৯০ এর দশকে শিবিরের সাথীদের মাসিক বেতন ছিল ৫০০ টাকা কিন্তু আমাকে দেয়া হয়েছিল মাত্র ৩০০ টাকা!!!
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২৮ নভেম্বর, ২০১৩, ০৫:২৪:১০ বিকাল
৯০ এর দশকে শিবিরের সাথীদের মাসিক বেতন ছিল ৫০০ টাকা কিন্তু আমাকে দেয়া হয়েছিল মাত্র ৩০০ টাকা!!!
সর্বহারা পার্টির ফাঁপড়ে পরে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই ঢাকায় চলে এসেছিলাম। রেজাল্টের পরে ভর্তি হলাম ঢাকা সিটি কলেজে। ক্লাশ শুরু হল ২৭/১১/১৯৯০ ইং। সপ্তাহ না ঘুড়তেই ছাত্র রাজনীতির দাবীতে ছাত্রদের আন্দলনে পুলিশের গুলি, অমনি কলেজ বন্ধ!
ছাত্র রাজনীতির দাবী মেনে কর্তৃপক্ষ কলেজ খুলে দিলেন। ক্লাশে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী এসে ছাত্রদের সাথে পরিচিত হচ্ছিল। মজার বিষয় হল তাদের নিজেদের পরিচয় বলতে এতটুকুই বল্ল, 'আমরা ছাত্র লীগ, দল, ইউনিয়ন, মৈত্রী' এত্যাদি। কিন্তু তারা যে ছাত্র সংগঠনটার বিস্তারিত বল্লেন তাহল 'ছাত্র শিবির'!!
'ছাত্র শিবির' সম্পর্কে গ্রামের স্কুলে থাকতেও একবার শুনেছিলাম কিন্তু বুঝিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে যখন দেখলাম 'ছাত্র শিবির' নিয়েই সকল ছাত্র সংগঠনের যত মাথা ব্যথা তখন 'ছাত্র শিবির' সম্পর্কে জানার জন্য আমার মধ্যে একটা আগ্রহ জাগল।
পরের দিন মাসুদ নামের বি'কমের একজন ছাত্রের নেতৃত্বে ৪/৫ জন ছাত্র আমাদের ক্লাশে ঢুকে নিজেদের 'ছাত্র শিবিরের' কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে তাদের সম্পর্কে কিছু কথা বল্ল কিন্তু অন্য সংগঠন সম্পর্কে ভালো মন্দ কিছুই বল্লনা। তাদের এই আচরনও আমাকে প্রভাবিত করল।
আমি অন্তত এতটুকু বুঝলাম যে অন্য সংগঠনের ছাত্রদের নিজেদের কাছে এমন কোন কর্মসূচী নাই যার দ্বারা ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যায় পক্ষান্তরে 'ছাত্র শিবিরের' কাছে এমন কর্মসূচী আছে যা পেশ করতে পারলে ছাত্ররা তাদের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে।
শিবিরের নিজস্ব কর্মসূচীই তাদের পাথেয় পক্ষান্তরে শিবির সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পথ হারা ছাত্রদের নিজেদের দলে ভেড়ানই অন্যান্য সংগঠনের মূল পূজি!
ছাত্র মৈত্রী ও ইউনিয়ন অবশ্য তাদের নেত্রীদের হাজির করে বিকল্প পুঁজীর জানান দিয়েছিল!
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নাহওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতা কর্মীরা প্রতিদিনই নিয়মিত ক্লাশ চলাকালীন সময়ে ক্লাশে এসে তাদের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করতে লাগল কিন্তু বক্তব্যের বিষ বস্তু ঐ একটাই ''ছাত্র শিবির''!!
অন্যান্য দলের নেতাদের মুখে একই রেকর্ড শুনতে শুনতে হাফিয়ে উঠেছিলাম। ওরা ক্লাশে এলে কেমন যেন বিরক্তি লাগত! পক্ষান্তরে 'ছাত্র শিবিরের' নেতা মাসুদ যখন নিত্য নতুন বক্তৃতা দিতেন তখন তা থেকে শেখার কিছু পেতাম ফলে তার বক্তৃতার সময় তন্ময় হয়ে শুনতাম এবং মায়াবি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
নির্বাচনের ২/৩ দিন পূর্বে আমাদের ক্লাশ শেষ হলে কলেজ থেকে বেড় হয়ে হাজারিবাগের মেসের দিকে রওয়ানা হতেই হঠাৎ 'নারায় তাকবীর', 'আল্লাহু'আকবার', ইসলামী ছাত্র শিবির, জিন্দাবাদ, শ্লোগান শুনলাম!
শ্লোগানের শব্দ গুলো আমার কলিজায় আঘাত করছিল। ২/৩ মিনিট যেতে না যেতেই ঠুসঠাস শুরু হয়ে গেল। সম্মিলিত আক্রমনে শিবিরের ছেলেরা কলেজ ভবন থেকে রাস্তার দিকে বেড়িয়ে আসল। রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে ১৫/২০ জন শিবির কর্মীকে চতুর্দিক থেকে পাইকারী দরে কিল ঘুষি দিতে থাকল!
সহ ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের এই নিষ্ঠুর আচরন দেখে আমি সেদিনই শিবিরের প্যানেলে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
ছাত্রদল ব্যপক ভোটে পূর্ণ প্যানেলে জয় লাভ করল।
ছাত্রলীগ দ্বিতীয় এবং শিবির তৃতীয়!
নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক পরে ক্লাশ শেষ করে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন সালাম দিল। ফিড়ে দেখি শিবির নেতা মাসুদ ভাই। আমার সাথে হাত মিলালেন এবং আমার কুশল জিজ্ঞেস করলেন।
কিছুদিন পরে আমাকে একটা বই পড়তে দিলেন, পড়ে ফেরত দিলাম। এভাবে কয়েকটা বই পড়লাম। যতই পড়ছি ততই শিবির সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠছি।
বি'কম পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় মাসুদ ভাইর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমিও হাজারিবাগের মেস পরিবর্তন করে শুক্রাবাদে চলে গেলাম।
মাঝে মধ্যে পশ্চিম রাজাবাজার মসজিদে নামায পড়তে যেতাম! একদিন ইসলাম উদ্দিন নামে জগন্নাথে মাস্টার্সে পড়ুয়া এক বড় ভাই আমাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন। তার ভিতর যেন আমি মাসুদ ভাইয়েরই প্রতিচ্ছবিই দেখতে পেলাম। পাবনার ইসলাম ভাই আর নোয়খালির মাসুদ ভাইয়ের আচরনে এক অপূর্ব মিল দেখে আমি দৃড়ভাবে বিশ্বাস করলাম নিশ্চয়ই ইসলাম ভাইও শিবির কর্মী হবেন।
আমার ধারনাই সত্য হল। পর্যায় ক্রমে, আমিন ভাই, টিপু ভাই, ওয়াহেদ ভাই, হানিফ ভাই, টোকন ভাই, আব্দুল হক ভাই, সোহেল ভাই, আযাদ ভাই, সেলিম ভাই, খোকন ভাই সহ অনেকের সাথেই পরিচয় হল। তারা আমাকে শিবিরের দাওয়াত দিলেন এবং একপর্যায়ে আমাকে শিবিরের কর্মী হিসেবে ঘোষণা করলেন।
এবার শুরু হল সাথী হওয়ার সংগ্রাম।
আমি যে মেসে থাকতাম সেথানে সিরাজ গঞ্জের হালিম ভাই নামে ছাত্রলীগের একজন নেতা থাকতেন। তিনি নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজে বি'কমের ছাত্র। তার বাবার নামের সাথে আমার আব্বার নামের মিল থাকায় আমাকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। আমাকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। কেন শিবির করি এটাই তার আক্ষেপ।
রাশাদে খান মেনন যেদিন গুলি খেলেন সেদিন হালিম ভাই না থাকলে মেসের অন্যান্য সদস্যদের হাতে আমাকে রাম ধোলাই খেতে হত। আমি বাদে হালিম ভাই সহ মেসের বাকী ৬ সদস্যই ছিল ছাত্র লীগের নেতা কর্মী! মজার ব্যপার হল তাদের কাছে শিবির প্রকাশিত ফোকাস গাইড দেখেছি তবে যেখানে শিবির লেখা ছিল সেখানে হয় কালো কালি দিয়ে মুছে দিয়েছে নাহয় পৃষ্ঠাটাই ছিড়ে ফেলেছে!
এক দিকে আমি সাথী হবার পথে এগিয়ে যাচ্ছি আর অন্য দিকে হালিম ভাই আমাকে শিবির ছাড়ানর চেষ্টা করছে কিন্তু কার্যকরি কোন যুক্তি দেখাতে পারছেনা। এক পর্যায়ে হালিম ভাই বল্লেন, 'শিবির, সাথীদের ৫০০ টাকা এবং সদস্যদের ১০০০ টাকা করে মাসিক বেতন দেয়, আর যারা ফুলটাইম সময় দেয় তাদের এক একজনের বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত'!
আমি সরল মনে আমার দায়িত্বশীল ইসলাম ভাইকে জিজ্ঞেস করলে উনি মুচকি হেসে বল্লেন, 'আগে সাথী হন তখন নিজেই বুঝতে পারবেন'! ইসলাম ভাইয়ের জবাবে নিজে একটা গোলক ধাঁধার মধ্যে পরে গেলাম।
সাথী হবার চেস্টা অব্যহত রইল। মাঝে মধ্যে চিন্তা করতাম যদি সত্যি সত্যিই মাসে ৫০০ টাকা পাই তাহলে টিউশানিটা ছেড়ে দিব এবং সাংগঠনিক সময় আরো বাড়িয়ে দিব।
রমজান মাসে সেই কাঙ্খিত সময়টা আসল। তখন তেঁজগা থানার সভাপতি মাসুম বিল্লাহ ভাই আামকে মহানগরী অফিসে নিয়ে গেলেন। মরহুম সোহেল আহম্মেদ চৌধুরী ভাই একটা ইন্টার্ভিউ নিলেন এবং শেষে আমাদের কয়েক জনকে সাথী হিসেবে শপত পড়ালেন।
রমজানের ঈদের আর কয়েকদিন বাকী। শিবিরের তৎকালিন তেঁজগা থানার বায়তুল মাল সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ভাই জিজ্ঞেস করলেন কবে বাড়িতে যাচ্ছি?
আগামিকাল বলে উত্তর দিতেই উনি সভাব সুলভ হাত মিলালেন। তার সাথে হাত মিলালে প্রায়ই হাতের সাথে বাদাম / চকলেট / চিরকুট পাওয়া যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। কিন্তু আজকের ঘটনাটা ঘটল ভিন্ন! তিনি তার পথে আর আমি আমার পথে রওয়ানা হয়ে হাত খুলে দেখি তিনটি একশত টাকার নোট! কোন চিরকুট নেই!
ভাবনায় পরে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম এটা মনেহয় সাথী হওয়ায় আমার প্রথম মাসের বেতন। কিন্তু ৩০০ টাকা কেন? হালিম ভাইর কাছেতো শুনেছিলাম ৫০০ টাকার কথা! নিজে যেহেতু কমার্সের ছাত্র তাই হিসাব মিলাতে দেড়ি হলনা। সাথী হয়েছি ১২ তারিখে তাই হয়ত আনুমানিক খুচড়া মাসের বেতন!
মনটা কিছুটা ফুরফুরে হয়ে গেল! যাক আয়ের নতুন একটা উৎস পেলাম। শিবির, খরচ গুলোর লিখিত ডকুমেন্ট রাখে তাই বিকেল বেলায় বেতনের ভাউচারে স্বাক্ষর দিতে আমিন ভাইর বাসায় গেলাম।
আমিন ভাইরা খান্দানী সিলেটি। বাবা মৌলভি বাজার জেলার বড়লেখা থানার একটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বড় ভাই আওয়ামিলীগের নেতা এবং ঢাকায় ট্রাভেল ব্যবসায়ি। মেঝভাই, ছোট ভাই এবং বোনেরা স্ব স্ব পরিবার নিয়ে লন্ডন প্রবাসি। ছয়তলা বাড়ির নিচ তলায় গাড়ির গ্যারেজ, হলরুম, কেয়ার টেকারের রুম, গেস্ট রুম এবং আমিন ভাই এর রিডিং রুম। দোতলায় বড় ভাই ভাবি সহ পুরা পরিবারের বসবাস। আব্বা আম্মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাঝে মধ্যে ঢাকায় বেড়াতে আসেন।
আমিন ভাইয়ের কাছে গিয়ে টাকার জন্য কোথায় স্বাক্ষর দিতে হবে এবং ৫০০ টকার জায়গায় ৩০০ টাকা পেলাম কেন? এবং আগামী মাস থেকে নিয়মিত ৫০০ টাকা করে পাব কিনা জানতে চাইলাম।
আমিন ভাই বল্লেন প্রতি মাসেতো ৫০০ করে দেয়া সম্ভব না তবে মাঝে মধ্যে পাবেন! আমি বল্লাম কেন? যদি নিয়মিত বেতন দেন তাহলে টিউশানীটা ছেড়ে দিব। আমিন ভাই আমার কথার আগা মাথা কিছু বুঝতে পারলেন না। বরং জিজ্ঞেস করলেন আমি বেতন বেতন করছি কেন? কিসের বেতন?
বল্লাম কেন সাথী হয়েছি সেজন্য মাসে ৫০০ টাকা বেতন দেয়ার কথা সেটা?
আমিন ভাই হো.. হো.. করে হেসে দিলেন। তিনি আমার সমবয়সি হওয়ায় বেশ মজা পেলেন। বল্লেন আরে পাগল, 'শিবির সাথী সদস্যদের কোন বেতন দেয়না বরং সাথী সদস্যরাই তাদের পকেটের পয়সা দিয়ে সংগঠন চালায়।
তাহলে আমাকে যে ৩০০ টাকা দিলেন সেটা কিসের?
আমিন ভাই চুপষে গেলেন!
আমি বল্লাম এই নেন আপনার টাকা, আমি নিবনা।
আমিন ভাইর সুন্দর মুখটা মলিন হয়ে গেল! চোখের কোনে মনেহয় পানিও এসে গেছে। টাকার উৎসাটা হয়ত উনি আমাকে জানাতে চান নি! কিন্তু আমিও নাছোড় বান্দা! নাজেনে না বুঝে আমি কিসের টাকা নিব? হোকনা তনি শত বা তিন হাজার বা যে কোন পরিমান?
আমি বিদায় নিয়ে আসার সময় আমার সাথে সাথে গেটের বাহিরে আসলেন। আমাকে অতিসয় বিনয়ের সাথে বল্লেন, 'আমার বড়বোন লন্ডন থেকে কিছু টাকা পাঠিয়েছেন গরীব ছাত্রদের দেয়ার জন্য। আপনি যেহেতু বাড়ি থেকে পুরা খরচ আনতে পারেন না এবং টিউশানি করে পকেট খরচ চালন সেহেতু সেই টাকা থেকে আপনাকে এই ৩০০ টাকা দিয়েছিলাম'।
আমিন ভাইয়ের সরল উক্তির জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং দান গ্রহন করার মত অবস্থায় নাই বলে টাকা গুলো বরং আমার চেয়েও যারা বেশী নিডি তাদের দেয়ার জন্য বলে বিদায় নিলাম।
বিষয়শ্রেণী: রাজনীতি
শেয়ার করুনঃ
১৩০৭ বার পঠিত, ২০১ টি মন্তব্য Submit৫৭ জনের পছন্দ রেটিং দিতে লগইন করুন
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্যের জবাব দিতে সমস্যা হলে এখানে ক্লিক করুন এবং নতুন পাতায় মন্তব্য লিখুন
গতকাল নারায়নগঞ্জে যে মেরিণ ইঞ্জিনিয়ার ভাই শহীদ হয়েছেন সে এসবি ব্লগে আমার ফ্রেন্ড লিষ্টে ছিল বলে আমার বিশ্বাস। তাকে খুজতে গিয়ে এ পোষ্টটি পেয়ে পূণরায় শেয়ার করলাম।
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন