আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী (১৬)- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ০৬ জুন, ২০১৩, ০৮:৩৭:২৭ সকাল
আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী (১৫)- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)
১৯৮২ সালে পাকিস্তানে আমার দীর্ঘ সফরঃ
১৯৮২ সালে আমি করাচী হতে শুরু করে সওয়াত পর্যন্ত দুই সপ্তাহেরও অধিককাল ধরে এক দীর্ঘ সফর করি। এ পুরা সফরেই আমার সাথী ছিলেন করাচী হতে নির্বাচিত পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আমার পুরাতন বন্ধু এককালের খুলনার অধিবাসী জনাব আসগর ইমাম। করাচী হতে আমরা লাহোর পর্যন্ত ট্রেনে সফর করেছিলাম। অতঃপর ২৪শে এপ্রিল জোহর নামায বাদ প্রাইভেট কারে দীর্ঘ সফরের উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি রওয়ানা হই। রাওয়ালপিন্ডিতে মেজবান হোটেলে বন্ধুরা আমাদে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাত ও বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা দেখে পরের দিন কিবালে মারী রওয়ানা হয়ে মাগরিবের সময় গিয়ে মারী হাজির হই। রাওয়ালপিন্ডি হতে মারীর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। মারী শহরটি সাড়ে সাত হাজার ফিট উঁচুতে একটি শৈল নিবাস। শীতের সময় এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়। পাহাড়ী রাস্তায় নীচে থেকে উঁচুতে চড়তে এবং বর্ষায় রাস্তা ভিজা থাকার কারণে আমাদের গাড়ি খুব আস্তে আস্তে চলছিল। মারীতে আমরা মারী জামায়াতে ইসলামীর আমীর এহভোকেট রাজা ইমতিয়াজের বাড়িতে মেহমান ছিলাম।(১) গুঁড়ি গুঁড়ি বর্ষায় রাত্রে মারীতে এপ্রিল মাসের শেষে অস্বাভাবিক শীত ছিল।
রাত্রে আমরা আমাদের জামা-সোয়েটারসহ চার চাটি কম্বল গায়ে দিয়েও শীত ঠেকাতেপারছিলামনা। ভোরে নামাজান্তে নাস্তা ইত্যাদি সেরে আটটার দিকে আমরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মোযাফফারাবাদ রওয়ানা হই। মারী হতে মোযাফফারাবাদ শহরের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার মাত্র। কিন্তু পাহাড়ী রাস্তার চড়াই উৎড়াই অতিক্রম করে এই ৫৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে আমাদের প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লেগেছিল।
আযাদ কাশ্মীর জামায়াতের আমীর কর্ণেল রশীদ আব্বাসী এখানে আমাদেরকে শহরের প্রবেশদ্বারে অভ্যার্থনা জানান। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সরকারী রেষ্ট হাউজে। এ দিন বিকালে আমরা ঝিলম নদীর পারে বাদশাহ আকবরের তৈরী দুর্গ দেখতে যাই। মাগরিব বাদ রেষ্ট হাউজে ফিরে আসি। এই রাত্রে খুব বর্ষা হচ্ছিল বিধায় শহরে বের হওয়া সম্ভব ছিল না, ভোরে নাস্তা সেরে কর্ণেল আব্বাসীসহ শহর হতে পাঁচ মাইল দূরে লোহারী গেট ভিউ পয়েন্টে গিয়ে মোযাজ্জারাবাদ শহরের দৃশ্য অবলোকন করি। মাগরিব বাদ আমাদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক অভ্যার্থনা সভায় যোগদান করি। পরের দিন ২৮ এপ্রিল ভোরে নাস্তা সেরে আমরা এবাটবাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ধীর গতিতে ২২ কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তা অতিক্রম করে গাড্ডি হাবিবুল্লাহ নামক স্থানে আমরা কুনহার নদী পার হই।
কুনহার নদী হিমালয় হতে প্রবাহিত হয়ে কাগন ভেলী হয়ে ঝিলামের সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীর পারে বালাকোট নামক স্থানে সাইয়েদ আহম্মদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ শীখদের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। এই স্থানটিতে আমরা ১৯৬২ সালে সফর করেছি। গাড্ডি হাবিবুল্লাহ হতে বালাকোটের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। যুদ্ধ শেষে সাইয়েদ শহীদের সাথীরা সাইয়েদ শহীদের মস্তক বিহীন দেহ বালাকোটে দাফন করেন। পরে খোঁজাখুঁজি করে গাড্ডি হাববিুল্লাহ কুনহার নদীতে সাইয়েদ শহীদের ছিন্ন মস্তক পেয়ে তাঁর সাথীরা ওখা্ই তাঁর মস্তক দাফন করেন। কুনহার নদীটি খুবই খরস্রোতা। বালাকোটে শিখেরা যখন অতর্কিত আক্রমণ করেছিল। তখন সাইয়েদ সাহেব ও তাঁর সাথীরা অপ্রস্তুত ছিলেন। প্রকাশ থাকে যে, এক মসুলম বিশ্বাসঘাতক শিখ বাহিনীকে সাইয়েদ সাহেবের অবস্থানের খবর দিয়ে গোপন আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী মুসলমানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুসলিম নামধারী স্বার্থপর মীল জাফররাই মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছি।
মোযাফফরাবাদ থেকে রওয়ানা হয়ে ৫২ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বেলা ১১টার দিকে আমরা মানসেরা ফৌঁছি। মানসেরা হতে গিলগিট হয়ে রেশমী রোড চায়না চলে গিয়েছে। এই রোড তৈরির পর স্থল পথে চায়নার সাথে পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে।
আমাদের রাত্রের প্রগ্রাম এবং অবস্থান ছিল এবাটাবাদে , সেখানে লাহোর হতে আগেওভাগেই খাবর দেয়া হয়েছিল। মানসেরায় আমাদের কোন প্রগ্রাম ছিল না। বিধায় পূর্বাহ্নেই কোন খবর দেয়া হয়নি। কিন্তু মাসেরা হতে চুপচাপ পুরান বন্ধুদের সাথে দেখা না করে চলে যাব এটা আমার মন মানল না। তাই জামায়াত নেতা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এডভোকেট শওকাত সাহেবের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বার লাইব্রেরীতে গিয়ে হাজির হই। এধরনের অপ্রত্যাশিত আগমনে শওকাত সাহেব যেমন আশ্চার্য হয়েছিলেন, তেমনি বেশ খুশীও হয়েছিলেন। এখানে আমার এক কালের জাতীয় পরিষদের সাথী সদস্য, প্রাক্তন মন্ত্রী হানিফ খানের সাক্ষাত পাই। তিনি ও শওকাত সাহেব উভয়ই অন্ততঃ একদিন মানসেরায় অবস্থানের জন্য আমাকে বেশ অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু রাত্রে আমার প্রগ্রাম এবাটাবাদে থাকার কারণে বন্ধদের অনুরোধ রক্ষায় অপারগ বলে জানাই। শওকাত সাহেব আমাদেরকে নিয়ে শহরে তার বড়িতে আসেন। এখানেই আমরা উপস্থিত মত দুপুরের খানা খেয়ে জামায়াত অফিসে চলে আসি। শওকাত সাহেব স্বল্প সময়ের নোটিশে তড়িগড়ি করে জামায়াত কর্মীদের এক সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার পরে বন্ধুদের প্রশ্নের জওয়াব দান করে চা পর্ব শেষ করে এবোটাবাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে বাংলাদেশের আর কোন জামায়াত নেতাকে এভাবে বন্ধুরা পাননি, ফলে বাঙলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব ইত্যাদি আমার কাছ থেকে জানার জন্য সর্বত্রই বন্ধুরা আগ্রহশীল ছিলেন।
(১) টীকাঃ
এ্যাডভোকেট রাজা ইমতিয়াজ একজন ধনী লোক। ইনি আমার পুরাতন বন্ধু, রাজা সাহেবের পিতার বাড়ি রাওয়ালপিন্ডি। মারী ও মারী হতে ১৫ মাইল উত্তরে সুরাসি নামক স্থানেও ২ খানা বাড়ি আছে। আমি, আব্বাস আলী খান, শামসুর রহমান সাহেব ও ব্যারিষ্টার আখতারুদ্দীন ১৯৬৩ সালে জাতীয় পরিষদের সেশন চলাকালে মাসাধিককাল তাদের রাওলপিন্ডির বাড়িতে ছিলাম। ঐ বছরই আমরা তার পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সুরাসি গ্রামের বাড়িতে বেড়িয়েছি। ইমতিয়াজ সাহেবের পিতা ছিলেন বেশ কয়েকটি পাহাড়ের মালিক একজন জমিদার।
পরের পর্বে থাকছেঃ এবোটাবাদে আমার রাত্রে অবস্থান ও প্রগ্রামে অংশগ্রহণঃ
বিষয়: বিবিধ
১৬৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন