালাকি করে একটু কেরামতি দেখাতে পারলেই কেল্লা ফতেহ। পীর সাহেব যদি মাওলানার ছেলের পঁচা পানিতে ডুবে থাকার ব্যামো ভালো করে দিতে পারে তাহলে এ গ্রামেই হবে পীর বাবার সবচেয়ে বড় আখড়া।

ভিতরে ভিতরে অনেকেই লতু শেখের পক্ষে থাকলেও এতদিন কেউ মওলানার ভয়ে মুখ খুলেনি। যাদের মধ্যে কয়েক জন নিঃসন্তান দম্পত্তিও আছে। আশা করা যায় একবার পীর বাবা যদি এ গ্রামে প্রবেশের সুযোগ পায় তাহলে এ গ্রামের আর কারো কোন সমস্যা থাকবেনা। এলাচি ভাবিদের মত নিঃসন্তান দম্পত্তির স্বপ্ন কুটীরেও সন্তানের আগমন ঘটবে। অবিবাহীত যুবক লোকমান, মামুন, আশরাফরা একদিন ফরীদপুরের খেয়া ঘাট দিয়ে নিজেদের নব বধুদের সাথে নিয়া বুক ফুলাইয়া হাইট্টা যাইতে পারবে। তা দেখে যদি নীলুদের মত ছোকড়াদের বুক ফাইট্টা যায় তাতে কারও কিছু যাবে আসবে না। পুষ্প, ইকী, তহুরা, লিপি, মধুবালা, ভিক্টরীয়ারাও তাদের কাঙ্খিত স্বপ্নের শাহাজাদাদের পেয়ে যাবে। বেগমদেরও মা হতে সময় লাগবে না!

শ্রাবণের অমাবস্যা রাত। ঘুট ঘুটে অন্ধরকার সাথে অবিরাম বৃষ্টি। চারিদিকে পানি থৈ থৈ! ঘরের বারান্দায় লতু শেখ সহ পাঁচজন সাগরেদ নিয়ে পীর সাহেব বসে আছেন। লতু শেখ মহা ব্যস্ত হয়ে পরেছে। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। পীর বাবা ধ্যানে মগ্ন! অবিবাহীত যুবক যুবতীরা আলাদা আলাদা কামড়ায় অপেক্ষমান। নিঃসন্তান দম্পিত্তিরাও পীর সাহেবের আজকের কার্যক্রমের দিকে কড়া নজর রাখছিল। চ্যাংড়া পোলাপাইনে কানাকানি করছিল, এমন অন্ধকারে পীর বাবা ডাক্তার জ্বীন আর রুগী শামচুকে দেখবেন কিভাবে?

লতু শেখ টের পেয়ে বল্ল অমাবস্যার রাতেও পীর বাবা পূর্ণীমার আলো দেখতে পান। তার কলব জারি হয়েগেছে তাই তার কাছে রাত দিনে কোন ফারাক নাই।

পীর সাহেব হঠাৎ করে, হক মাওলা ইল্লাল্লাহ বলে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, এসে গেছে, এসে গেছে!

পীর সাহেবের কামড়ার মাঝে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লতু শেখ সহ তার খাস সাগরেদেরাও প্রস্তুত। হঠাৎ ঘরের চালে একটা আওয়াজ হল। পিছনের দিকের একটা জানালা সশব্দে খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল।

পীর সাহেব জ্বীনের সাথে কথা বলা শুরু করলেন! শামচুলকে পীর সাহেব তার কামড়ায় নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। ঘুট ঘুটে অন্ধকারের মধ্যে শামচুল যখন খাটের কাছে এল তখন শামচুলের ছোট মামা আশরাফ, শামচুলকে খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে নিজেই জড় সড় হয়ে, শামচুল বেশে পীর বাবার কাছে চলে গেল। শামচুলের ছোট মামা কিছুটা খাটো প্রকৃতির হওয়ায় রাতের অন্ধকারে কেউ তাকে ঠিক পেলনা। এবার পীর সাহেব শামচুলকে ভেবে তার ছোটমামা আশরাফের বাজু ধরে বল্ল, 'আজ্জিন বদ জ্বীন শাহা জ্বীন ভুরঙ্গ, বাচ্চাকা বিমারী ক্যিয়া কারনেছে য়ায়েঙ্গে বল! এ ছেলে কেন ডোবার পানিতে ডুবে থাকে? আশরাফের বিশ্বাস সুদৃঢ় হল যে ব্যাটা পীর আমাদের মতই অন্ধকারে কিছুই দেখতে পায়না। লতু শেখ যা বলেছিল তা মূলত ভূয়া।

পাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে আওয়াজ এল, 'এজন্য ৫০০০ টাকা এবং একমণ মিষ্টি হাদিয়া দিতে হবে। টাকাটা আমি নিব এবং সামান্য কিছু মিষ্টি খেয়ে আমি বিদায় নিব আর বাকী মিষ্টি উপস্থিৎ সকলকে খাওয়তে হেব। বিনিময়ে আমি একটা তাবিজ দিব যা বাঘের দুধে চুবিয়ে তিনবার খাওয়ালেই রোগ ভালো হয়ে যাবে।

লতু শেখের কথা মত আগেই শামচুলের পকেটে ৫০০০ টাকা রাখা ছিল যা এখনও শামচুলের পকেটেই পক্ষান্তরে আশরাফের পকেটে টাকার সাইজের একটা কাগজের বান্ডেল। শুরুতেই পীর সাহেব অন্ধকারের মধ্যে আশরাফের পকেট হাতরিয়ে টাকা মনে করে কাগজের বান্ডেলটা নিজের হাতে তুলে নিল। পীর সাহেব বিনা বাক্যে টাকারুপি কাগজের বান্ডেলটা পকেটস্থ করে ফেল্ল। পীর সাহেব নাকি অমাবস্যার রাতেও পূর্ণীমার আলো দেখতে পায়! তার কলব নাকি জারি হয়েগেছে তাই তার চোখের সামনে নাকি কোন অন্তরাল নাই! যে পীর টাকার নোট আর কাগজের টুরকার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা তার কলব যে কতটা জারী হয়েছে তা লতু শেখের মত অন্ধ ভক্তরা না বুঝলেও আশরাফের আর বুঝতে বাকী রইলনা।

আবার মেয়েলি কন্ঠে আওয়াজ এল মিষ্টি খাওয়াও। মেয়েলি কন্ঠে বারবার যে লতু শেখই কথা বলছে, আশরাফ তাও বুঝে ফেল্ল। বছর খানেক আগে লতু শেখ একবার কন্ঠস্বর নকল করে একই ভাবে আশরাফ এবং তার বন্ধু লোকমান ও মামুনকে ভয় দেখিয়েছিল। আশরাফ মনেমনে ভাবলো, এই সুযোগ।

লোকমান এবং মামুন ততক্ষনে মিষ্টির ঝুড়িটা খাটের নিচে নিয়ে গেছে এবং আগে থেকেই খাটের নিচে রাখা মহীষের মলের ঝুড়িটা খাটের কোনে রেখে দিয়েছিল!

আশরাফ, ঝুড়িতে রাখা মহিষের মল পীরসাহেবের মুখে লেপ্টে দিয়ে বল্ল পীর বাবা আমার ভিতরে জ্বীন সওয়ার হয়েছে আমাকে বাচান আমাকে বাচান। সাথে সাথে লোকমান আর মামুন খাটের নিচে থেখে বেড় হয়ে মুরিদানদের মুখেও মহীষের মল লেপ্টে দিয়ে ধুম ধারাক্কা কিল ঘুষি দিতে শুরু করল। যার হাত থেকে লতুশেখও বাদ গেলনা।

আশরাফ এবং তার বন্ধুদের কিল ঘুষিতে পীর সাহেবের জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন বাধ্য হয়েই পীর সাহেব কোন মতে ভিড় ঠেলে ঘর ছেড়ে মুরিদ সহ ভোঁ দৌড়ে একেবারে লতু শেখের বাড়িতে।

পীর সাহেব চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই ভাবল আসলেই জ্বীনটা বড় বদ, যে কিনা পীর সাহেবকেও খাতির করেনি! লোকজন নানা কথা বলাবলি করছিল। শেষে, বেচে যাওয়া মিষ্টি খাইয়ে উৎসাহী জনতাকে শামচুলের বাবা বিদায় করে দিল।

শামচুলের বাবা মাওলানা খারুল জানত যে ভন্ড পীরদের জ্বীন ডাকার বিষয় গুলো ভুয়া, শুধু বেগম সাহেবাকে সান্তনা দেয়ার জন্য বাধ্য হয়েই পীরকে ডেকেছিল কিন্তু কিভাবে যে কি হল তা বুঝতে পারছিল না। ভন্ড পীরকে দাওয়াত দেয়ায় নিজের মনের গভীরে যে অপরাধ বোধের জন্ম হয়েছিল সেজন্য মাওলানা সাহেব আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তওবা করলেন।

সকাল বেলা শামচুলের ছোট মামা আশরাফ, শামচুলদের সকলকে নিয়ে তাদের বাড়িতে চলে গেল। আশরাফ তার বন্ধুদেরও দাওয়াত করেছিল। বন্ধুদের নিয়ে রাতের খানা খেয়ে বারান্দায় বসে আশরাফ গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত বয়ান করলে, সকলে মিলে হেসে লুট পুটি খাচ্ছিল। জ্বীন ডাকা যে আসলেই ভুয়া তা মাওলানা সাহেবের আগেও জানাছিল কিন্তু আসরাফের গল্প শুনে তার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্যখানে।

আশরাফের বোন অর্থাৎ শামচুলের আম্মার মনে একটা অপরাধ বোধ জাগ্রত হয়েছে। পীর সাহেব ভুয়া হোক বা সত্য হোক তাতে কিছু যায় আসেনা। কিন্তু লতু শেখের স্ত্রীর কাছে সে যা শুনেছে তার জন্য যে আশরাফই দায়ী তা বুঝতে পেরে নিজেকে অপরাধী মনে করছে। লতু শেখের বৌর বয়ান মতে পীর সাহেবের শরীর বিষ ব্যাথায় ফুলে গেছে। রাত থেকে পীর সাহেবের মোটা শরীরটা ফুলে হাতির মত হয়ে গেছে। যে শরীর থেকে নিয়মিত আতর গোলাপ চন্দনের খুসব বেরুত, তা থেকে এখন মহীষের মলের দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে! শেষ রাতের দিকে তাকে নৌকায় করে তার খানকায় পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কোন ভাবেই তাকে নৌকায় ওঠানো যায়নি। তার শরীরের ওজন এত বেড়ে গেছে যে নৌকর গলইয়ে পা রাথার সাথে সাথে নৌকাটাই ডুবে গেছে। ফলে কাক ডাকা ভোরে পীর সাহেব খালের ঘাটে পাট পঁচা পানিতে একটা চুবনি খেয়েছে, ফলে বিষ ব্যথা আরো বেড়ে গেছে। পঁচা পানিতে ডুবন্ত রুগীকে উপরে তুলতে গিয়ে নিজেই ডুবেছে! লতু শেখের অবস্থাও খারাপ কিন্তু পীরের মত অতটা না।

লতু শেখের বৌ এর ভাষ্য মতে জ্বীনটা নাকি নতুন জায়গায় আসতে চায়নি কিন্তু পীর সাহেবের পিড়া পিড়িতে এসে যখন দেখল তার চাহিদা মত বনুফুলের প্যাকেট মিষ্টির পরিবর্তে ঘোষের খোলা মিষ্টি রাখা হয়েছে, তাতেই খেপে গিয়ে নাকি জ্বীনটা এমন কান্ড করেছে।

লতু শেখের বৌ এর বয়ান আর আশরাফের কথা শুনে এখন শামচুলের আম্মার বিশ্বাসও দৃঢ় হয়েছে আসলে ওসব ভাওতাবাজি। কিন্তু তাই বলে আশরাফ ও তার বন্ধুরা যেভাবে পীর-মুরিদকে মেরেছে তাও ঠিক হয়নি।

আশরাফের বন্ধু মামুন বল্ল, দোস্ত ছোট বেলায় শামচুলকে আবার মহিষের দুধ খাওয়াসনি তো? আমার দাদি বলেছে বাচ্চাদের মহিষের দুধ খাওয়ালে নাকি ওদের আচরনে মহিষের প্রভাব পড়ে'!

এটা আবার মহিষের দুধের প্রভাব না তো? যদি তাই হয় তাহলে আর কি কি বিপত্তি ঘটতে পারে শামচুলকে নিয়ে এবং এর সমাধানই বা কি তা আসবে আগামী পর্বে।

পীর সাহেব আবার অমাবস্যার অন্ধকার রাতে ছাড়া জ্বীন ডাকেন না। আজ সেই অমাবস্যার রাত।.

লতু শেখের আনন্দের আর সীমা পরিসীমা নাই। মাওলানা খায়রুলের কারনেই এতদিন লতু শেখ নিজ গ্রামের তৃসীমানার মধ্যেও পীর বাবার নাম পর্যন্ত মুখে নিতে পারেনি। এবার যখন মাওলানা সাহেবই পীর বাবাকে দাওয়াত করেছেন তখন এগ্রামে পীর বাবার যাতায়াত আর ঠেকায় কে? চালাকি করে একটু কেরামতি দেখাতে পারলেই কেল্লা ফতেহ। পীর সাহেব যদি মাওলানার ছেলের পঁচা পানিতে ডুবে থাকার ব্যামো ভালো করে দিতে পারে তাহলে এ গ্রামেই হবে পীর বাবার সবচেয়ে বড় আখড়া।

ভিতরে ভিতরে অনেকেই লতু শেখের পক্ষে থাকলেও এতদিন কেউ মওলানার ভয়ে মুখ খুলেনি। যাদের মধ্যে কয়েক জন নিঃসন্তান দম্পত্তিও আছে। আশা করা যায় একবার পীর বাবা যদি এ গ্রামে প্রবেশের সুযোগ পায় তাহলে এ গ্রামের আর কারো কোন সমস্যা থাকবেনা। এলাচি ভাবিদের মত নিঃসন্তান দম্পত্তির স্বপ্ন কুটীরেও সন্তানের আগমন ঘটবে। অবিবাহীত যুবক লোকমান, মামুন, আশরাফরা একদিন ফরীদপুরের খেয়া ঘাট দিয়ে নিজেদের নব বধুদের সাথে নিয়া বুক ফুলাইয়া হাইট্টা যাইতে পারবে। তা দেখে যদি নীলুদের মত ছোকড়াদের বুক ফাইট্টা যায় তাতে কারও কিছু যাবে আসবে না। পুষ্প, ইকী, তহুরা, লিপি, মধুবালা, ভিক্টরীয়ারাও তাদের কাঙ্খিত স্বপ্নের শাহাজাদাদের পেয়ে যাবে। বেগমদেরও মা হতে সময় লাগবে না!

শ্রাবণের অমাবস্যা রাত। ঘুট ঘুটে অন্ধরকার সাথে অবিরাম বৃষ্টি। চারিদিকে পানি থৈ থৈ! ঘরের বারান্দায় লতু শেখ সহ পাঁচজন সাগরেদ নিয়ে পীর সাহেব বসে আছেন। লতু শেখ মহা ব্যস্ত হয়ে পরেছে। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। পীর বাবা ধ্যানে মগ্ন! অবিবাহীত যুবক যুবতীরা আলাদা আলাদা কামড়ায় অপেক্ষমান। নিঃসন্তান দম্পিত্তিরাও পীর সাহেবের আজকের কার্যক্রমের দিকে কড়া নজর রাখছিল। চ্যাংড়া পোলাপাইনে কানাকানি করছিল, এমন অন্ধকারে পীর বাবা ডাক্তার জ্বীন আর রুগী শামচুকে দেখবেন কিভাবে?

লতু শেখ টের পেয়ে বল্ল অমাবস্যার রাতেও পীর বাবা পূর্ণীমার আলো দেখতে পান। তার কলব জারি হয়েগেছে তাই তার কাছে রাত দিনে কোন ফারাক নাই।

পীর সাহেব হঠাৎ করে, হক মাওলা ইল্লাল্লাহ বলে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, এসে গেছে, এসে গেছে!

পীর সাহেবের কামড়ার মাঝে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লতু শেখ সহ তার খাস সাগরেদেরাও প্রস্তুত। হঠাৎ ঘরের চালে একটা আওয়াজ হল। পিছনের দিকের একটা জানালা সশব্দে খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল।

পীর সাহেব জ্বীনের সাথে কথা বলা শুরু করলেন! শামচুলকে পীর সাহেব তার কামড়ায় নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। ঘুট ঘুটে অন্ধকারের মধ্যে শামচুল যখন খাটের কাছে এল তখন শামচুলের ছোট মামা আশরাফ, শামচুলকে খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে নিজেই জড় সড় হয়ে, শামচুল বেশে পীর বাবার কাছে চলে গেল। শামচুলের ছোট মামা কিছুটা খাটো প্রকৃতির হওয়ায় রাতের অন্ধকারে কেউ তাকে ঠিক পেলনা। এবার পীর সাহেব শামচুলকে ভেবে তার ছোটমামা আশরাফের বাজু ধরে বল্ল, 'আজ্জিন বদ জ্বীন শাহা জ্বীন ভুরঙ্গ, বাচ্চাকা বিমারী ক্যিয়া কারনেছে য়ায়েঙ্গে বল! এ ছেলে কেন ডোবার পানিতে ডুবে থাকে? আশরাফের বিশ্বাস সুদৃঢ় হল যে ব্যাটা পীর আমাদের মতই অন্ধকারে কিছুই দেখতে পায়না। লতু শেখ যা বলেছিল তা মূলত ভূয়া।

পাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে আওয়াজ এল, 'এজন্য ৫০০০ টাকা এবং একমণ মিষ্টি হাদিয়া দিতে হবে। টাকাটা আমি নিব এবং সামান্য কিছু মিষ্টি খেয়ে আমি বিদায় নিব আর বাকী মিষ্টি উপস্থিৎ সকলকে খাওয়তে হেব। বিনিময়ে আমি একটা তাবিজ দিব যা বাঘের দুধে চুবিয়ে তিনবার খাওয়ালেই রোগ ভালো হয়ে যাবে।

লতু শেখের কথা মত আগেই শামচুলের পকেটে ৫০০০ টাকা রাখা ছিল যা এখনও শামচুলের পকেটেই পক্ষান্তরে আশরাফের পকেটে টাকার সাইজের একটা কাগজের বান্ডেল। শুরুতেই পীর সাহেব অন্ধকারের মধ্যে আশরাফের পকেট হাতরিয়ে টাকা মনে করে কাগজের বান্ডেলটা নিজের হাতে তুলে নিল। পীর সাহেব বিনা বাক্যে টাকারুপি কাগজের বান্ডেলটা পকেটস্থ করে ফেল্ল। পীর সাহেব নাকি অমাবস্যার রাতেও পূর্ণীমার আলো দেখতে পায়! তার কলব নাকি জারি হয়েগেছে তাই তার চোখের সামনে নাকি কোন অন্তরাল নাই! যে পীর টাকার নোট আর কাগজের টুরকার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা তার কলব যে কতটা জারী হয়েছে তা লতু শেখের মত অন্ধ ভক্তরা না বুঝলেও আশরাফের আর বুঝতে বাকী রইলনা।

আবার মেয়েলি কন্ঠে আওয়াজ এল মিষ্টি খাওয়াও। মেয়েলি কন্ঠে বারবার যে লতু শেখই কথা বলছে, আশরাফ তাও বুঝে ফেল্ল। বছর খানেক আগে লতু শেখ একবার কন্ঠস্বর নকল করে একই ভাবে আশরাফ এবং তার বন্ধু লোকমান ও মামুনকে ভয় দেখিয়েছিল। আশরাফ মনেমনে ভাবলো, এই সুযোগ।

লোকমান এবং মামুন ততক্ষনে মিষ্টির ঝুড়িটা খাটের নিচে নিয়ে গেছে এবং আগে থেকেই খাটের নিচে রাখা মহীষের মলের ঝুড়িটা খাটের কোনে রেখে দিয়েছিল!

আশরাফ, ঝুড়িতে রাখা মহিষের মল পীরসাহেবের মুখে লেপ্টে দিয়ে বল্ল পীর বাবা আমার ভিতরে জ্বীন সওয়ার হয়েছে আমাকে বাচান আমাকে বাচান। সাথে সাথে লোকমান আর মামুন খাটের নিচে থেখে বেড় হয়ে মুরিদানদের মুখেও মহীষের মল লেপ্টে দিয়ে ধুম ধারাক্কা কিল ঘুষি দিতে শুরু করল। যার হাত থেকে লতুশেখও বাদ গেলনা।

আশরাফ এবং তার বন্ধুদের কিল ঘুষিতে পীর সাহেবের জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন বাধ্য হয়েই পীর সাহেব কোন মতে ভিড় ঠেলে ঘর ছেড়ে মুরিদ সহ ভোঁ দৌড়ে একেবারে লতু শেখের বাড়িতে।

পীর সাহেব চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই ভাবল আসলেই জ্বীনটা বড় বদ, যে কিনা পীর সাহেবকেও খাতির করেনি! লোকজন নানা কথা বলাবলি করছিল। শেষে, বেচে যাওয়া মিষ্টি খাইয়ে উৎসাহী জনতাকে শামচুলের বাবা বিদায় করে দিল।

শামচুলের বাবা মাওলানা খারুল জানত যে ভন্ড পীরদের জ্বীন ডাকার বিষয় গুলো ভুয়া, শুধু বেগম সাহেবাকে সান্তনা দেয়ার জন্য বাধ্য হয়েই পীরকে ডেকেছিল কিন্তু কিভাবে যে কি হল তা বুঝতে পারছিল না। ভন্ড পীরকে দাওয়াত দেয়ায় নিজের মনের গভীরে যে অপরাধ বোধের জন্ম হয়েছিল সেজন্য মাওলানা সাহেব আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তওবা করলেন।

সকাল বেলা শামচুলের ছোট মামা আশরাফ, শামচুলদের সকলকে নিয়ে তাদের বাড়িতে চলে গেল। আশরাফ তার বন্ধুদেরও দাওয়াত করেছিল। বন্ধুদের নিয়ে রাতের খানা খেয়ে বারান্দায় বসে আশরাফ গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত বয়ান করলে, সকলে মিলে হেসে লুট পুটি খাচ্ছিল। জ্বীন ডাকা যে আসলেই ভুয়া তা মাওলানা সাহেবের আগেও জানাছিল কিন্তু আসরাফের গল্প শুনে তার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্যখানে।

আশরাফের বোন অর্থাৎ শামচুলের আম্মার মনে একটা অপরাধ বোধ জাগ্রত হয়েছে। পীর সাহেব ভুয়া হোক বা সত্য হোক তাতে কিছু যায় আসেনা। কিন্তু লতু শেখের স্ত্রীর কাছে সে যা শুনেছে তার জন্য যে আশরাফই দায়ী তা বুঝতে পেরে নিজেকে অপরাধী মনে করছে। লতু শেখের বৌর বয়ান মতে পীর সাহেবের শরীর বিষ ব্যাথায় ফুলে গেছে। রাত থেকে পীর সাহেবের মোটা শরীরটা ফুলে হাতির মত হয়ে গেছে। যে শরীর থেকে নিয়মিত আতর গোলাপ চন্দনের খুসব বেরুত, তা থেকে এখন মহীষের মলের দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে! শেষ রাতের দিকে তাকে নৌকায় করে তার খানকায় পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কোন ভাবেই তাকে নৌকায় ওঠানো যায়নি। তার শরীরের ওজন এত বেড়ে গেছে যে নৌকর গলইয়ে পা রাথার সাথে সাথে নৌকাটাই ডুবে গেছে। ফলে কাক ডাকা ভোরে পীর সাহেব খালের ঘাটে পাট পঁচা পানিতে একটা চুবনি খেয়েছে, ফলে বিষ ব্যথা আরো বেড়ে গেছে। পঁচা পানিতে ডুবন্ত রুগীকে উপরে তুলতে গিয়ে নিজেই ডুবেছে! লতু শেখের অবস্থাও খারাপ কিন্তু পীরের মত অতটা না।

লতু শেখের বৌ এর ভাষ্য মতে জ্বীনটা নাকি নতুন জায়গায় আসতে চায়নি কিন্তু পীর সাহেবের পিড়া পিড়িতে এসে যখন দেখল তার চাহিদা মত বনুফুলের প্যাকেট মিষ্টির পরিবর্তে ঘোষের খোলা মিষ্টি রাখা হয়েছে, তাতেই খেপে গিয়ে নাকি জ্বীনটা এমন কান্ড করেছে।

লতু শেখের বৌ এর বয়ান আর আশরাফের কথা শুনে এখন শামচুলের আম্মার বিশ্বাসও দৃঢ় হয়েছে আসলে ওসব ভাওতাবাজি। কিন্তু তাই বলে আশরাফ ও তার বন্ধুরা যেভাবে পীর-মুরিদকে মেরেছে তাও ঠিক হয়নি।

আশরাফের বন্ধু মামুন বল্ল, দোস্ত ছোট বেলায় শামচুলকে আবার মহিষের দুধ খাওয়াসনি তো? আমার দাদি বলেছে বাচ্চাদের মহিষের দুধ খাওয়ালে নাকি ওদের আচরনে মহিষের প্রভাব পড়ে'!

এটা আবার মহিষের দুধের প্রভাব না তো? যদি তাই হয় তাহলে আর কি কি বিপত্তি ঘটতে পারে শামচুলকে নিয়ে এবং এর সমাধানই বা কি তা আসবে আগামী পর্বে।

(পূর্বে প্রাকাশিত)

বিষয়: সাহিত্য

২১২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File