=== ইলিশ ===
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ শাহ ই জাহান ০২ নভেম্বর, ২০১৮, ০৯:০১:০৩ রাত
যুব দিবসের প্রস্তুতির কাজ৷ শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্বাধীনতা দিতে গিয়ে যে টুকু সময় অপচয় হচ্ছিল সেটাই কাজের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ তাই সিন্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করা জরুরী৷ অন্যথায় কাজ শেষ করা যাবেনা এবং কেলেঙ্কারী এড়ানো সম্ভব হবেনা৷
ইউএনও স্যার ফোন দিলেন, অাধা ঘন্টা পর দুই ঘন্টার জন্য যেন শিল্পকলা একাডেমিতে অাসি৷ অর্থাৎ তিন ঘন্টা নেই৷ অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর৷ অাল্লাহ ভরসা৷
শিল্পকলায় দুই ঘন্টা কি করতে হবে? গাইতে পারিনা; কারও অজানা নয়৷ শুনতে বিশেষ অাগ্রহ অাছে, সেটা অামার জানের দুশমন প্রাণের বৈরী চোখের বালি সমবায় অফিসারও বলবেন না৷ যেখানে স্বয়ং কবিগুরু সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ সেখানে শিল্পকলার পিচ্চিরা কি শুনাবে! তাহলে কি বিচার অাচার করতে হবে? ইঞ্জিনিয়ারের প্লানে রিক্সাওয়ালার ভুল ধরা যেমন হাস্যকর৷ কিন্তু এ কাজটিও এক সময় করতে হতো৷ যেই দেশে রাতা ক্বুরা নেই সেই দেশে ক্বুঁরিও বাক দে৷ কিন্ত এখানে পর্যাপ্ত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ অাছেন৷ তাহলে অামার কাজটা কি?
অত ভাবনা চিন্তার সময় নেই৷ শিল্পকলায় যুব দিবসের কাজই করব৷ মুল কাজ ইউএনও স্যারের সাথে৷ ভালই হলো৷ শুধু কাজের গতিধারা পরিবর্তন করা ৷
নাচ গো সুন্দরী কমলা গানের সাথে তিন শিশুর নৃত্যের শেষাংশ দেখলাম৷ ভীষণ সাবলিল৷ পুরোটা দেখলে ভাল লাগত বলে ধারণা ৷
শ্রেষ্ঠ রেঞ্জার গাইডার হিসেবে শর্ব্বরী ম্যাডাম জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন; তাঁরই সংবর্ধনা৷ অরুন স্যার অামাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বিশেষণের অতিশায়ন করলেন৷ অামি নাকি কেমন কেমন! সৌন্দর্যে শাহরুখ খান অামার কাছে ফেল কিনা! হায়! বলদ গরু যদি দুধ দিত৷ কম সময়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো৷ ইউএনও স্যারের ফটোগ্রাফার ইসমাইল খবর দিলেন, পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করি৷
সম্প্রতি শার্লক হোমসক নিয়ে নাড়াচাড়া করছি৷ কিন্তু অনুসন্ধান মেলাতে পারছি না৷ অপেক্ষার কারণটা কি হতে পারে?
দো তলার রেলিংএ দাঁড়িয়ে অাছি৷ অচমকা এক মিশ্র ঘ্রাণ নাকে এমনভাবে ধাক্কা দিল যেন প্রথম প্রেমের পরশ পেলাম৷ হায়! প্রেমে নেশা, প্রেমের স্মরণেও নেশা৷ কৌতুহলী হলাম৷ নাশারন্দ্রের ডান বাম করে সুবাস অালাদা করতে চেষ্টা করছি৷ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো৷ কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছেনা৷ কারণ, প্রজনন মৌসুমের এই নিষিদ্ধ সময়ে প্রশাসনের অধিক্ষেত্রে ইলিশের ঘ্রাণ পাচ্ছি কেন! কার এমন দুঃসাহস? হতে পারে, অামার অবচেতন মনের কল্পনা৷
একবার সন্ধ্যায় বর্ষাকালে কাপাসগোলা স্ট্রিটের ট্যুইশনি থেকে ফেরার পথে খেজুর রসের ঘ্রাণ পেয়ে উৎসের খোঁজে ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে বিপদে পড়ছিলাম৷ লোকজন চোর ঠাউরেছিল৷ জীবনের সেরা সময়টা নানার বাড়িতে ছিলাম৷ শীতকাল এবং তার অাগে পরে তিন মাস রস খেয়ে কাটিয়েছি৷ নানাদের প্রচুর খেজুর গাছ৷ দশ বছর বয়স থেকে কলেজ পাশ পর্যন্ত নিজেই গাছির কাজ করেছি৷ কাপাসগোটা স্ট্রিটের সেই ঘ্রাণ পেয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েছিলাম৷ চোখের জল অাটকানো যায়নি৷ শহরে অাসার পর দীর্ঘ সময় খেজুর রস খেতে পারিনি৷ রসের সে সুবাস অামাকে ছেলে বেলায় নিয়ে গেল৷ বর্ষকাল বলেই নিশ্চিত হয়েছিলাম সেটা খেজুর রস ছিল না৷
