বাংলাদেশের ইন্টারনেটে নিম্ন মানের সেবা: পর্ব এক
লিখেছেন লিখেছেন চোথাবাজ ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১০:৩৬:৩০ রাত
নামকাওয়াস্তে চলছে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা। বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নানান চটকদার প্যাকেজের মাধ্যমে জনগণকে ইন্টারনেট ব্যবহারে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে ইন্টারনেট প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে না নিম্ন মানের সেবার কারণে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তো বটেই, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। অথচ আমরা সে তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইন্টারনেট এখন মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি হয়ে উঠেছে প্রতিনিয়ত। তা আমরা মানি না মানি, আমাদের কাজকর্মে আমরা সেটাকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছি। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কেবল ইন্টারনেট থাকাটা দরকার নয়, দরকার ‘উচ্চগতি’ বা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট।
আপাতদৃষ্টিতে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালার অভাব, বিভিন্ন লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গাইড লাইন মেনে না চলার প্রবণতার কারণে উন্নত মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট সার্ভিসের কারণে সেটি প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। যার ফলে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সুযোগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা বা সেবার পরিধি বাড়ছে দ্রুতগতিতে। ইন্টারনেটভিত্তিক নতুন ব্যবসায়িক ও সেবার ধারণা যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিনই। বিশ্বব্যাপী নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষক সংস্থা ব্যবসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের তথ্য মতে, ২০১৪ সালের মধ্যে মোবাইল ফোন নির্ভর অ্যাপলিকেশন তৈরির বাজারের আর্থিক মূল্য হবে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
এ সময়ের মধ্যে অ্যাপলিকেশন ডাউনলোড হবে প্রায় ২১ বিলিয়ন। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন অনলাইন আউটসোর্সিং নির্ভর ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্সিংয়ের বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। গার্টনারের তথ্যমতে, আইটি আউটসোর্সিং এবং বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের বাজার গত এক দশকে যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই বাজার গিয়ে দাঁড়াবে বর্তমান বাজারের দ্বিগুণে।
এদিকে স্মার্টফোন ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে সমান তালে বেড়ে চলেছে এর নানান অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার। প্রযুক্তি বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ওভাম-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের মোট পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন।
আর চলতি বছরের বাজার বিশ্লেষণ করে তাদের অনুমান, এ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ বিলিয়নে। আর মোবাইল অ্যাপিকেশন ডাউনলোডের এই বৃদ্ধি চলবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ওভাম-এর প্রতিবেদনে ২০১৬ সালে এই অঞ্চলে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হয়।
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই বাজার বেড়ে পরিণত হবে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। দেশের প্রযুক্তি বিশারদদের মত, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তথা শক্তিশালী ইন্টারনেট অবকাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বাজারের নিজেদের অবস্থান গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
স্বল্পমূল্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা না থাকলে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই অপার সুযোগ। ইন্টারনেট ব্যয় কম এবং ইন্টারনেটের গতি সন্তোষজনক অবস্থায় থাকলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেশের তরুণ সমাজ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করার পরও ইন্টারনেট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালে এখনও আসেনি। এমনকি শহরাঞ্চলে উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সেবার প্রসারও ঘটেনি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেশকৃত ‘ডিজিটাল
বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা
একটি হালচিত্র’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে রপ্তানি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সরকার আশা করছে, উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে ২০২০ সাল নাগাদ এ ক্ষেত্রে ৪ লাখ নতুন ব্যবসা এবং ১ লাখ ২৯ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তখন শুধু এ খাত থেকেই বাংলাদেশের জিডিপি অতিরিক্ত ২ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
২০২১ সালের মধ্যে শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি অতিরিক্ত ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ বাড়বে। অর্থমন্ত্রী তাই তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত করতে সরকার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক দেয়া এই প্রতিবেদনে ইকোনোমিজ অব স্কেলের কারণে দ্রুত শিল্প প্রবৃদ্ধি অর্জনে আইসিটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে উলেখ করা বলা হয়, ইন্টারনেট খাত থেকে ২ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিডেনসিটি খাত থেকে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ব্রডব্যান্ড খাত থেকে ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ অতিরিক্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে ২০২১ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকেই অতিরিক্ত ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)’র তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহাকারীর সংখ্যা ৪ কোটির অধিক। এর মধ্যে ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের গ্রাহক সংখ্যা ৫ লাখের কাছাকাছি এবং ব্রডব্যান্ড অপারেটরদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বাকিরা মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
কিন্তু বাস্তবে এ্যাক্টিভ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটির বেশি নয়। সুতরাং একথা সহজেই বলা যায়, ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে আমরা এখনও কতটা পিছিয়ে। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশনের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শেষের দিকে।
এই ফাউন্ডেশন ৬১টি দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং সমাজ ও রাজনীতিতে এর প্রভাব বিবেচনায় জরিপটি চালায়। ইন্টারনেটে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক টিম বার্নাস লি একটি নতুন সূচক বের করছেন, যার মাধ্যমে দেশের এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা বের করা যায়। এর মাধ্যমে একটি দেশের ডিজিটাল হওয়ার প্রক্রিয়ার স্থান নির্ণয় করা যায়।
তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ পড়ে রয়েছে অনেক পেছনে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে নেপালের মতো দেশও আমাদের ছাড়িয়ে গেছে (৫২তম স্থানে)। অনেক এগিয়ে গেছে পাকিস্তান (৪৪), তার থেকেও অনেক এগিয়ে গেছে ভারত (৩৩)।
ইন্টারনেট ব্যবহার এবং সমাজ-রাজনীতিতে এর প্রভাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৬১টি দেশের মধ্যে ৫৫তম। আর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমরাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগ ও পরিকাঠামোও রাখা হয়েছে এ সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২০ শতাংশের বেশি পরিবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারের আওতায় থাকলেও বাংলাদেশে এ সংখ্যা মাত্র তিন শতাংশের কিছুটা বেশি।
দৈনিক ইনকিলাব
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন