ধারাবাহিক গল্পঃ সরকারী খরচে বিয়ে!! (পঞ্চদশ পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ০৩ মে, ২০১৫, ১০:৫১:৪২ রাত

ধারাবাহিক গল্পঃ সরকারী খরচে বিয়ে!! (পঞ্চদশ পর্ব)

পূর্ব সূত্রঃ হ্যা আমিই গুলি করেছিলাম, তবে তার মাথায় না, কানের পাশ দিয়ে বাতাসে! আর হ্যা, সে অবশ্যই গুপচরের কাজ করেছে কিন্তু পাক বাহিনির পক্ষে নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আর সেই লোকটাকেই সারজীবন রাজাকারীর অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের অপবাদ নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে!

- কই আগেতো কখনো ঘটনাটা বলনি। দুঃখ জনক হলেও ভেরি ইন্টারেষ্টিং তো, পুরা ঘটনাটা বল।


১৯৭১ সাল, আমি সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছি। দুরন্তপনায় বন্ধুদের মধ্যে ছিলাম সবার সেরা। বাবা মায়ের কথাই যেখানে ঠিকমত শুনিনা, সেখানে আবার আদব কায়দা আর নামাজ রোজা? কুর’আন হাদীস থাক দূরের কথা সামান্য সূরা কেরাত এমনকি চার কালেমাও শেখা হয়নি, যে কারণে বাবা মা ছিলেন খুবই চিন্তিত। স্কুলে জীবনেই যেখানে দিন দিন তাদের আয়ত্বের বাহিরে চলে যাচ্ছিলাম সেখানে মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হলে যে তাদের নাগাল থেকে একেবারেই বেরিয়ে যাব তা নিয়ে তারা ছিলেন বিচলিত। তাই অনেক ভেবে চিন্তে বাবা একদিন গওহর ডাঙ্গা মাদ্রাসায় গিয়ে মাওলানা শামছুল হক ফরিপুরী (রঃ) এর সাথে দেখা করে তাকে বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললেন। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) কে আমার দাদাও খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং আমার বাবা ছিলেন গওহর ডাঙা মাদ্রাসার শুরুর দিকের ছাত্র যদিও মাদ্রাসার পাঠ শেষ করতে পারেন নি।

শেষ পর্যন্ত মাওলানা সাহেব, আমাকে পথে আনার জন্য মাদ্রাসার সেরা ছাত্র সাইয়্যেদকে বাবার সাথে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন, যে কিনা ছিল আমার সমবয়সী। সাইয়্যেদকে দেখে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হল বটে তবে সে ছিল সৎ, সাদালাপি, জ্ঞানী ও বন্ধুবৎসল। ফলে অল্প দিনেই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তার সংস্পর্শে অল্প দিনেই আমি চার কালেমা সহ অনেকগুলো সূরা শিখে ফেলি, ফলে আমাদের ঘরে সাইয়্যেদের গুরুত্ব বহুলাংশে বেড়ে যায়।

সাইয়্যেদের সাথে থেকে সূরা কেরাত শেখা, নাময পড়ার সাথে সাথে খেলাধুলা, ঘোড়াঘুড়ি ও যুক্তি তর্ক করে আমার দিন গুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুখের দিন গুলো বেশীদিন স্থায়ী হলনা। দেশে শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ যুদ্ধ। কৃষক শ্রমিক, কুলি মজুর, ছাত্র শিক্ষিক সহ অনেকেই যুদ্ধে যেতে লাগল কিন্তু আমি হয়ে পড়লাম কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বাবা মায়ের নজরদারি এড়িয়ে যুদ্ধে যাওয়া থাক দূরের কথা রাতবিরাত ঘরের বাহিরে গিয়ে প্রস্রাব করাও ছিল রীতিমত অসম্ভব। সন্ধ্যা হলেই মা বাহির থেকে কাচারি ঘরে তালা লাগিয়ে দিতেন যেখানে আমি আর সাইয়্যেদ থাকতাম। রাতের বেলায় জানালা দিয়ে বা মাটির ঘরের দড়জার ফাঁক গলিয়েই জল বিয়োগের কাজটা সারতে হত। মা অবশ্য সকাল বেলা একবালতি পানি ঢেলে দিতেন যাতে দূর্গন্ধ না ছড়ায়। সাইয়্যেদ আমার সাথে থাকায় তারা অবশ্য কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলেন, কারণ মাদ্রাসার ছাত্র আর আলেম সমাজ এমনকি চেয়ারম্যান মেম্বার সহ গ্রামের মান্যগণ্য লোকেরা ছিলেন পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষ্যে।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমার মনটা আকুলি বিকুলি করছিল কিন্তু উপায় খুজে পাচ্ছিলামনা। সাইয়্যেদকে তখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত মনে হচ্ছিল। সাইয়্যেদও আমার অবস্থা বেশ আঁচ করতে পারছিল কিন্তু মুখ খুলে কখনই কিছু বলেনি। তার গতিবিধিও আমার কাছে সন্দেহ জনক ঠেকছিল।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ। ইতি মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে মেহেরপুরের মুজিব নগরে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়ে গেছে। অমাবস্যার রাত বলে ঘরে বাহিরে ছিল ঘুট ঘুটে অন্ধকার। সন্ধ্যা থেকেই কাল বৈশাখীর সাথে চলছিল দমকা হাওয়া। মাঝে মধ্যে ঘরের চালে ঠুস ঠাস করে কাঁচা পাকা আম পরছিল। শেষ রাতের দিকে ঝড়হাওয়া থেমে গিয়েছিল তবে ঝির ঝির শীতল বাতাস বইছিল। পাকা আমের গন্ধ আর শীতল বাতাসের পরশে শেষ রাতে যেইনা চোখ দুটো মুদে এল এমন সময় দরজার কাছে কেমন যেন একটা শব্দ হল! চোর এল কিনা ভেবে পালতা কাথাটা টেনে মাথা ঢাকতে গিয়ে দেখি সাইয়্যেদ পার্শ্বে নাই! ঘুট ঘুটে অন্ধকারে দরজা খুলে পোটলা হাতে একটা ছায়া মূর্তি বেড়িয়ে যাচ্ছে! কাল বিলম্ব না করে ছায়া মূর্তিটাকে অনুসরণ করে আমিও বেড়িয়ে পড়লাম।

বাড়ির বাহির হয়ে ছায়া মূর্তিটাকে অনুসরণ করে আমিও এগতে লাগলাম। সদর রাস্তাটা যখন গ্রাম ছেড়ে ফাকা বিলের মধ্যে গিয়ে পরেছে তখন বিজলি চমকের আলোতে স্পষ্ট সাইয়্যেদকে চিনে ফেল্লা। সাইয়্যেদ কোথায় যাচ্ছ বলে চিৎকার করলে ও আমার দিকে এগিয়ে এসে মুখ চেপে ধরল।

- দেখ আমজাদ তুমি যখন দেখেই ফেলেছ তখন তোমার কাছে গোপন করে আর কি লাভ? আমি মুক্তি যুদ্ধে যাচ্ছি। তোমার বাবা মা আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে দিও যুদ্ধ বিগ্রহের সময় অন্যের বাড়িতে থাকা ঠিক হবেনা বলে চলে গেছি। তাদের বললে হয়ত অনুমতি দিতেন না তাই বিনা অনুমতিতেই চলে যাওয়ার মত বেয়াদবি করছি। তবে যুদ্ধ শেষ হলে বিজয়ী বেশে আবার ফিরে আসব ইনশা’আল্লাহ।

- দেখ সাইয়্যেদ? তুমি আমাকে এতটা কাপুরুষ ভাবলে কি করে? আমি এতদিন তোমার ভয়ে মনের ইচ্ছা প্রকাশ করিনি। মানুষিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমি সেই প্রথম দিন থেকেই সুযুগের অপেক্ষায় ছিলাম। আজ যখন সুযোগ পেয়েই গেছি তখন আর পিছনে ফিরে যাবনা। চল বন্ধু চল।

(চলবে) .......

বিষয়: সাহিত্য

১৪০১ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

317956
০৩ মে ২০১৫ রাত ১১:১৬
আফরা লিখেছেন : ওমা- - - মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে আমার বেশ ভাল লাগে । আমি মামনির মুখে শুনেছি । যদি ও আমার মামনির বয়স খুব বেশি ছিল না ।

ধন্যবাদ ভাইয়া ।
০৩ মে ২০১৫ রাত ১১:৩৩
259203
আবু জারীর লিখেছেন : আমারও ভালো লাগে কিন্তু আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখি নাই।
ধন্যবাদ।
০৩ মে ২০১৫ রাত ১১:৫১
259209
আফরা লিখেছেন : জী ভাইয়া আমি ধরনা করেছিলাম এবং প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম * আমার ধরনা ভাইয়া আপনি মুক্তি যুদ্ধ দেখেন নি তাহলে এত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন কিভাবে লেখা পড়ে মনে হয়েছে চোখে দেখা ঘটনা ।অনেক সুন্দর হচ্ছে লেখা ভাইয়া ।
০৪ মে ২০১৫ রাত ০১:৪৭
259240
আবু জারীর লিখেছেন : আমি যদি মুক্তিযুদ্ধ দেখতাম তাহলে আমাকে ভাইয়ার পরিবর্তে দাদা বলতে আহবান করতাম।
০৪ মে ২০১৫ দুপুর ০২:২৯
259317
আফরা লিখেছেন : Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor
317964
০৩ মে ২০১৫ রাত ১১:৩৯
আব্দুল গাফফার লিখেছেন : সাবলীল ভাষায় চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। চলুক সাথে আছি। অনেক ধন্যবাদ
০৪ মে ২০১৫ রাত ০১:৪৭
259241
আবু জারীর লিখেছেন : উৎসাহ দেয়ার জন্য আন্তরিক অভিন্দন।
317965
০৩ মে ২০১৫ রাত ১১:৪৪
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : বেশ ভালো লাগছে। সাথে আছি, ইনশাআল্লাহ।
০৪ মে ২০১৫ রাত ০১:৪৮
259242
আবু জারীর লিখেছেন : যাজাকাল্লাহে খায়রান বদ্দা।
317973
০৪ মে ২০১৫ রাত ১২:০২
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় ভাইয়া। আপনি মুক্তিযুদ্ধ না দেখেও অনেক হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেছেন মাশাআল্লাহ্‌। আপনার লিখাটি পড়ে আমি সেই চোখে দেখা ভয়াল দিনগুলোতে ফিরে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। হৃদয়টা আঁৎকে উঠলো আরেকবার। লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
০৪ মে ২০১৫ রাত ০১:৫১
259243
আবু জারীর লিখেছেন : ওয়ালাইকুম'আসসালাম, ওয়া'রহমাতুল্লাহে ওয়াবারাকাতুহ।
আপনি যে সুন্দর করে ভাইয়া বলেন তাতে ভুলে কখনও তুমি বলে ফেলিনি ভাগ্যিস। আপনার সুন্দর মন্তব্য আর সাথে থেকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আন্তরিক মুবারকবাদ।

০৪ মে ২০১৫ রাত ০৮:২৫
259386
সন্ধাতারা লিখেছেন : Good Luck Good Luck Good Luck Love Struck Love Struck Love Struck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck
317985
০৪ মে ২০১৫ রাত ০১:০১
আবু জান্নাত লিখেছেন : এমন মুক্তিযোদ্ধারা বুঝি আজ রাজাকারের অপবাদ নিয়ে পৃথিবী ছাড়ছে। অনেক মায়া হয় তাদের জন্য, কি অবাক পৃথিবী।
০৪ মে ২০১৫ রাত ০১:৫২
259244
আবু জারীর লিখেছেন : অবাক পৃথিবী চেয়ে রয় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার আর রাজাকারেরা কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়।
318020
০৪ মে ২০১৫ সকাল ১১:২২
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : সাবলীল ভাষায় চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন! চলুক সাথে আছি! অনেক অনেক ধন্যবাদ!
০৪ মে ২০১৫ সকাল ১১:৫৩
259292
আবু জারীর লিখেছেন : সাথে থেকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আন্তরিক মোবারক বাদ আপু।
318220
০৫ মে ২০১৫ সকাল ০৯:১০
nirvik sottobadi লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ । সাথেই ছিলাম প্রথম থেকে। চলুক...
০৯ মে ২০১৫ রাত ১০:৩১
260232
আবু জারীর লিখেছেন : ধন্যবাদ।
চলতে থেকবে ইনশা'আল্লহা, শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
319105
০৯ মে ২০১৫ রাত ১০:২৩
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : অনেক ভাল লাগলো, চলতে থাকুক, সাথে আছি.....
০৯ মে ২০১৫ রাত ১০:৩১
260233
আবু জারীর লিখেছেন : ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।
334408
০৮ আগস্ট ২০১৫ রাত ০৪:২৮
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : গল্পটা বারবার ঘুরে যাচ্ছে কেন ?
০৮ আগস্ট ২০১৫ রাত ১১:৩৫
276620
আবু জারীর লিখেছেন : গল্পটা শুধু গল্প নয় একটা আদর্শ সমাজের রূপ রেখে অঙ্কনের চেষ্টা করা হয়েছে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File