যখন বাজারে যাই, পরনে সাহেবি পোশাক দেখে মাছ বিক্রেতাগণ বিশেষ অাগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ তাঁরা দামী মাছগুলোর দিকে অামার দৃষ্টি অাকর্ষণের চেষ্টা করেন৷ অামিও ভাব নিয়ে তাঁদের কৌতুহল নিবৃত্তির চেষ্টা করি৷ লইট্যা মাছের দামে ইলিশের দর দাম করি৷ ভীষণ বিরক্ত হন৷ অামার দাম হাকা শুনে তারা অাকাশ থেকে পড়েন৷ কেউ কেউ পাহাড় থেকে নামছি কিনা সন্দেহ করেন৷ অাবার অনেকে মন্তব্য করেন, সাহেব উপরে ফিটফাট হলে কি হবে ভিতরে........ইত্যাদি৷ অর্থাৎ লজ্জা দিতে চেষ্টা করেন৷ লজ্জা দেবে না কেন? মারে না সেটাইতো অামার ভাগ্য৷
এই সেদিন সকালে মুন্সি ঘাটায় বড় বড় মলা মাছ বিক্রি হতে দেখা গেল ৷ সম্ভবত কাপ্তাই লেকের৷ ভীষণ লোভ হলো৷ কাঁচা খেতে মন চাইল৷ জনা বিশেক লোক ঘিরে ধরেছে৷ কিন্তু দাম অকল্পনীয়৷ পাঁচশ টাকা কেজি৷ লোক বাড়ছে৷ কিন্তু বিক্রেতা কারও দিকে তাকাচ্ছেন না৷ দাম এর চেয়ে বেশি হলেও কেনার লোক অাছে৷ কিন্তু শুরুটা কে করবে? কেউ শুরু করলে এই মাছ তিন মিনিটের বেশি থাকবে না৷ মনে মনে হিসাব করছি, অাড়াইশ গ্রাম কিনলে কয় বেলা চালান যায় অার অামানিয়া হোটেলের সবজি দিয়ে খেলে কত খরচ পড়বে৷ মোবাইলের ক্যালকুলেটরে তারই অংক কষছি৷ হিসাবের ধারে কাছেও যেতে পারছি না৷ এদিকে লোভও সামলাতে পারছি না৷ যাবতীয় হিসেব নিকেশ বাদ দিয়ে দাঁত মুখ খিচিয়ে ধুম করে অাড়াইশ গ্রাম কিনে ফেললাম৷ সাথে সাথে পাশের এক লোক মন্তব্য করলেন, যাদের ঘুষের টাকা অাছে তারাই এই মাছ খেতে পারবে৷ অামি প্রায় পালিয়ে অাসছিলাম৷ অারও কিছু শুনতে হয় কিনা! লোকটি ভুল বলেন নি৷ জানেন, অামি সরকারী চাকরি করি৷
বেহেস্তের খাবারের মেনুতে ইলিশের নাম নেই বলে সৈয়দ মুজতবা অালীর সেখানে যেতে বিশেষ অাগ্রহ নেই৷ কোন বাঙ্গালীর চেয়ে ইলিশ অামার বেশি প্রিয় সে দাবী করছি না৷ অামার মা'র সাথে এই একটা জায়গায় তীব্র বিরোধ লেগে অাছে৷ ইলিশের প্রতি মা'র অাগ্রহ গড়পরতা৷ তখন মা'কে মনে হয় চেতনা বিরোধী৷ বাঙ্গালী চেতনা তিনি ধারণ করেন কিনা?
জানা গেল, শিল্পকলা একাডেমিতে নৈশ ভোজের ব্যবস্থা অাছে৷ এ কারণেই ইউএনও স্যারের অপেক্ষার নির্দেশ৷ স্যারের কোন এক ভক্তের সন্তানের অন্ন প্রাশন উপলক্ষে এ অায়োজন৷ তখন ইলিশের ঘ্রাণ পাওয়ার বায়বীয় যোগাযোগ স্পষ্ট হলো৷ অাশংকার বিষয় হলো, নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশের অাগমনে ভক্তের উপর মোবাইল কোর্ট করলে মহা কেলেংকারী ঘটে যাবে৷ প্রায় দেখা যায়, বরযাত্রীর ভোজের মাঝখানে বর-কনে গ্রেফতার; কারণ বাল্য বিবাহ৷
পাতে ইলিশ অাসল৷ শর্ব্বরী ম্যাডাম তার উপর মাংস দিতে যাচ্ছিলেন৷ বিরক্ত হলাম৷ অন্য কোথাও এবং অন্য কেউ হলে কড়া ধমক দিতাম৷ কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব নয়৷ ইলিশ বন্দনা শুরু করলাম৷ এবং সেই সাথে ইএনও স্যারকে যাচিয়ে দেখতে বাসনা হলো৷ স্যার, এই সময় কিন্তু.....৷
স্যার বুঝলেন এবং গলা খাকারি দিলেন৷ অন্যরা বুঝলেন গলায় কাটা অাটকাল কিনা! অামি বুঝলাম এ ব্যাপারে চুপ থাকতে হবে৷
স্যার প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করলেন, "এই, কে অাছ? যুব কে অার এক টুকরা ইলিশ দাও৷ শুনেন, বাসায় শুধু অাপনার জন্যই ইলিশের অয়োজন করব৷ দেখি, ইলিশে অাপনার শখ মিটিয়ে দেয়া যায় কিনা!"
রসগোল্লার মাজেজা বুঝাতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা অালী গেয়েছিলেন-
"রসের গোলক! এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়!
ইতালীর দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়৷"
অামারও গাইতে ইচ্ছে করে-
"ইলিশ, ইলিশ! এত স্বাদ কেন তুমি ধরেছিলে হায়!
বাঙ্গালীর দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়!"
বেঁচে থাকুন ইউএনও স্যার৷ বেঁচে থাকুক ইলিশ৷
==========
বিষয়: বিবিধ
৫৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন