আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী (১১)- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)

লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ২২ মে, ২০১৩, ০১:২২:৩২ দুপুর

আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী (১০)- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)

আমার প্রথম হজ্জ্ব সফরঃ

জেলখানা হতে মুক্তি পাওয়ার দু'বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সনে আমি প্রথমবারের মত হজ্জ্ব সফরে যাই। আমার হজ্জ্ব সফরের কথা শুনে খুলনার প্রায় আরও ত্রিশজনের মত হজ্জ্ব গমনেচ্ছু আমার সাথে একত্রে হজ্জ্ব করার জন্য কাফেলাভুক্ত হন। আল্লাহর মেহেরবানীতে কাফেলাভুক্ত হজ্জ্ব গমনেচ্ছুক আমরা একই বিমানে জেদ্দা অবতরণ করে রাত্রের প্রথম দিকে মক্কা শরীফ গিয়ে পৌছি।

অধ্যাপক গোলাম আযম তখন বাংলাদেশের নাগরিকত্বহীন অবস্থায় দেশের বাহিরে বসবাস করছিলেন। যথা সম্ভব তখন তিনি লন্ডন হতে হজ্জ্ব উপলক্ষে মক্কা শরীফ আসেন। আমাদের মক্কার বন্ধুরা আমাদের জন্য একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন। যাতে হজ্জ্ব কালীন সময় একত্রে বসবাস করতে পারি। আমি, অধ্যাপক গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, সাবেক ছাত্র নেতা আবু নাসের, দুবাই থেকে আগত নূরুজ্জমান সাহেব সহ আরও কয়েকজন আমরা এই বাড়িতে উঠি। হজ্জ্ব সমাপ্তির পর দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা এই বাড়িতেই ছিলাম।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রী সভায় আমাদের কলীগ এবং আমার বিশেষ বন্ধু ব্যারিস্টার আখতারুদ্দিন সাহেব তখন সৌদী এয়ার লাইনে লীগ্যাল এডভাইজার হিসাবে এয়ার লাইনের জেদ্দা অফিসে কর্মরত ছিলেন। তিনিও তার ফ্যামিলিসহ আমাদের সাথে হজ্জ্ব করার জন্য মিনার ক্যাম্পে এসে আমাদের তাবুতে স্থান নেন। আমরা ৯ই জিলহজ্জ্ব আরাফাত ও রাত্রে মুজদালিফায় অবস্থানের পরে আবার ১০ই জিলহজ্জ্ব মিনায় ফিরে আসি এবং যথারীতি কোরবানী করে মাথা কামিয়ে গোসল সেরে কেবল তাবুতে ফিরে আসি। ইতি মধ্যে অধিকাংশ লোক তাবুতে ফিরে এসেছে, এর মধ্যে দেখি আমাদের পার্শ্ববর্তী তাবুতে আগুন লেগে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি কেবল তখন গোসল সেরে তাবুতে ফিরেছি। দেখি আমদের তাবুর সবাই তাবু ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমিও কাল বিলম্ব না করে হাতের কাছে আমার যে সামান পত্র পেয়েছি তাই নিয়ে জলদি তাবু ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে উঠলাম।

আগুন দাউ দাউ করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আর তাবুর পর-তাবু জলতে ছিল। ইতিমধ্যে মক্কা ও জেদ্দা হতে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে আগুন নিভানোর চেষ্টায় ব্রতী হল। পার্শ্ববর্তী তাবুর খুটি সরিয়ে দড়ি কেটে তাবু মাটিতে ফেলে দেয়া হল। অত:পর কয়েক ঘন্টার চেষ্টার পরে আগুন নেভানো সম্ভব হল।

আমার সাথে তখন বিন হাবিব ছাড়া আর কেউ ছিলনা। আগুন যখন পুরাপুরি নিভানো হল তখন রাত হয়ে গিয়েছে। শীতের রাত্র, আমরা খুজা খুজি করে আমাদের ক্যাম্পের জায়গায় ফিরে আসলাম। আমরা দুপুরের খাবার খেতে পারিনি ফলে ক্ষুধায় খুব কাতর হয়ে পড়েছিলাম। অধিক রাত পর্যন্ত খুজাখুজি করে সবাইকে আবার একত্র করলাম। আল্লাহর রহমতে আমাদের সাথী হাজীদের কিছু ছামান পত্র পোড়া গেলেও সবাই জানে বেচে ছিলেন। আমার সাথী হাজীদের ফেরত পেয়ে আল্লাহর শুররীয়া আদায় করলাম।

পোড়া তাবুর হাজীদেরকে সৌদী সরকারের পক্ষ থেকে রাত্রের খানা ও কম্বল সরবরাহ করা হয়েছিল। কেননা তখন প্রচন্ড শীত ছিল। যে সব হাজীদের তাবু পুড়ে গিয়েছিল সৌদী সরকারের পক্ষ হতে পরে তাদেরকে এক হাজার রিয়াল করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়েছিল। তাবুর মালিক মোয়াল্লেমদেরকে দেয়া হয়েছিল ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা অংকের টাকা। ফলে পোড়া যাওয়া তাবুর মোয়াল্লেমরা প্রচুর টাকা পেয়ে খুব খুশী হয়েছিল। আর পুড়ে যাওয়া তাবুর হাজীরাও এক হাজার করে রিয়াল পেয়ে খুশি ছিল। আমাদের তাবুর সবাই আমরা এক হাজার বিয়েল করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম।

এ সফরে আমরা বাদশাহ ফাহদের বাড়িতে বাদশার সাক্ষাত ও তার দেয়া খানার অনুষ্ঠানে যোগ দেই। এ ছাড়া শেখ বিন বাজের সভাপতিত্বে রাবেতার এক আলোচনা সভা ও রাবেতার দেয়া খানার অনুষ্ঠানেও যোগদান করি। এই প্রথম সফরেই শেখ বিন বাজের সাথে কয়েকবার দেখা সাক্ষাত ও তার সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। তিনি ছিলেন সৌদী সরকারের রাজকীয় প্রধান মুফতী। অতপর মক্কা রিয়াদ ও তায়েফে যতবারই তার সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে তিনি আমাকে তার বাড়িতে খানা না খাওয়ায়ে ছাড়েননি। তিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ খ্যাতনামা আলেমেদ্বীন যেমন ছিলেন, তেমনি তিনি ছিলেন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন। আল্লাহ তাঁর কবরকে নূর দ্বারা আলোকিত করুন, আর জান্নাতুল ফিরদাউসে তার স্থায়ী ঠিকানা করুন। আমীন।

এরপর আমি আল্লাহর মেহরবানীতে বহুবার হ্জ্জ্ব করেছি। কখনও রাবেতাতুল আলমে ইসলামীর মেহমান হিসেবে, কখনও সৌদী হ্জ্জ্ব মিনিষ্ট্রির মেহমান হিসেবে, কখনও জামায়াতে ইসলামীর ইজতেমায়ী হজ্জ্বের আমীরুল হজ্জ্ব হিসেবে। আমার হজ্জ্ব সফরের বিস্তারিত বিবরণ আমার লিখিত বই 'দেশ হতে দেশান্তরের' মধ্যে বিশদভাবে এসেছে। আগ্রহী পাঠক ঐ বইখানা পড়ে দেখতে পারেন।

১২তম পর্বে থাকছেঃ হযরত মাওলানা শামসূল হক ফরিদপুরীর (রঃ) সাথে তার গ্রামের বাড়িতে আমার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারঃ

বিষয়: বিবিধ

১৮০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File