জিহাদ ও বিজয়ের মাস মাহে রমাযানঃ
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ১৭ জুলাই, ২০১৩, ০৫:১০:১৭ বিকাল
﴿كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾
বাকারা ২১৬) তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়! হতে পারে তোমরা যা অপছন্দ করো তাতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর তোমরা যা পছন্দ করো তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা যা জান না।
বর্তমান জমানায় জিহাদের কথা শুনলেই আমরা আঁৎকে উঠি। যে সকল ইসলামী সাহিত্যে জিহাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে তাকে জিহাদী বই বলে এক শ্রেণীর ইসলাম বিদ্বেষীর অপপ্রচারে আমরাও হিনমন্বতায় ভুগি, অথচ আমরা অনেকেই জানিনা জিহাদ কি এবং কেন?
সংজ্ঞাঃ জিহাদের বাংলা অর্থ করা হয়েছে যুদ্ধ আসলে জিহাদ অর্থ যুদ্ধ নয় বরং জিহাদের সবচেয়ে উত্তম অর্থ হতে পারে বিপ্লব। বিপ্লব মানে সমাজে প্রচলিত রীতি নীতি বিধি বিধানকে পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নতুন বিধি বিধান প্রতিষ্ঠা করা। আর এজন্য যত প্রকার কর্ম প্রচেষ্টা আছে তার সার্বিক কার্যক্রমই হল বিপ্লবি কাজ। ঠিক তদরূপ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন কায়েমের স্বার্থে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ইসলামী বিধান কায়েম করার জন্য সার্বিক প্রচেষ্টার নামই হল জিহাদ।
দুনিয়া যখন সীমাহীন অবিচার যুলম নিপিড়নে ছেয়ে গেছে তখন আল্লাহ নিজেই লড়াই সংগ্রামে ঝপিয়ে পড়ার জন্য মুমিনদের নির্দেশ দেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
﴿وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَٰذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا﴾
নিসা ৭৫) তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে ? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব ! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু , অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও৷
﴿الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ ۖ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا﴾
নিসা ৭৬) যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে ৷ কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল৷
আবুজার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল উত্তম? তিনি বললেনঃ আল্লাহর উপর ঈমান ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ' (বুখারী ও মুসলিম)
আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ বেহেশতের মধ্যে ১শ'টি মর্যাদা (সিঁড়ি) আছে, আল্লাহ মুজাহিদদের জন্য সেগুলো তৈরি করে রেখেছেন। দুইটি মর্যাদার মধ্যে আসমান ও যমীনের মধ্যে যতটুকু ব্যবধান ঠিক ততটুকু ব্যবধান রয়েছে। (বোখারী)
আমর বিন আবাসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সামান্যতম সময়ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে, আল্লাহ তার চেহারার জন্য দোজখের আগুন হারাম করে দেবেন (আহমদ)
সাহল বিন হোনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে শাহাদত প্রার্থনা করে, সে বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন। (মুসলিম)
খোরাইম বিন ফাতেক থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় দান করে তার জন্য ৭শ'গুণ সওয়াব লেখা হয়।
যায়েদ বিন খালেদ আল জোহানী থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোন যোদ্ধাকে অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে প্রস্তুত করে দেয় সেও গাজীর (মুজাহিদের) মর্যাদা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি যোদ্ধার অবর্তমানে তার পরিবার পরিজনকে তদারক ও সাহায্য করবে সেও মুজাহিদের মর্যাদা লাভ করবে। (বুখারী, মুসলিম)
জিহাদ শুধু লড়াই সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। লড়াই সংগ্রাম হল জিহাদের একটা অংশ মাত্র। চুড়ান্ত লড়াই এর আগে ও পরে আরও চারটি কাজ রয়েছে। সব মিলিয়ে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর ৫টি ভাগ রয়েছে। যার কোনটারই গুরুত্ব কম নয়। আর মজার বিষয় হল প্রত্যক্ষ্য লড়াইকে আমরা যারা ভয় পাই তাদের জন্য প্রথমেই দুটো সহজ কাজ রয়েছে যা ইচ্ছা করলে সবাই করতে পারে। আর সে কাজ দুটো যথাযথ ভাবে করতে পারলে পত্যক্ষ্য লড়াই এর মত কঠিণ কাজটা আর কঠিণ থাকেনা বরং পানির মত সহজ হয়ে যায়।
জিহাদের শ্রেণী বিভাগঃ
০১) দাওয়াত ইলাল্লাহ (আল্লাহর দিকে আহ্বান)
০২) সাহাদাতে আলান্নাস (সত্যের সাক্ষ)
০৩) কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ (লড়াই সংগ্রাম)
০৪) ইক্বামতে দ্বীন (দীন প্রতিষ্ঠা)
০৫) আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দান)
রমযান ও জিহাদঃ রমযান যেমন কুরআন নাজিলের মাস তেমনি রমযান কুরআ'নকে বিজয়ি করা এবং কুরআনের বিধানকে বাস্তব রূপ দেয়ারও মাস। যার প্রমাণ আমরা পাই বদরের প্রান্তে।
বদরের প্রান্ত থেকে যে বিজয়ের সূচনা হয়েছিল তা অব্যহত আছে আজ অবধী। যতদিন মুসলমানরা জিহাদের জজবা অন্তরে লালন করবে ততদিন মুসলমানদের কেউ পরাজিত করতে পারবেনা।
বদরের প্রান্তর থেকে শুরু করে মুসলমানদের ধারাবহিক বিজয়ঃ
﴿وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ بِبَدْرٍ وَأَنتُمْ أَذِلَّةٌ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
১২৩) আল্লাহ তোমাদের বদরের প্রান্তে সাহয্য করেছেন এবং বিজয় দান করেছেন, তোমরা ছিলে দূর্বল ৷ কাজেই আল্লাহর না–শোকরী করা থেকে তোমাদের দূরে থাকা উচিত, আশা করা যায় এবার তোমরা শোকর গুজার হবে ৷
দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমযান বদরের প্রান্তে মুসলমানরা ১০০০ জনের সুসজ্যিত কুরআইশ বাহিনির মোকাবেলায় মাত্র ৩৬০ জনের ক্ষদ্র বাহিনী নিয়ে আল্লাহর রহমতে বিজয় অর্জন করে। মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ের ধারা আজ পর্যন্ত ও অব্যাহত আছে।
পর্যায় ক্রমে ওহুদ, খন্দক এর পথ পাড়ি দিয়ে ৮ম হিজরির ২০শে রমযান রাসূল (সঃ) এর নেতৃত্বে মক্কা বিজয় হয়। মক্কা বিজয় ছিল মুসলমানদের জন্য সুস্পষ্ট বিজয়।
আল্লাহ তা'য়ালা রব্বুল ইজ্জত নিজেই ঘোষনা করেণঃ إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا﴾
ফাতাহ ১) হে নবী, আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।
রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধে তাবুক অভিজানের সমাপ্তি ঘটে নবম হিজরির রমযান মাসে।
রাসূল (সঃ) এর ওফাতের পরেও রমযান মাসে মুসলমানদের বিজয় অব্যাহত ছিলঃ
দ্বিতীয় খলিফা ওমরের শাসন আমলে ১৫ হিজরীর ১৩ই রমযান হযরত আবু ওবায়দাহ বিন জাররাহর নেতৃত্বে জেরুসালেম জয় হয়।
১৫ হিজরীর রমযান মাসে সা'দ বিন ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী, পারস্য সম্রাটের সেনাপতি রুস্তুমের নেতৃত্বাধিন বাহিনীকে পরাজিত করে।
দুনিয়ার বড় বড় শক্তি গুলো যখন মুসলিম বাহিনীর হাতে পদানত হচ্ছিল তখন তৎকালীন পরাশক্তি রোম সম্রাজ্য মুসলমানদের সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল কিন্তু হযরত আমর বিন আস এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ২০ হিজরীর ২রা রমযান ব্যবিলন দুর্গ অবরোধ করে। শেষ পর্যন্ত রোমান বাহিনী মুসলিম বাহিনীর হাতে পরাজিত এবং পর্যদুস্ত হয়।
৯২ হিজরীর রমযান মাসে তারেক বিন জিয়াদের হাতে স্পেন বিজয় হয়।
৯৩ হিজরীর ৯ই রমযান মুসা বিন নোসাইর এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পরিপূর্ণ ভাবে স্পেন জয় করে।
২১২ হিজরীর রমযান মাসে যিয়াদ বিন আগলাবের নেতৃত্বে ইটালীর সিসিলি দ্বীপ জয় হয়।
২২৩ হিজরীর ৬ই রমযান, রবিবার আব্বাসি খলিফা মোতাসিম বিল্লাহ বাইজানটাইন সম্রাটকে পরাজিত করে আমুরিয়া জয় করেন।
৪৬৩ হিজরীর ২৫শে রমযান সেলযুক রাষ্ট্রের সুলতান ও মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক আলফ আরসালান বাইজানটাইন সম্রাজ্যের উপর জয়লাভ করেন।
৪৬৫ হিজরীতে আলফ আরসালান ২ লাখ মুসলিম মুজাহিদ সহ যাইদুন নদীর উপরে বিরাট পুল নির্মান করে চীনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন কিন্তু ৪৬৫ হিজরীর ১০ই সফর তিনি ইনতেকাল করেণ। ফলে চীন বিজয় অসমাপ্ত থেকে যায়।
৫৩২ হিজরীর রমযান মাসে এমাদুদ্দিন জংগীর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী খৃস্টান ক্রুসেডারদের পরাজিত করে সিরিয়ার হাবল শহর জয় করেন।
৫৮৩ হিজরীর রমযান মাসে মিসরের সুলতান সালহ উদ্দিন ইউসুফ বিন আইউব বায়তুল মাকদেস উদ্ধারের লক্ষে হিত্তিন ময়দানে পৌছেন এবং ১ লাখ ৬৩ হাজার খৃস্টান অশ্বারোহীকে পরাজিত করেন।
৬৬৬ হিজরীর রমযান মাসে জাহের বাইবারস, তাতারদের কাছ থেকে তুরস্ক দখল করে।
৭০২ হিজরীর রমযান মাসে মিসরীয় বাহিনী তাতারদের আর একটি অভিযান ব্যার্থ করে দেন এবং দক্ষিণ দামেষ্কে তাতারদের ১০ হাজার সৈন্যকে বন্ধি করেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) কনস্টান্টিনোপল সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেছেন যে, তোমরা কনস্টান্টিনোপল জয় করবে, সেই যুদ্ধের আমীর কতইনা ভাল এবং সেই সেনাবাহিনীও কতইনা উত্তম!
তুরস্কের ওসমানী শাসক সুলতান মোহাম্মদ আল ফতেহ ৫৯ দিন কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করে রাখার পর ১৮০৩ খস্টাব্দের ৪ঠা মেয়ে মুসলমানদের হাতে কনস্টান্টিনপোল জয় হয়।
সর্ব শেষ ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম মিসরীয় পদাতিক বাহিনী পবিত্র রমযান মাসে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে ইসাঈলী বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে, যা ছিল ইসরাঈলের কল্পনাতীত। আমেরিকা ইসরাঈলকে সেদিন রক্ষা না করলে তার পরাজয় সুনিশ্চত ছিল।
রমযান সত্যিই বিজয় ও বরকতের মাস। আসুণ আমরা রমজানের শিক্ষায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে নিজেকে সত্যিকারের মুমিন মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলি।
বিষয়: বিবিধ
২৫৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন