সাঈদীগেট এবং সংবাদমাধ্যমের বিস্ময়কর নিরবতা :অমি রহমান পিয়াল

লিখেছেন লিখেছেন চোথাবাজ ০৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৩:৫৬:২৭ দুপুর



এ লেখাটা লেখার আগে গণমাধ্যমে পরিচিত বেশ কজন সাংবাদিককে ফোন করেছিলাম। খুব কমন একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে: দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নাকি একটা অডিও টেপ এসেছে বাজারে? ‘আরে আপনি জানেন না! কেলেংকারি ঘটনা!… বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে সাঈদীর ফোনালাপের রেকর্ডিং… শুনলে হাসতে হাসতে মরে যাবেন… ইউটিউবে পাবেন… অনলাইনে সার্চ দিলেই তো লিংক মিলে… ইত্যাদি ইত্যাদি।’ কজন সহৃদয় সাংবাদিক আমাকে লিংক এমনকী অডিও ক্লিপ মেইল পর্যন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ সরল জিজ্ঞাসার একটি উদ্দেশ্য ছিল। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর একটা টেপ বাজারে এসেছে। যেখানে বিদেশি যেকোনো যৌন-কেলেংকারির লাইন-বাই-লাইন আমাদের পত্রিকাগুলো ছাপায়, ট্যাবলয়েডগুলো যেখানে কোনো ধর্ষণের খবর উত্তেজক মোড়কে পরিবেশন করে, সেখানে এ নিরবতা যথেষ্ট বিস্ময় জাগায়। ফেসবুক ব্লগগুলো যেখানে এ নিয়ে সোচ্চার সেখানে মূলধারার পত্রিকাগুলোর নিরবতা রহস্যজনকও বটে! সাংবাদিকরা জানেন কিন্তু খবরটা ছাড়ছেন না!

অথচ সম্প্রতি ঠিক উল্টোটা আমরা দেখেছি। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের সঙ্গে একজন প্রবাসী আইন উপদেষ্টার স্কাইপ-আলাপনের রেকর্ডিং আমাদের পত্রিকাগুলো ফলাও করে ছাপিয়েছে। প্রতিদিন সম্পূরক খবর এসেছে যাকে আমরা ফলোআপ বলি। কিন্তু এখন এ নিরবতার মানে কী? স্কাইপে কারও ব্যক্তিগত কথোপকথন গোপনে সংগ্রহ করে প্রকাশ নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগোপনীয়তার মারাত্মক লঙ্ঘন। কিন্তু পত্রিকাগুলো সে এথিকসের ধার ধারেনি। ৮ টাকার পত্রিকাও দু’টাকার পত্রিকার মানে নামতে দ্বিধা করেনি সে সংলাপের রসালো এবং হাইলাইটেড পরিবেশনায়। মোটের ওপর খবর এসেছে প্রতিটি পত্রিকাতেই। সেই তারাই কেন নিরব? কেন নিরব সরকারপক্ষের বলে চিহ্নিত মিডিয়াগুলো?

প্রসঙ্গত বলতেই হয়, স্কাইপ-কেলেংকারিতে সংশ্লিষ্ট বিচারক শুধু পদত্যাগই করেননি, সে সঙ্গে স্থগিত হয়ে আছে বহুলপ্রতীক্ষিত একটি রায়। সে রায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের মামলার রায়। আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি যখন সোল্লাসে এ কেলেংকারি উদযাপন করছে, সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের জন্য নোবেল পুরস্কার দাবি করছে- তার মধ্যেই এ টেপ বাজারে এসেছে। কিন্তু এক যাত্রায় ভিন্ন ফলের মানে কী!

এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামীর যাবতীয় বাজি সাঈদীর ওপরই। কারণ গোলাম আযম বা নিজামীদের যেমন সরাসরি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে- দলীয়ভাবে সে তুলনায় সাঈদী একটু পিছিয়ে। সে যুদ্ধাপরাধ করেছে নিজের উদ্যোগে, জামায়াতের হয়ে নয়, পরে সে জামায়াতে যোগ দিয়েছে, নিজেকে তাদের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সারাদেশে জামাতের পক্ষে যেটুকু গণসমর্থন সেটুকু সাঈদীর সৌজন্যেই। তাই সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় হলে জামায়াত ও ছাত্র শিবির সারাদেশে আগুন জ্বালানোর জন্য কিছু অরাজনৈতিক লোককেও সঙ্গে পাবে যারা সাঈদীর ভক্ত। কিন্তু এ টেপ তা ভণ্ডুল করে দিতে পারে। বিভিন্ন দেশ থেকে সাঈদীকে রক্ষা করতে তার ভক্তকুল যে কোটি কোটি টাকা অনুদান হিসেবে পাঠাচ্ছে তা মুহুর্তেই থেমে যাবে। কোনো প্রমাণিত লম্পটের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে পাপের ভাগীদার হতে চাইবে কোন ঈমানদার!

অনলাইনে টেপগুলো ছাড়ার পর প্রাথমিকভাবে সাঈদী-ভক্তদের প্রতিক্রিয়া ছিল এগুলো বানোয়াট, অভিনয় করে বানানো, সফটওয়ার ব্যবহার করে বানানো ইত্যাদি। স্কাইপ-কেলেঙ্কারির সময় যেটা তাদের একবারও মনে হয়নি, সে সন্দেহই এবার বেশ তীব্রভাবে জানান দিয়েছে এবং হাস্যকরভাবে আমাকে জড়ানো হচ্ছে। এমনকী বাংলালিকস নামে যে সংগঠন এসব টেপ ভুয়া প্রমাণ করতে পারলে এক লাখ ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে, তাদের অনলাইন ঠিকানা এবং মেইলিং অ্যাড্রেস দিয়েছে- সেটাও আমলে নিচ্ছে না তারা। আমার ছবি দিয়ে সেখানে বাড়তি টেক্সট জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে আমি নাকি সাঈদীর অডিও টেপ সফটওয়ারের মাধ্যমে তৈরি করে বাজারে ছেড়েছি!

এরকম একটা ঘৃণ্য ও মিথ্যে অভিযোগের মাধ্যমে আমার ও আমার পরিবারকে যে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হল তার দায় কে নেবে? কাল বা পরশু আমাকে হত্যা করা হল, তারপর ধামাচাপা পড়ে যাবে এ কেলেংকারি? আমি মিথ্যা অভিযোগে বলির পাঠা হয়ে আমৃত্যু এক কলঙ্ক বয়ে বেড়াব! আমার উত্তরসূরীরা এক প্রতারকের সন্তান বলে পরিচিত হবে? কেন? আমি প্রয়োজনে আদালতে যাব এ অন্যায় অভিযোগের প্রতিকার খুঁজতে, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

কিন্তু তার আগে আমার জানতে হবে সংবাদমাধ্যমের এ নিরবতার উৎস কী? কোন অদৃশ্য হাতজোড়া তাদের মুখচাপা দিয়ে রেখেছে! ট্রাইব্যুনালে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে তার মধ্যে অভিযুক্তদের একটা বড় অংশ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এদের অর্ধেকেরও বেশি সাংবাদিক ছিলেন। তাদের পরিচিতি দিয়ে ঢাকা প্রেসক্লাবের বাইরে একটা বড়সড় স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। আফসোস, এ হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাতেও ছিলেন একজন সাংবাদিক। বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা নিহতদের বিচারের চেয়ে মনে হয় অভিযুক্তকে রেহাই দিতে বেশি মরিয়া। তাদের আচরণ সে নির্দেশনাই দিচ্ছে। তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। টেপটি সত্য না ভুয়া এ বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে অন্তত খবরটি জনগণকে জানানো উচিত ছিল।

আমার অরবিচুয়ারির জন্য অপেক্ষা করা তাদের উচিত হবে না।

অমি রহমান পিয়াল : ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।

বিষয়: বিবিধ

১৩৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File