তবে একলা চলো, একলা চলো, একলা চলোরে...
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২১ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:৪৩:৩৮ রাত
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো, একলা চলো, একলা চলোরে...
হ্যা! বললেই হল না কি? একলা চলা কি অত সহজ? না মোটেই না। গতকাল সন্ধ্যায় একলা চলতে গিয়ে যে বুকের ভিতর থেকে কলিজাটাই বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার দায়িত্ব কে নিবে?
দাওয়াতি কাজ করা যেন একটা মজ্জাগত স্বভাব হয়ে গেছে। নিজের কাজ, নামায আর দাওয়াতি কাজ করতে নাপারলে পেটের ভাতই হজম হতে চায়না। অবশ্য অনেকদিন হল ভাত খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি, কারণ ২০১৪ সয়ালটা বলতে গেলে অনেকটা দৌড়ের উপর আছি। আজ রিয়েদে তো কাল দাম্মামে, পরশু ঢাকায় তো তার পরের দিন হাইলে!
দৌড়ের উপর আছি বলে নিয়মিত দাওয়াতি কাজ করা হচ্ছেনা, আর নামায? তা তো যেখানে মসজিদ সেখানেই সেরে নিতে হয়! তাই এমতাবস্থায় যদি ভাত খাই আর হজম না হয় তাহলে ডাক্তার কবীরাজের ঝক্কি ঝামেলা তো হতেই পারে। অনাকাঙ্খিত বিপদ এড়াতেই মূলত ভাতের পরিবর্তে রুটি খাচ্ছি এবং আল্লাহ্র ইচ্ছায় সুস্থ্যই আছি।
দৌড়ের ধারাবাহিকতায় গতমাসের ২৫ তারিখ থেকে সৌদি’আরবের একটা প্রত্যন্ত অঞ্চল হাইলে আছি, যেখানে দাতা হাতেমতাই এর আধি নিবাস। অবশ্য এখনও হাতেম তাইয়ের তীর্থ স্থান দেখা হয়নি। আশা করি শীঘ্রই সময় করে একদিন গিয়ে দেখে আসব ইনশা’আল্লাহ।
পাহারে ঘেরা দৃষ্টি নন্দন শীত প্রধান এবং শীত মৌসুমে বৃষ্ট বহুল একটা ছোট্ট শহর হাইল। এখানকার দাঈদের মন মেজাজও শহরের নিরবতার মতই নিরব এবং সহজ সরল। দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রটা বেশ বিস্তৃত কিন্তু দাঈদের সময়ের স্বল্পতা আর ডিউটির গরমিলের কারণে এখনও সব জায়গায় দাওয়াত পৌছন সম্ভব হয়নি। যাদের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়া হবে তারা যখন ফ্রি তখন দাঈদের ডিউটি শুরু আর দাঈরা যখন ফ্রি তখন আল্লাহর বান্দাদের ডিউটি শুরু! ফলে শহরের মূল কেন্দ্র বাদে উপশহরেই দাওয়াতি গ্রুপ নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব আর এমতাবস্থায় যদি কাউকে শহরের বাহিরে ৫০/৬০ কিলোমিটার দূরে কোন প্রত্যন্ত গ্রামে দাওয়াতি গ্রুপ নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করি তাহলে আমার হেড অফিসে গণ্ডগোল আছেকিনা সবাই যে সে বিষয়েই সন্দেহ করবে তা হলফ করে বলতে পারি।
ডিউটি শেষে গতকাল সন্ধ্যায় একলা চল নীতিতে শহর থেকে প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এক গ্রামে দাওয়াতি কাজের জন্য গিয়েছিলাম। মাগরিবের নামায আদায় করে নিজের ছোট্ট গাড়িখানায় চেপে যখন ওরায়জা নামক সেই প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম তখন ভালোই লাগছিল। বলতে গেলে এই প্রথম সৌদি’আরবের কোন গ্রামের দিকে একাকি পা বাড়ালাম। মেইন রোড ধরে ৩০ কিলোমিটার চলার পরে যখন গ্রাম্য মেঠ পথ ধরে চলতে শুরু করলাম তখনও ২০কিমি পথ বাকী। রাতের অন্ধকার আর দূর থেকে ভেসে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলো, সাথে আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা মাঝে মাঝে বিজলীর চমক আর হঠাত করে মেঘের গর্জন, সঙ্গী কেউ থাকলে সফরটা আনোন্দদায়ক হতে পারত।
এশার নামাজের আগেভাগেই গন্তব্যে গিয়ে পৌছুলাম। কাল বিলম্ব না করেই বসে পরলাম আসল কাজে। আলোচনা হল নামাযের গুরুত্ব নিয়ে। যে নামায মুমিন ও কাফেরের পার্থক্যকারী ব্যারোমিটার সেই নামাযের প্রতিই আজকের মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী অবহেলা! শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ভাইয়েরা নামায পড়ার ব্যাপারে শপথ করলে এশার নামায আদায় করে যখন বৈঠক শেষ করি তখন সময় সবে মাত্র রাত ৮টা। ভাইদের সাথেই রাতের খাবার খেয়ে যখন বিদায় নিয়েছি তখন রাত ৯টা বাজতে আরো খানিকটা বাকি। কিন্তু তাতে কি? এটাতো প্রত্যন্ত গ্রাম! কোথাও কোথাও বিজলিবাতি জ্বলছে বটে তবে, তাতে যেন রাতের নিস্তব্ধতা আরো ঘনীভূত হচ্ছে!
মেঠ পথ বললে ভুল হবে আমাদের দেশের হিসেবে রাজ পথই বলা যায় তবে মরুভূমি আর পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে শর্পিল গতিতে রাস্তাটা হাইওয়ের দিকে চলেগেছে বিধায় অতি সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। জনমানব শুণ্য প্রত্যন্ত এলাকায় আমিই একা! ভাবতেই কেমন যেন গাটা ছমছম করে ভারি হয়ে গেল। শরীরের লোমগুলোও জয়বাংলা বালে দাঁড়িয়ে গেল!
শীতের রাতের হালকা কুয়াশার চাদরে ছোট্ট পাহাড়গুলো যুবুথুবু! বিজলীর ঝল্কানি আর মেঘের গর্জন আমার পাদুটকেও ভারি করে দিল! এক্সেলেটর চাপছি পুরাদমে কিন্তু গাড়ির গতি যেন বাড়ছেইনা! দুই পাহাড়ের মাঝের সরু পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাত ভাবনার জগতে ভড় করল যদি দুই পাহাড়ের উপর দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আসমান ছুয়ে আছে এমন কিছু দেখি তাহলে কি করব? ভাবতেই মনে হল কলজেটা বুকের ভিতর থেকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে! কয়েকবার জয়বাংলা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু মুখদিয়ে বাক্যটি বেরলোইনা! শুনেছি জয় বাংলা না বললে নাকি দেশেই থাকা যাবেনা! আমার যে কি হবে আল্লাহই ভালো জানেন।
জয় বাংলায় যখন কাজ হচ্ছিলনা বরং ভয়টা বেড়েই যাচ্ছিল তখন আমার জান্নাত বাসিনী দাদীর একটা উক্তি মনে পরল ‘বনের বাঘে খায়না, মনের বাঘে খায়’ অতএব ‘লাহাওলা ওয়ালা কুউয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ’ পড়তেই সব ভয় কেটে গেল আর আমি গ্রামের মেঠপথ পাড়ি দিয়ে ততক্ষণে রাজ পথে এসে পৌছে গেলাম।
আরো ৩০ কিলোমিটার রাজপথে গাড়ি হাকিয়ে যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলাম তখন রাত প্রায় ১০টা। সেটা বড় কথা নয় বরং গেটে পৌছে গাড়িটা পার্ক করে যেইনা বেরলাম অমনি জমে থাকা মেঘমালা থেকে ঝুম র্বষ্টি শুরু হয়ে গেল! বৃষ্টিটা যদি গ্রামের সেই মেঠ পথেই শুরু হত তাহলে বুক থেকে মুখে চলে আসা কলজেটা নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারতাম কিনা আল্লাহ্ই ভালো জানে।
বুকের কলজে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসুক অথবা বুকের ভিতেরই ফেটে যাক তাতে ভয় করিনা কারন আমরা যে আল্লাহর সেনা। যে মিশণ নিয়ে বেরিয়েছি পথে তা কখনো থামবেনা। এ মিশন চালিয়েই যাব যদিও চলতে হয় একা।
বিষয়: বিবিধ
১৩৪৭ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হাইল তো যতটুক জানি সেীদ পরিবারের বিরোধি ইবনে রশিদদের রাজধানি ছিল।
ধন্যবাদ।
আল্লাহ্ আপনাকে নেক হায়াত দান করুন। আর দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যান। লেখাটি বরাবরের মতই ভাল লেগেছে। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
শত প্রতিকুলতা ভেদ করেই চির সাফল্যের বার্তা নিয়ে দ্বীনের দায়ীর পথচলা!
দরদময় সুন্দর সাবলীল উপস্হাপনা 'দাওয়াত'এর প্রয়োজনীয়তা কে নান্দনিক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে!
আল্লাহ আমাদের সবাই কে তৌফিক দান করুন,আমিন!
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান আপনাকে!!
ধন্যবাদ।
আর হাঁ, স্বাধীন বাংলা দেশে আসার আগে জয়বাংলা শিখে আসবেননন৷ পরের সবক থাকবে বন্দে মতারম৷ ভাল থাকেন৷
ধন্যবাদ।
ভেরি ইন্টারেস্টিং
সৌদিতেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সারা বিশ্বের কি অবস্থা ?
ধন্যবাদ।
কিন্তু কাজে তো তা দেখি না। কুরআনের সৈনিকরা তো আজ নিভু নিভু। তাদের বুকের পাটা আজ আচ্ছাদিত।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন