আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী (১৭)- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ০৭ জুন, ২০১৩, ০৯:৪৯:৩২ সকাল
আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী (১৬)- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)
এবোটাবাদে আমার রাত্রে অবস্থান ও প্রগ্রামে অংশগ্রহণঃ
মানসেরার অনুষ্ঠান সেরে আমরা এবোটাবাদ রওয়ানা হই। মানসেরা হতে একজন সাথীকে আমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য দেয়া হয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি এবোটাবাদ শহর হতে কয়েকমাইল দূরে অবস্থিত সাবেক পি,ডি,পি নেতা আব্দুর রউফ জাদোনের নীলম গ্রামের বাড়ি চিনেন কিনা? ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ, জনাব ফরিদ আহম্মদ ও মাহমুদ আলী সাহেবসহ আমরা বেশ কতিপয় বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের সময় এবোটাবাদে জনসভা করে রাত্রে পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত জাদোনের বাড়িতে ছিলাম, নানা সরকারী নির্দেশে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য কোন রেস্ট হাউজ বরাদ্দ করতে অপারগতা প্রদর্শন করেছিলেন। ফলে আমরা সকলেই আব্দুর রউফ জাদোনের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেছিলাম। আমাদের গাইড বলল, জি হ্যা, আমি জাদোনের বাড়ি চিনি। আমরা তখন মেইন রোড থেকে নেমে জাদোনের বাড়ির দিকের রাস্তা ধরে তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। প্রায় চৌদ্দ বছর পর কোন পূর্ব সংকেত ব্যতীত আমাকে তার বাড়িতে পেয়ে সে যেন আসমান থেকে পড়ল। কুশল বিনিময় ও চা নাস্তার পরে আমি রওয়ানা হতে চাইলে তিনি কিছুতেই ছাড়তে রাজী ছিলেন না, কিন্তু যেহেতু মাগরিব বাদ এবোটাবাদে আমার পূর্ব নির্ধারিত প্রগ্রাম ছিল, তাই তাকে রাজি করিয়ে রওয়ানা হয়ে এবোটাবাদ এসে হাজির হই।
হাজারা জেলার হেডকোয়ার্টার এবোটাবাদ শহর সমুদ্র লেবেল হতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফিট উঁচুতে পাহাড় ঘেরা একটি উপত্যকা। মারী হতে এখানে শীতের প্রকোপ একটু কম। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা একটি আবাসিক হোটেলে করা হয়েছিল। রাত্রে আমরা গাড়িতে উঁচু পাহাড়ে উঠে আলো সজ্জিত পাহাড়ের গায়ে শহরের মনোরম দৃশ্য আবলোকন করি। অতঃপর হোটেলে ফিরে এসে খানা ও নামায সেরে ঘুমিয়ে যাই। ফযর বাদ গোসল ও নাস্তা সেরে সকাল সাড়ে সাতটায় জামায়াতের অফিসে দায়িত্বশীলদের এক বৈঠকে বক্তব্য রাখি ও তাদের প্রশ্নের জওয়াব দান করি। বন্ধুরা আমার এই স্বল্প অবস্থান ও সংক্ষিপ্ত প্রগ্রামে মেটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তবুও তাদের থেকে বিদায় নিয়ে সকাল ৯-৩০ মিনিটে পেশওয়ারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথিমধ্যে পরিপুর ও আটকে চা পানের জন্য বিচুক্ষণ অবস্থান করি। এবোটাবাদ থেকে কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরে পাহাড়ী এলাকা ছাড়িয়ে আমরা সমতল ভূমিতে এসে উপনীত হয়েছিলাম। আর রাস্তাও ছিল উত্তম তাই ১০০ কিলোমিটার বেগে গড়ি চালিয়ে এবোটাবাদ হতে প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ১-১৫ মিনিটে আমরা পেশওয়ার উপস্থিত হয়ে জুমায়ার নামায আদায় করি। এদিন ছিল এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ। নামায ও খানা খেয়ে জামায়াতের মেহমানখানায় বিশ্রাম নেই, অথঃপর পেশওয়রের উত্তরে উপজাতি এলাকা সংলগ্ন আরবাব সাঈদের বাড়িতে মাগরিব বাদ তার তাজিয়াতের জন্য হাজির হই। মরহুম সাঈদ ছিলেন স্থানীয় জমিদার এবং সীমান্ত জামায়াতে ইসলামীর ও নেতা। তার সাথে আমার খুবই হৃদ্যতা ছিল। তিনি কয়েকদিন আগে বালাকোট হতে গিলগিট যাওয়ার পথে ভূমিকম্পে পাথর ধ্বসে পাথরের আঘাতে ইন্তকাল করেন। উপর থেকে বড় এক খন্ড পাথর তার জীপ গাড়ির উপরে পতিত হলে তার আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমি যতবারই পেশওয়ার সফর করেছি তার বাড়িতে মেহমান না হয়ে আসতে পারিনি। অতঃপর মরহুমের মাজার জিয়ারত করে তার পরিবারের লোকজনদের সাথে কিছুক্ষণ কাটিয়ে পেশাওয়ারে ফিরে আসি।
সকালে নাস্তা পর্ব সমাপ্ত করে জামায়াত অফিসে গিয়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত সেরে আফগান মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতের সার্জিকাল হাসপাতাল দেখতে যাই। হাসপাতালে মিসরীয় ডাক্তার আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান এবং চিকিৎসাররত বিভিন্ন ধরনের আহত মুজাহিদদের রুমে রুমে ঘুরিয়ে দেখান, অতঃপর আমরা জামায়াত প্রতিষ্ঠত ইসলামী টেন্টে খেতে যাই। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে লিখিত ইসলামী বইয়ের পশতু, ফার্সি ও রুশ ভাষায় অনুবাদ করা ও ছাপাবার ব্যবস্থা আছে। আফগান মুজাহিদরা নিজেদের জন্য ও দাওয়াতী কাজের ইদ্দেশ্যে অস্ত্রের সাথে সাথে এই ইসলামী কিতাবাদিও সাথে নিয়ে যায়।
পেশয়ারা মুজাহিদ নেতাদের সাথে সাক্ষাতকারঃ
বিকালে আসর বাদ আমরা মুজাহিদ ঐক্য ফ্রন্টের সদর দপ্তরে ফ্রন্ট নেতা আবদুর রব রসূল সাইয়াফ ও হিজবে ইসলামী নেতা গুলবদীন হিকমত ইয়ারের সাথে সাক্ষাত করে তাদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করি। সাইয়াফ জামেয়ুল আজহারের ডিগ্রীপ্রাপ্ত , ভাল আরবী জানেন। তাঁর আরবী বক্তৃতা আমি কয়েকবারই শুনেছি। গুলবদীন হিকমত ইয়ার একজন ইঞ্জিনিয়ার। মাগরিব বাদ জামায়াতের ভাইদের এক সম্মেলনে বক্তব্য রেখে অন্যতম মুজাহিদ নেতা জমিয়তে ইসলামী প্রধান রুরহানুদ্দীন রব্বানীর সাথে সাক্ষাতের জন্য তার বাড়িতে যাই। এদিন ছিল ১লা মে'১৯৮২ সাল। তিনি আমাদেরকে রাত্রের খানার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য ১০০ জনের এক একটা গ্রুপকে পাঠান হত। এদিন বুরহানুদ্দীন রব্বানী ১শ'মুজাহেদীনের একটি জামায়াতকে ফ্রন্টে পাঠাবার উদ্দেশে তার বাড়িতে রাত্রের খানায় একত্র করেছিলেন। আমরাও মোজাহেদীনদের সাথে একত্রে বসে খানা খাওয়ায় আমি যে তৃপ্তি অনুভব করেছিলাম তা কোনদিনও ভুলতে পারব না। খানা সমাপ্ত করে রব্বানী সাহেবের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে মেহমান খানায় চলে আসি। বুরহানুদ্দীন রব্বানী সাহেবও একজন ইলিমে দ্বীন। জামেয়ুল আজহারের ডিগ্রীপ্রাপ্ত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে তিনি ছিলেন কাবুল উনিভার্সিটির শিক্ষক। তার বাড়ি উত্তর আফগানিস্তানের বদখসান এলাকায়, মাতৃভাষা ফার্সী। হিকমত ইয়ারে বাড়ি দক্ষিণ আফগানিস্তনে। মাতৃভাষা পশতু।
পরবর্তি পর্বে থাকছেঃ ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরতি সফর ও কোলকাতায় অবতরণঃ
বিষয়: বিবিধ
১৫৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন