শামচুলের চুল (গল্প- প্রথম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ১১ জানুয়ারি, ২০১৩, ০১:৪৬:২৯ রাত
আমার বাচ্চাদের মামা শামচুল। হ্যা, শামচুল, আমার বৌ এর ছোট ভাই। দেখুন আমি ভদ্র মানুষ তাই গালাগাল আমার একদম অপছন্দ। আমি ইচ্ছে করলে তাকে আমার শ্যালক হিসেবেও আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু রুচিশীল মানুষ হিসেবে অতটা নিচে নামব এটা ভাবলেন কি করে?
শ্যালক বা শালা বলে কাউকে ডাকলে এমন কোন মানুষ নেই যে ক্ষেপে না যায়। শুধু ক্ষেপেই যায়না বরং বাহুতে জোড় থাকলে দুচার ঘা লাগাতেও অনেকে দ্বিধা করেনা। কিন্তু একটু কৌশল করে বলতে পারলেই কেল্লাহ ফতেহ। অনেকটা আদালত অবমাননার হাত থেকে বাঁচার জন্য লেখক সাংবাদিকরা যা করে থাকে আরকি।
রাজনীতিকরা এখানে দূর্বল তারা অনেক সময় ক্ষমতার জোড়ে সোজা কাঁচি চালাতে গিয়ে ধরা খায়। যেমনটা আমাদের মাননীয় স্পিকার এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ সাহেব খেতে খেতে বেঁচে গেছেন।
কাউকে যদি একান্তই শালা বলে গালি দিতে চান তাহলে তাকে শালা না বলে মামু বলুন দেখবেন সেও খুশি আর আপনিও খুশি, মাঝখানে যে তাকে বাপ চাচার শালা বানিয়ে ফেলা হল তা সে টেরও পেলনা!
তা, যা বলছিলাম আমার বাচ্চাদের মামা সম্পর্কে। বেচারা জন্মের পর থেকেই একেবারে স্বাধীনচেতা। নিজে যা বুঝে তাই করে আর এ জন্য তার যুক্তির অভাব হয়না।
তিন বোনের পরে খান্দানের প্রথম পুত্র সন্তান হওয়ায় সকলের কাছে তার আদর যেমন একটু বেশী তেমনি তার যেকোন আবদার মেনে নিতে পারলেই সকলে খুশি।
জন্মের সাত দিনের মাথায় যখন তার চুল কাটার কর্মসূচী হাতে নেয়া হল তখন কেউ কি ভেবেছিল যে এই দুগ্ধ পোষ্য শিশুই সরাসরি চুল কাটার বিরুদ্ধে বোমা ফাটানো প্রতিবাদ জানাবে?
ব্লেট নিয়ে তার মাথায় হাত লাগানোর সাথে সাথেই একদিকে যেমন গড়ম বায়ু ছেড়ে বোমা ফাটানোর আওয়াজ করছিল অন্য দিকে দুই হাতে নানুর সশস্ত্র হাতকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল। এমনকি উল্টা নানুর চুল ছিড়তেও দেরী করেনি। সেই যে চুল ছেড়ার অভ্যাস হয়ে গেল তা আজ অবধী অব্যহত আছে। কারও কোলে চড়েছে আর তার চুল ছেড়েনি এমন ঘটনা বলতে গেলে নজির বিহীন।
হাজারো চেষ্টা করেও শামচুলের চুল চাছা সম্ভব হয়নি! অনেক চেষ্টা তৎবিরের পরে মুরুব্বিরা বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত তাকে নেড়া করার কর্মসূচীই বাদ দিয়েছে।
শামচুল যেহেতু তিন বোনের একমাত্র ভাই এবং সাত খালার প্রথম ভাগ্নে তাই তার প্রতি যত্ন আত্মির কোন কমতি ছিলনা। ব্রেষ্ট ফিডিং এর সাথে সাথে ওভাল্টিন, ল্যাক্টোজেন সহ বিভিন্ন ব্রান্ডের টিনজাত খাবার এমনকি গরুর ছাগলের খাটি দুধও চলছিল পুরা দমে। কাজের কাজ কিছুই যে হচ্ছিলনা তা নয়। বেড়ে উঠছিল স্বাভাবিক ভাবেই কিন্তু গঠন প্রকৃতিটা মামাদের মত নাধুস নুধুস ছিলনা।
মামাদের মত নাধুস নুধুস না হওয়ায় পরিবারের অন্য কেউ চিন্তিত না হলেও শামচুলের বড় বোন জমিলার চিন্তার কোন অন্ত ছিলনা। ৮ বছর বয়সী বড় বোন জমিলাই তাকে সবসময় কোলে কাঁখে রাখছিল। ভাইদের প্রতি বোনদের যে মমত্ববোধ থাকে, জমিলার মধ্যে তার মোটেও ঘাটতি ছিলনা বরং অন্যদের তুলনায় একটু বেশীই ছিল। ভাইকে নিয়ে জমিলার আপাতত একটাই ভাবনা কিভাবে শামচুলকে মামাদের মত নাধুস নুধুস করা যায়?
শামচুলকে কাঁখে করেই জমিলা একদিন ভাবনার জগতে ডুবে ছিল। হঠাৎ করে তার চোখ পড়ল নানার গোয়াল ঘরের দিকে। সে দেখল গরুগুলোর চেয়ে মহীষ গুলো বেশ মোটা তাজা এমনকি গরুর বাছুরের চেয়ে মহিষের বাচ্চা গুলোও বেশ সুঠাম ও বলিষ্ঠ্য। তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ইউরেকা ইউরেকা পেয়েছি, পেয়েছি বলে চিৎকার করে উঠল। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিলনা, তাহলে তার পাগলামির জন্য তিরষ্কৃত হতে হত।
পরদিন থেকে শামচুলের খাদ্য তালিকায় আর একটা আইটেম যুক্ত হল। সবার অলক্ষে জমিলা, শামচুলকে মহিষের দুধ পান করানো শুরু করল এবং কিছু দিন যেতে না যেতেই ভালো ফলও পেল। শামচুলের বড় বোন জমিলার এখন একটাই ভাবনা কিভাবে অন্য আইটেম কম করে মহীষের দুধ বেশী করে খাওয়ানো যায়।
অবশ্য এজন্য তাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। শুধু ব্রেষ্ট ফিড বাদে বাকী টিনজাত খাবার শামচুলের নাম করে নিজেই খেয়ে ফেলত আর শামচুলকে খাওয়াত মহীষের দুধ। ফলে, দেখতে দেখতে শামচুল বেশ মোটাতাজা হয়ে গেল। এখন তাকে কোলে রাখাই দায়।
শামচুলের বয়স ইতিমধ্যে তিন হয়ে গেছে। সারাদিন দৌড়ের উপরেই থাকে। জন্মের পর থেকে আজ অবধী চুল না কাটার কারনে অনেকেই তাকে মেয়ে বলে ভুল করে। বাড়িতে নিজের যেমন তিন বোন তেমনি অন্যান্য চাচাদেরও একাধিক মেয়ে। তাই শামচুল সারাদিন তাদের সাথেই থাকে। তার স্বভাবেও কিছুটা মেয়েলি ভাব।
অন্যান্য বোনদের সাথে তার পার্থক্য হল, অন্যরা যেখানে পানি কাঁদা থেকে দূরে থাকে শামচুল সেখানে পানি কাঁদার মধ্যে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে! পরিষ্কার পানির পুকুরের তুলনায় পঁচা পানির ডোবার প্রতিই তার আগ্রহ বেশী। সবার অলক্ষে পঁচা পানির ডোবায় নেমে নাক অবধি ডুবে থাকতেই সে বেশী ভালোবাসে।
পঁচা পানির ডোবা থেকে উঠিয়ে আনলেই সে রাগে চুল ছিড়ে। পঁচা পানির ডোবায় ডুবে থাকার কারনে একদিকে তার চুলে যেমন জটা ধরে গেছে তেমনি শরীর থেকেও দূর্গন্ধ বেরচ্ছিল। কিন্তু তাতে তার কোন ভাবান্তর নাই বরং ওতেই সে মহা খুশি!
শামচুলের বয়স ইতি মধ্যে পাঁচ বছর হয়েগেছে। সে সাতারও শিখে ফেলেছে। তৃতীয় বোন নাসুও ইতি মধ্যে ইস্কুলে যাওয়া শুরু করেছে তাই শামচুল এখন আগের চেয়েও স্বাধীন। এখন দিনের বড় একটা অংশই সে স্বাধীনভাবে পঁচা পানির ডোবায় সাতার কাটতে পারে। নিজের ইচ্ছায় সে কখনও পানি থেকে উঠে এসেছে এমন ঘটনা বিরল। রাতে ঘুমানোর সময় বাদে বাকী সময় বলতে গেলে তার একমাত্র ঠিকানা বাড়ির পিছনের পঁচা পানির ডোবা!
শামচুলের এরকম আচরন নিয়ে তার বাবা মায়ের চিন্তার অন্ত নাই। অনেক ডাক্তার কবীরাজ দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি।
বাড়ির পাশের মুরুব্বি লতু শেখ এক পীরের মুরীদ। একদিন লতু শেখ এসে শামচুলের বাবাকে বল্ল, 'মাওলানা সাহেব, আপনি ইচ্ছা করলে আমার পীর বাবা, খাজা শাহ সুফি আল কাদরি মুজাদ্দে আলফেসানি নকশায়ে বন্দি আজমেরী ছেলছেলায়ে এনায়েত পুরি গাউসুলাজম মাইজ ভান্ডারী মুরসীদে কলী সাহেবে সুমু জনাব আব্দুল করীম দেহলবী দামাদ বারকাতুহু আলী সাহেবকে একবার দাওয়াত দিয়ে এনে আপনার ছেলেকে দেখাতে পারেন।
পীর বাবা নিজে যেমন কারও চেহারা দেখেই তার অতীত বর্তমান বলে দিতে পারে তেমনি দরকার হলে জ্বীন ডেকেও মানুষের সমস্যার সমাধান করে থাকেন। ভন্ড পীরেরা সাধারনত তাদের খানকায়ই ভুঁয়া জ্বীন ডেকে মানুষকে প্রতারনা করে কিন্তু আমার পীর বাবা সেরকম না। সে আসল পীর তাই যেকোন জায়গায়, যেকোন মুহুর্তেই জ্বীন ডেকে আনতে পারেন।'
পীর সাহেবের এত বড় নাম শুনেই মাওলানা খায়রুলের আক্কেল গুড়ুম! এত বড় নামের হাকিকত যে সাধারন মানুষকে প্রতারিত করা তা বুঝতে মাওলানার আর বাকী ছিলনা। তাছাড়া শামচুলের বাবা একজন জবরদস্ত আলেম। কোন পীর, মানুষের চেহারা দেখেই তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে এরকম শেরেকী কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। বরং এধরনের বাহারী নামের ভন্ডদের বিরুদ্ধে তিনি সদা সর্বদাই মানুষকে সতর্ক করেন। যেকারনে আশে পাশের গ্রাম গুলোতে প্রতি ঘরে ঘরেই ভন্ড পীরের মুরিদ থাকলেও একমা্ত্র মাওলানা খায়রুল সাহেবের গ্রামে শুধুমাত্র লতু শেখ বাদে কেউ পীরের মুরিদ হয়নি। বরং তারা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাশাপাশি সকাল সন্ধা মক্তবে শামচুলের বাবার কাছে কুরআন এবং মাসলা মাসায়েল শিখে, শিরক বিদায়াত মুক্ত ইবাদত করে। এজন্য অনেকে আবশ্য মাওলানা খায়রুল সাহেবকে ওয়াহাবী বা মওদূদীবাদী বলেও গালি দেয়।
লতু শেখকে বিদায় দিয়ে মাওলানা খায়রুল সাহেব বারান্দা থেকে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতেই তার বেগম সাহেবা মানে শামচুলের মা তাকে ধরে ফেলেন। বেগম সাহেবার কথা হল পীর সত্য না ভন্ড সে ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই কিন্তু তিনি চান তার ছেলের পঁচা পানিতে ডুবে থাকার ব্যামো ভালো হোক। মাওলানা সাহেব শত চেষ্টা করেও নিজের বেগম সাহেবাকে বুঝাতে পারলেন না যে জ্বীন পরীর ওসকল কান্ড কারখানা সব ভুয়া। বরং বেগম সাহেবার জিদের কাছেই পরাস্ত হয়ে লতু শেখকে খবর দিলেন যাতে আগামী অমাবস্যার দিন পীর সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা হয়।
পীর সাহেব আবার অমাবস্যার অন্ধকার রাতে ছাড়া জ্বীন ডাকেন না। দেখা যাক আগামী অমাবস্যার রাতে পীর সাহেব জ্বীন ডেকে শামচুলের পাঁচা পানিতে ডুবে থাকার ব্যামো ভালো করতে পারেন কিনা?
(পূর্বে প্রকাশিত)
বিষয়: সাহিত্য
১৬৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন