হেফাজতী উত্থান, ফ্লপ, আগামী নির্বাচন: বাংলাদেশ না বাংলাস্থান?
লিখেছেন লিখেছেন চোথাবাজ ১৫ জুন, ২০১৩, ০১:০৮:৪১ দুপুর
মঞ্চ” আন্দোলনটি স্রেফ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীর আন্দোলন বিবেচনা করলে হঠাৎ হেফাজতের উত্থান বিষয়ে আমরা সঠিক কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারবো না। খুব সোজা আর সরাসরি প্রশ্ন করলে বলতে হয়, কাদের মোল্লা-সাঈদীর ফাঁসির রায় সমস্ত ইসলামী আন্দোলনকারীদের মাথা ব্যথার কারণ হতে যাবে কেন? কেন হেফাজত, কওমি, পরীর-মুরশিদ, জামায়াত এক ঘাটে জল খেলো?
ইসলামে ফ্যাকরার শেষ নেই। মত বিরোধ, ব্যাখ্যার ভিন্নতা আলেম-ওলামাদের মাঝে তৈরি করেছে বিস্তর ব্যবধান। শুধু তাই নয়, এই ভিন্নতার দরুণ একে অপরকে মুসলিম কিনা সেই বিষয়ে সরাসরি মতামত দিয়ে বসছে। তাদের দাড়িতে পার্থক্য, পাগরিতে পার্থক্য। এজন্য আমরা দেখি ইসলামী ব্যাখা নিয়ে তাদের মতবিরোধ মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তাদের সাগরেদরা এই নিয়ে রাজপথে রক্তারক্তি পর্যন্ত ঘটিয়ে দেয়। একজন আলেম আরেকজন আলেমকে ধর্মব্যবসায়ী, বেদাতী, ইসলামচ্যুত বলে অভিযোগে অভিযুক্ত করেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। জামাযাত ইসলামীর মওদুদীবাদকে বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসলামী দল ও গ্র“প ভ্রান্ত, সঠিক ইসলাম নয় এবং এই জন্য জামায়াত ইসলামী কোন ইসলামী দলই না বলে তারা মনে করে। স্মরণ করা যেতে পারে হেফাজতের নেতৃবৃন্দরা বলেছিলেন, আমরা আওয়ামী লীগের চেয়েও জামায়াতকে বেশি অপছন্দ করি। সেই হেফাজত কেন জামায়াতের কুখ্যাত নেতাদের ফাঁসির দাবীতে গড়ে উঠা একটা অহিংস আন্দোলনকে দমন করার জন্য মাঠে নামলো? এখানে রাজনীতির ফয়দাটা কোথায়? যারা রাজনীতি করেন তারা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশন নন। লাভ-লোকশান হিসেব করে পা ফেলাই তাদের কাজ। তাহলে গণজাগরণ মঞ্চ চক্ষুশূল হলো কেন বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকারীদের চোখ?
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আমাদের অনেকের কাছে নিছক একটা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীর আন্দোলন মনে হলেও দেশের লক্ষ লক্ষ আলেম-ওলামাগণ তাদের অস্তিত্ব বিপন্নের আন্দোলন হিসেবেই দেখেছেন! তারা দেখেছেন তরুণদের জাগরণ। দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ফের জেগে উঠছে তরুণ কন্ঠে। এতকাল যে বুলি আওয়ামী লীগের একান্ত বলে চালানো গেছে তা ফের বাঙালীর চেতনা জাগনীয়া শ্লোগান হিসেবে ফিরে এসেছে। এসব আর যাই হোক তাদের জন্য ভাল লক্ষণ নয়।
কেন ভাল নয়? খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই চেতনা বা শ্লোগানের কোথাও ইসলামের বিরুদ্ধে কোন শব্দ বা ইঙ্গিত আছে? “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা”- এর মধ্যে কোথায় ইসলামের বিপরীত সেন্টিমেন্ট আছে? এদেশের মানুষের ঠিকানা তো এটাই। আর কেউ যদি দাবী করেও তার ঠিকানা এখানে নয় অন্য কোথাও তাহলেও তো কোন সমস্যা নেই। কেউ যদি বলেন তারা মক্কা-মদিনা বা আফগানিস্থান বা কাজাকিস্থান কিংবা পাকিস্তান, আর তার বিপরীতে কেউ বলেন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তার ঠিকানা এতে কোন পক্ষরই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। কিংবা “জয় বাংলা” বললে সেটা বাংলার জয়ই বোঝায়। বাংলার জয় তো যে কেউ চাইতেই পারে। ইসলামী দল বা গোষ্ঠিও যদি বাংলার জয় চায় তাহলে ঈমান-আকিদায় কোন হেরফের হবে না। দেশপ্রেম যদি ঈমানের অঙ্গ হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা রাজনীতির। এই গণজাগরণ মঞ্চ যে তারুণ্যের জোয়ার তুলেছে তা ইসলামী আন্দোলনকারীদের পাকিস্তান আমলের কথাই হয়ত মনে করিয়ে দিয়েছে। ৪৭-এ দেশভাগ হলো ধর্মের ভিত্তিতে। মুসলমান ভাই ভাই। এক জাতি এক দেশ। “ হাত মে বিড়ি মু মে পান লড়কে লেংগে পাকিস্তান”। ২৩ বছরের মাথায় সেই একই জাতির মুখে অন্য বুলি, “তুমি কে আমি কে? বাঙালী বাঙালী”, “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”! এবং তাজ্জব কথা সেই একই জাতি মন্ত্রমুগ্ধের মত গিলতে লাগলো, বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ- আমরা সবাই বাঙালী!
পাকিস্তান ভেঙ্গে যেতে এরপর আর সময় লাগেনি। সেই দগদগে ঘায়ের মত স্মৃতি আজো তাদের তাড়িয়ে ফেরে। পাকিস্তান তো তাদের জন্য মন্দ ছিল না। পাকিস্তান ভাঙ্গা মানে কি তারা জানতো। পাকিস্তান ভাঙ্গা মনে শুধু একটা দেশ ভাঙ্গা নয়। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি হওয়া মানে একটা আদর্শকে লালন-পালন করা। সে আদর্শ বেড়ে চললে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিক প্রচন্ড চাপে পড়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা যে নতুন আদর্শে দীক্ষিত হলো এরপর কি তারা মুসলিম জাহানের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবে? এইসব ভাবতে ভাবতে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। জন্ম নিয়েছে নতুন আদর্শে চেতনায় বলিয়ান “বাংলাদেশ”।
চোখের সামনে পাকিস্তান ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই কন্ঠ সেই তারুণ্য আবারো ভর করেছে ২০১৩ সালে। ৭৫-এর পর বাংলাদেশ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে “জয় বাংলা” থেকে। হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশ পাকিস্তান বা আফগানিস্থান যায়নি সত্য, কিন্তু কাছাকাছি কোথাও গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখান থেকে “জয় বাংলা” দূরে কিন্তু অস্পষ্ট নয়। ভবিষ্যতে হয়ত চিরতরে ঘঁষে মেজে দৃষ্টিসীমার বাইরের নিয়ে গিয়ে ফেলবে। কিন্তু এখন সেই অর্জনটুকু, এতদিনের অর্জন সবটুকু ভেস্তে যাবে? এই লক্ষ লক্ষ তরুণ ঘর ছেড়ে রাত-দিন চিন্তা বাদ দিয়ে এসে পড়ে আছে রাজপথে, রাজনৈতিক কোন স্বার্থ নাই, টাকা-কড়ির কোন ব্যাপার নাই, নাম-যশের কোন ইচ্ছা নাই- এইরকম একটা তারুণ্যকে সহজভাবে নেয়া যায় না। এতো অশনি সংকেত! এর বিপরীতে কিছু দাঁড় করাতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র...।
এই জাগরণকে ভাঙ্গতে না পারলে ভবিষ্যতে ইসলামী ভাবধারার তরুণ সমাজ নির্মাণ করা কখনই সম্ভব হবে না। তরুণ সমাজকে সামনের কাতারে নিয়ে আসতে না পারলে কোন আন্দোলন-সংগ্রাম আদর্শ কোনদিনই সফলতা সম্ভব হবে না। কাজেই সহজ সরল সমিকরণ, গণজাগরণ মঞ্চ ঠেকাও, যেমন করে পারো, যেভাবে পারো...।
হেফাজতের একটা অপশন প্রয়োজন ছিল, জামায়াত সেটা জানতো। জামায়াত তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে বিপদটা শুধু তাদের একার নয়। বাংলাদেশের সমস্ত ইসলামী আন্দোলন গত ৪২ বছরে যতটুকু এগিয়েছে এবার এই গণজাগরণ মঞ্চ ১০০ বছর পিছিয়ে দিবে। ৭৫- পরবর্তী সমস্ত বৈধ-অবৈধ, স্বৈরচারী, গণতান্ত্রিক সবার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বিষ্ময়কর অগ্রগতি লাভ করেছে। গত ৪২ বছরে ওয়াজ মাহফিলের নামে শহীদ মিনারকে পূজা-অর্চনা, পহেলা বৈশাখকে হিন্দুর অনুষ্ঠান মতধারায় সমাজের একটা অংশকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে। নারী নেতৃত্ব হারাম এই থিউরি পুরোপুরি কোরআন-হাদিস থেকে বেঁটে খাওয়াতে পারলে আর বাকী থাকলো কি? মঈনুদ্দিন-ফকরুদ্দিনের “মাইনাস টু” থিউরির পেছনে এমন কোন শক্ত প্রমাণপত্র ছিল না যেটা তারা পাবলিককে খাওয়াতে পেরেছিল। কিন্তু হুজুরদের ঐশ্বরিক সার্টিফিকেট আছে!
জামায়াত ইন্টারনেট ব্লগ-ফেইসবুকে ওদের বেতনভুক্ত ২৪ ঘন্টার কর্মীবাহিনী নিয়োগ করে বসে আছে। ব্লগে-ফেইসবুকে কারুর লেখা পছন্দ না হলে ওরা ব্লগারদের নাম-ঠিকুজি জোগার করে চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শাহবাগ আন্দোলন যে সব ব্লগাররা রাত-দিন জমিয়ে তুলছিল নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাদের চিহ্নিত করে তাদের ধর্ম সম্পর্কিত লেখাগুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরার আয়োজনের ব্যবস্থা করে। মাহমুদুর রহমান তার ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় সেসব ছেপে জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। ব্লগে যারা লেখা দেন তারা জনসম্মুখে প্রকাশের উদ্দেশ্যেই দেন। আমার এই লেখাটিও জনসম্মুখে প্রকাশের উদ্দেশ্যেই লেখা। কাজেই মাহমুদুর আর জামায়াত হেফাজতের জন্য যেটা করেছে সেটা হলো, গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিহত করার জন্য “নাস্তিক রসূল আল্লা বিরোধী” একদল তরণদের পরিচয় করিয়ে দেয়া আর বলা হয় এরাই তারা যারা শহবাগে “গণজাগরণ মঞ্চ” তৈরি করেছে, এইসব নাস্তিক ব্লগাররা প্রিয় নবীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আল্লার অস্তিত্ব বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। যা মুসলামদেরকে হেয় ও তাদের প্রিয় ইসলামকে ধ্বংস করার চক্রান্ত...।
যাই হোক, হেফাজতকে কল্পনার আকাশ থেকে বাস্তবের মাটিতে এনে ফেলা হয় অবশেষে। রাতের আঁধারে চোরের মত মতিঝিল ছাড়তে বাধ্য হয় তারা। সরকার এরকম কিছু করতে পারবে বা সাহস হবে করতে সম্ভবত এটা তাদের ভাবনাতেও ছিল না। শুধু তারা কেন, যারা শেয়ালের মত ওঁত পেতে বসেছিল সুবিধার ভাগ নেয়ার জন্য (বিএনপি-জামায়াত) তারাও ভাবেনি সরকার হুজুরদের উপর এরকম অতর্কিত আক্রমন চলাতে সাহস করবে।
হেফাজত অবশেষে মাদ্রাসায় গিয়ে সিঁধিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চও এখন মিয়্রমান। এরমধ্যে একটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা ঘটেছে দেশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা স্পীকার নির্বাচিত। হেফাজতের ১৩ দফা বিশেষত নারী নেতৃত্ব হারাম নিয়ে ক’দিন আগেও যেখানে সরগরম ছিল সেখানে সরকারের একজন মহিলাকে স্পীকার নির্বাচিত করেছে।
হেফাজত হুজুগ শেষ হয়েছে ভাবলে মস্তবড় ভুল হবে। সম্প্রতি চার সিটি নির্বাচনে অলরেডি তারা তাদের ধর্মের খেলা শুরু করে দিয়েছে। তারা প্রচার করছে ১৮ দলীয় প্রার্থী ইসলামের পক্ষের লোক আর বিপক্ষের মহাজোটের প্রার্থী হলো ইসলামের বিপক্ষের লোক। খুবই সোজাসাপ্টা প্রচারণা। অনেকেই এই নির্বাচনে হেফাজতকে ফ্যাক্টও হিসেবে দেখছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনেও এই হেফাজত ফের দেশকে ধর্ম দ্বারা দ্বিখন্ডিত করতে চাইবে। ১৮ দরীয় জোট তথা বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচনের বৈতরণী পার করার সব রকম চেষ্টাই তারা করবে। আমাদের সামনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাই বলতে গেলে “ডু অর ডাই” বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের জন্য এটা একটা লাস্ট চান্স বললেও বেশি বলা হবে না। এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য।
৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মৌলবাদের একটা ঝুঁকি সব সময়ই থাকবে। এই ঝুঁকি কমিয়ে রাখাই আমাদের নিয়তি। মৌলবাদের ঝুঁকিকে মাথায় নেয়াই আমার মতে সঠিক হবে যাতে আমাদের অমনোযোগিতার সুযোগ গোকূলে না তারা বেড়ে উঠে। অসতর্ক হওয়ার কিন্তু কোনই চান্স নেই!
বিষয়: বিবিধ
২২৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন