মানুষের মৃত্যু অবধারিত, তাই বলে কি বলে কয়ে?
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ০৬ জুলাই, ২০১৪, ০৪:৪২:৫৪ বিকাল
মানুষের মৃত্যু অবধারিত যা আমরা সবাই জানি কিন্তু সে মৃত্যু যদি হয় বলে কয়ে তাহলে কেমন হয়? হ্যাঁ তেমনটাই ঘটেছে আমার শ্বশুর মুহতারাম মাওলানা খলিলুর রহমান সাহেবের ক্ষেত্রে।
এর আগে একটা পোস্টের মাধ্যমে তার অসুস্থ্যতার কথা জানিয়ে দুয়া চেয়েছিলাম। আপনাদের দুয়ার বরকতে এবং আল্লাহর মেহেরবানীতে সে যাত্রা তিনি পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। আমরা যখন আশঙ্কা মুক্ত তখন তিনি জানান দিলেন আজ রাত আর তিনি অতিক্রম করবেন না। প্রতি তৃতীয় দিনে তার কিডনির ডায়ালাইসিস চলছিল। কথাবার্তায় স্পষ্ট সুস্থ্যতার ছাপ। তার পরেও যদি কেউ এমনটা বলেন তাহলে যারা তার আপনজন তারা কিছুটা হোচটই খায় বৈকি?
শ্বশুর মহদয়ের অসুস্থ্যতার খবরে ২৭/০৬/২০১৪ সন্ধ্যা ৮টায় আমি সবে মাত্র সৌদি’আরব থেকে ঢাকার বাসায় এসে পৌছেছি। তিনি আমার বাসায়ই ছিলেন। প্রথমেই মুহতারামের সাথে দেখা করে সালাম বিনিময় এবং কোলাকুলি করে নিজ স্ত্রী সন্তানের ঘরে গিয়েছি। ফ্রেস হয়ে মাগরিব এবং এশার নামাজ আদায় করে পুনরায় তার ঘরে গিয়ে বিস্তারিত আলাপ করছিলাম। ফাঁকে তাকে সহ রাতের খাবার খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি খেতে চাইলেন না। খোরমা খেজুর পেস্তা বাদাম তার বেশ প্রিয় তাই প্রতিবার ছুটিতে যাওয়ার সময়ই আমি এদুটো জিনিস নিতে অন্তত ভুল করিনা। এবারও বেতিক্রম হয়নি। খোরমা খেজুর আর পেস্তা বাদাম খাওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি নিরবতা পালন করেন। তার নিরবতাকে সম্মতি মনে করে খেজুর এবং পেস্তা বাদামের প্যাকেট সামনে নিয়ে আসলে খাদ্য তালিকা বাহির করে দেখলেন, তার জন্য খাদ্য দুটি মানা। পান্ডুর মত মলিন মুখে খেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তাকে না খাইয়ে যে আমি খাবনা সেটা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন তাই সামান্য কয়টা মুড়ি ধুয়ে দিতে বলে আমাকে খেতে যেতে বললেন। কি আর করা গুরু ভক্তি শিরধার্য তাই মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে খাবার টেবিলে চলে গেলাম।
রাতের খাবার শেষে বাচ্চাদের সাথে কথা বলছিলাম, ততক্ষণে ঘড়ির কাটায় রাত ১০টা। শ্বশুর মহদয় আমাকে ডাকতে বলছিলেন কিন্তু শ্বাশুরি আম্মা ভেটো দিচ্ছিলেন। তার ধারনা সদ্য বিদেশ থেকে আগত জামাতার সময় কাটানোর হক শ্বশুর মহদয়ের চেয়ে তাদের কন্যা এবং নাতি নাতনিদের বেশী। বার বার তাগাদা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত আমাকে ডাকলেন।
মুহতারাম তখন বিছানায় বসে তার বড় ছেলে যে কিনা সিলেটের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করছে তার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। ছেলেকে এখনই ঢাকায় চলে আসার নির্দেশ দিলেন। আমাকে দেখে বসতে বললেন। আমি বসলাম তার পিঠে মাথায় হাত বুলালাম। তিনি বললেন ‘বাবা আমি আজ রাত অতিক্রম করবনা’। এমন স্পষ্ট কথা আমার কাছে হেয়ালি মনে হলেও হৃদয়ে শঙ্কা দেখা দিল। সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। ছয়তলা বাসা থেকে নিজেই হেটে নামলেন। এম্বুলেন্সের পরিবর্তে বাসার সন্নিকটের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশানে রিক্সায় বসেই গেলেন।
ন্যাশনাল হার্টফাউন্ডেশানের জরুরী বিভাগে রাত ১১টার সময়ও ডাক্তার মহদয় বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। সাথে সাথে না হলেও সামান্য নময় নিয়ে তিনি রুগী দেখলেন। রুগীর কাছে রোগের হিষ্ট্রি জানলেন। রুগীও মাশা’আল্লাহ সব প্রশ্নের ষ্পষ্ট জবাব দিলেন। ডাক্তার এবং রুগীর কথোপকথনে বুঝার কোন উপায় রইলনা যে ডাক্তার কোন গুরুতর রুগী দেখছেন বরং মনে হচ্ছিল নিয়মিত চেক’আপের জন্য আসা কোনা রুগীর সাথে ডাক্তার মত বিনিময় করছেন।
ডাক্তার পেইন কিলার দিয়ে বললেন কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে। আমরা সেই আশায়ই প্রহর গুনছিলাম কিন্তু বিধি বাম! ডাক্তার এবার রুগীকে অনেকটা ঠেলে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার পায়তারা করল। রুগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে যে কোন সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। ডাক্তারের এহেন আচরণে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সরকারী হাসপাতালে রেফার করার অর্থ কি?
রাত ১২টায় কোন সরকারী হাসপাতাল আমার জন্য তাদের দরজা খুলে বসে আছে? সাত পাঁচ ভেবে আমি ধানমণ্ডির একটা বেসরকারি হাসপাতালের দিকে মুভ করলাম। এমন মুমুর্ষ রোগীকে এক রকম জোড় করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া ডাক্তারি বিদ্যার কোন ইথিক্সে পরে তা আমি জানিনা। রুগীর মৃত্যু যখন সময়ের ব্যাপার তখন রাস্তায় বসে মৃত্যু বরণ করার চেয়ে হাসপাতালের বেডে ডাক্তারের উপস্থিতিতে মৃত্যুবরণ করার সুযোগ দেয়া কি বেশী মানবিক নয়?
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এম্বুলেন্সে অক্সিজেন সাপোর্টে মিরপুর-২ এর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশান থেকে ধানমন্ডির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। শ্বশুর মহদয় তখন বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন, মাথার কাছে বসে আমি কালেমা পড়ে তাঁর শরীরে ফুঁকে দিচ্ছিলাম। বড় জোড় পাঁচ মিনিটের মাথায় আমরা তখনো ট্যাকনিক্যাল মোড় পার হইনি, দেখলাম মুখ থেকে সামান্য লালা বেড়িয়ে এসেছে, স্বযত্নে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে দেয়ার পরে অনুভব করলাম তিনি এহধাম ত্যাগ করে তাঁর প্রভূর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন’।
মরহুমের পরিচয়ঃ
নামঃ মাওলানা খলিলুর রহমান
গ্রামঃ ক্রোকির চর
থানাঃ কালকিনি
জেলাঃ মাদারীপুর
জন্মঃ ০১/০১/১৯৫৭ইং
মৃত্যুঃ ২৭/০৬/২০১৪ইং
কর্মঃ আরবী প্রভাষক (আন্ডার চর সিনিয়র মাদ্রাসা)
ডাক্তার (মুক্তি হেমিও হল, ডিগ্রীর চর হাট)
মৃত্যু কালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র, তিন কন্যা, দুই জামাতা, এক নাতি ও তিন নাতনি সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বিষয়: বিবিধ
২০১৩ বার পঠিত, ৪৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তাহলে বুঝা যাচ্ছে আমাদের সুপ্রিয় লেখক/ব্লগার আবু জারীর ভাই এখন দেশে অবস্থান করছেন।
ধন্যবাদ।
আপনার মুহতারাম শ্বশুর আমার আম্মুর আপন চাচাত ভাই হন। আমাদের ছোটবেলায় দেখা খুব কাছের একজন মানুষ। আম্মুর খুব প্রিয় একজন বড় ভাই। আজ সকালেই আম্মু তাঁর ব্যাপারে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন। ছবিটি দেখে চমকে উঠেছি , আপনার লেখাটির সাথে আম্মুর বর্ণিত মামার অন্তিম মুহুর্তের বর্ণনা মিলে যাচ্ছিল , সবশেষে মরহুমের পরিচয় দেখে শিওর হলাম।
আল্লাহর রহমত ও বরকত নাজিল হোক আপনার প্রতিও।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
আল্লাহ আমাদের মৃত্যু আত্মীয় ও সকল মুমিন মোমেনাতকে কবুল করুন। আমীন।
মরহুমের ভালো কাজ পরিবার যেন ফলো করে সেই দোয়া রইলো।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
সারা জীবন উনি পড়াশুনা করেছেন। তার পিছনে
বই এর কলাম থেকে বুঝা যায়। আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করবেন। আমিন।
ধন্যবাদ।
আমীন।
ধন্যবাদ।
আল্লাহ তাকে খুব সুন্দর মৃত্যু দিয়েছেন।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
আল্লাহ সব কিছু পারেন।
মরহুমকে আল্লাহ জান্নতে সর্বোচ্চ মর্জাদা দান করুন। আমীন।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
বুঝাই যায়, বড় নেককার বান্দাহ ছিলেন তিনি!
আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নসিব করুন! আমীন!!
তবে ঐ ডাক্তার মোটেও ভালো আচরণ করেন নি!
ধন্যবাদ।
মৃত্যুর সময়ক্ষণ বা দিন বলে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়ে পড়েছে এমন কয়েকটি ঘটনার কথা আমি নিজেও জানি।
আমার বাবার ঘটনা ছিল সে ধরনের! তিনি কবরের জন্য বাঁশ ও কাপড় জোগাড় করতে বলেছিলেন। বড় ভাবীকে হাতে টাকা রাখতে বলেছিলেন। সবাইকে কাছাকাছি থাকতে বলেছিলেন। ভাল করে গোসল করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। টয়লেটের কাজ সেড়ে গোসলের জন্য যাবার সময় তিনি সবার সামনে সেখানেই ঢলে পড়েন। তিনি অসুস্থ ছিলেন তবে কঠিন কোর রোগে ভোগছিলেন না। সব কাজ তিনি নিজের পায়ে হেটেই করছিলেন। আর সেভাবেই তিনি ইন্তেকাল করলেন।
আপনার শ্বশুড়ের কাহিনী পড়তে গিয়ে, আমার বাবার কথাটি মনে পড়ে গেল বলে, মন্তব্যটি লম্বা হয়ে গেল। হয়ত বে-মানান ঠেকাবে তারপরও পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার অভিব্যক্তিকে ধরে রাখতে পারল না। অনেক ধন্যবাদ
আল্লাহ আপনার আমার আমাদের সকলের বাবা-মা সহ সকল মুমিন-মোমেনাতদের কবুল করুন এবং জান্নাতে তাঁদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমীন।
ধন্যবাদ।
আবু জারির ভাই সালাম। আমিও তো ন্যাশনাল হার্টফাউন্ডেশানের পুর্ব দিকে ২নং বাজারের পূর্বে বায়তুল আতিক মসজিদের পশ্চিম পাশ্বে থাকি।
আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন মামাকে জান্নাতের মর্যাদাপূর্ণ আসনে জায়গা দিন। আমীন।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন