সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি
লিখেছেন লিখেছেন রোকাইয়া ০৮ মে, ২০১৪, ০১:৫০:৩৬ রাত
আব্বু বলেন পড়রে সোনা,
আম্মু বলেন মন দে...
পাঠে আমার মন বসেনা
কাঠাল চাঁপার গন্ধে...
মেয়েকে ঘুম দিচ্ছিলাম। হঠাৎ মন গানের সাথে হারিয়ে গেল অনেক দূরে। তপ্ত দুপুর বেলায়, জানালার ওপাশের পুকুরের পানি যখন স্থির, দরজা জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সব বাড়িতে যখন মা বাবা সন্তানেরা টিভির সামনে মগ্ন, আমাদের পলেস্তারা ধ্বসা সাদা চুনকামের ছোট্ট ঘরে তখন উচ্চস্বরে বাজত এই গানগুলি। আরো কতো গান! "মাগো আমায় দাও পরিয়ে যুদ্ধে যাবার সাজ, বন্ধুরা যে চেয়ে আছে আমার পানে আজ", "আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর, আমি বলি খোদার পথেই হোক এ জীবন পার.."এমন আরো কত। "সত্য কথা বলতে হবে, সত্য পথে চলতে হবে, মিথ্যা পায়ে দলতে হবে, কে বলেছে কে?? আল্লাহ রাসুলে, আল্লাহ রাসুলে" এখন ও বুকে কাঁপন তোলে। এখন ও সত্য পথে চলতে বুকে শক্তি জোটায়। অথবা, "আমার দেশের ঠিকানা বন্ধু পাবে, ধীরে ধীরে বয়ে যাওয়া নদীর গানে" সেদিন হৃদয়ে যেই প্রেম বুনেছিল, বাংলাদেশের প্রেম, একই প্রেমের ঢেউ তোলে আজো!
যদিও অনেক ব্যস্ত সময় কাটছে এখন, বুকের ভেতরের ছলাত ছলাত ঢেউ গুলিকে সামলাতে না পেরে বসেই পড়লাম লিখতে। যখন স্মৃতি গুলো ঢেউ তোলে, জীবনের ছবি গুলো চলচ্চিত্রের মতো যেন দ্রুত ভেসে যায় মনের আকাশে। ইচ্ছে হয় কিছু ছবি আটকাই, ধরে রাখি। জীবনের ব্যস্ততা খুব কমই দেয় সে সুযোগ। যাই হোক, যা বলছিলাম। সেই টিপু সুলতান, টারজান অথবা আরো হরেক রকমের নাটক সিনেমার সময়ে আমাদের ঘরে কোন টিভি ছিল না। বিনোদনের তাতে কোন কমতি হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। আরো আগে, যখন গ্রামের একটা মাত্র মাটির ঘরে ছিল আমাদের ঠিকানা, শয্যাশায়ী মাকে আর একদম পিঠাপিঠি দুই ভাই বোনকে নিজ হাতে রান্না করে, গোসল করিয়ে খাইয়ে, নিজ হাতে স্ত্রী সন্তানের কাপড় ধুয়ে আঙ্গিনার তারে শুকাতে দিয়ে যখন আব্বা ৯ মাইল দুরের মাদ্রাসায় যেত বাই সাইকেলে তখন ও আমাদের সুখ কিংবা বিনোদনের কোন অভাব ছিল না। আম্মার রুগ্ন শরীরে রান্না করা ডালের বড়া আর গরম ভাত যখন শুধু ছিল দিনের মেনু, তখন ও কখন ও ভাবিনি আমাদের কোন সুখের অভাব আছে। আব্বা তখন দ্বীনের পথে নতুন। একার উপরে তিনটা ইউনিয়নে দ্বীনের দাওয়াত পৌছানোর দায়িত্ব। ৯ মাইল দুরের চাকুরী সেরে, দাওয়াতী কাজের শেষে যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ক্ষীন দেহের আব্বা বাড়িতে ফিরত, যেন সজীব হয়ে উঠত নতুন করে। বসত গানের আসর। বাদ পড়ত না আম্মাও। আব্বার মতে আম্মাই ছিল জগতের সেরা কন্ঠের অধিকারীনি। ভাই এর গান এখন ও হৃদয় দোলায়, দুনিয়া ভোলায়। আমার গলা দিয়ে সুর বেরুতো না কিছুতেই। ওরা সবাই পারে, আমি পারিনা। এই সংকোচে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকত। আব্বা এমন ভাবে সাহস যোগাতো, চি চি শব্দে হলেও গাইতাম। "দাও খোদা দাও হেথায় পূর্ন ইসলামী সমাজ, রাশেদার যুগ দাও ফিরিয়ে দাও কুরয়ানের রাজ" রাশেদা আমার জেঠাতো বোনের নাম। আমার মাথায় কিছুতেই ঠুকত না, কেন আব্বু রাশেদা আপার যুগ চায় আল্লাহ পাকের কাছে! তখন ও আমাদের কোন ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না। আব্বা থানা শহরে গেলে যেই সব চাচাদের বাসায় এইসব গান বাজত, তাদের বাসায় সেগুলো শিখে পুরো গান লিখে নিয়ে আসত আমাদের জন্য। সন্ধ্যায় বসত শিখে আসা সেই গান আমাদের শেখাতে। বলা দরকার, দ্বীন বোঝার আগে আব্বা ছিল টিয়েটার কর্মী, প্রচন্ড দরিদ্রতায় ও ছিল তার নিজের হারমোনিয়াম। যখন আমাদের গান শেখাত, দ্বীনের প্রেমে হারমোনিয়াম তখন আস্তাকুড়ে। কন্ঠের তালেই সেখাতো আব্বা গান। তার সেই উদ্দীপনা, সেই সুর তাল, সেই জ্যোতিময় চোখের প্রানবন্ত পলক এখন ও বুকে ঝড় তোলে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার উদ্দমী কন্ঠ শুধু প্রেরনাই ছড়িয়েছে। মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে ছেলেকে নিজের জানাজার জন্য প্রস্তুত করার অপরাজেয় দৃঢ় মানসিকতা তার মধ্যে দেখেছি, মাত্র ছয় মাস বয়সে মা-হারা হয়ে যে কিনা বড় হয়েছিল ক্ষুধা, দারিদ্র আর অবজ্ঞার সাগর সাতরে!
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
২৩০৩ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গান বাজনা কি উনি ছেড়ে দিছেন?
হৃদয়গ্রাহী কথাগুলো পড়ে সত্যিই আমার বাবার কথাও মনে পড়ে গেলো সাথে নিজের অতীতও। আপনার মতো বর্ণনা করতে জানলে লিখেই ফেলতাম। বাকীটা পড়ার জন্য ওত পেতে রইলাম।
দারুন লিখেছেন। এই অংশ পড়ে মজা পাইছি। মূল বক্তব্য বুঝতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন