বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, দেশের উন্নয়ন এবং একজন সাধারণ নাগরিকের অপরিপক্ক, উচ্চ বিলাসী ও বিচ্ছিন্ন ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ শাহ ই জাহান ১২ অক্টোবর, ২০১৮, ১০:১০:৫৩ রাত
গত ঈদ উল আযহার পরদিন অামার দুই মামাত ভাই আমাদের বাড়ি এসেছিল। তাদের একজন রোকন বয়স তেইশ চব্বিশ এবং রোকনের চাচাত ভাই শাহেদ বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। শাহেদ আমার খুব প্রিয়। আমি নানার বাড়িতে বেড়ে ওঠেছি। শাহেদের সাথে আমার গাঢ় স্মৃতি রয়েছে। মাঝখানে কিছুদিন যোগাযোগ ছিলনা। তবে দুর থেকে খবরটা রাখতাম। সে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করে ঢাকার কোন এক বায়িং হাউজে ভাল বেতনে চাকরি করে এ রকমটি শুনেছি। বায়িং হাউজে কাজের ধরণটা আমি জানিনা। অনেকদিন পর শাহেদকে দেখে স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েছি। কিন্তু প্রকাশ করিনি।
রোকন প্রবাসী। সে বিয়ে করেছে। তার পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয় কেউ এত তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু সে বিয়ে করবেই। তার টাকা আছে। প্রবাসে টাকা রোজগার করেছে। বউ বাচ্চার ভরণ পোষণের জন্য তার ভাবনা নেই। আমি শাহেদকে বিয়ের ফজিলত বর্ণনা করছি, এতে দেরি করা বোকামী। মা’কে অনুরোধ করলাম, শাহেদের বিয়ের উদ্যোগ নিতে। মামা অসুস্থ। বসে থাকলে সে বিপদে পড়বে। মা আমার কথায় সায় দিলেন। শাহেদ বিনয়ী ছেলে। সে শুনে যাচ্ছে আর লজ্জায় মুখ ঢাকছে। এর মধ্যে খালাত বোনের জামাই হারুন ঘরে ঢুকল। তাকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বললে সে লাফ দিয়ে বলা শুরু করল, নয় হাজার টাকা বেতন পায়, বাড়ি থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজর টাকা পাঠাতে হয়। সে কি নিজে চলবে নাকি বউ চালাবে! পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন হলে পরে বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করা যায়। শাহেদও এ কথায় সম্মতি দিল। এর কম বেতনে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে বউ নিয়ে থাকা যাবেনা। মা তখন বলে ওঠলেন, এত কম বয়সে বিয়ের এত তাড়া কেন! মনে মনে ভাবলাম, শাহেদের বিয়ের উপযুক্ত বয়স কত! আরও শুনলাম, ঈদে-চাঁদে শাহেদ বাড়ি আসেনা। এমনকি শাহেদের বড় ভাই পুলিশ অফিসার আসিফের বিয়েতেও সে আসেনি। এ জন্যে শাহেদের মা-বাবা সহ অনেকের মন খুব খারাপ ছিল। সে চাকরি নিয়ে ভীষণ হীনমন্যতায় ভুগছে। লোক চক্ষুর আড়ালে থাকতে চেষ্টা করে। পরিচিতদের এড়িয়ে চলে। শাহেদের এ অবস্থা ঠিক আমার উপর দিয়েও গিয়েছে। তার উপর আমার পিছুটান ছিল বেশি। সে আমার চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে। আমি তাকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। সে কোন মন্তব্য করেনি। বুঝতে পেরেছি আমার পরামর্শ তার মনঃপুত হয়নি। আমাকেও শুভাকাঙ্খীরা পরামর্শ দিতেন। এড়িয়ে চলতাম। কারণ বয়সটা স্বপ্নে দেখে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তখন আর সুযোগ থাকেনা। আমি বলছিনা শাহেদ ব্যর্থ হয়েছে। এ লাইনেও ক্যারিয়ার গঠন করা যায়। শুনেছি সে সরকারী চাকরির চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রস্তুতি নেয়ার সময়টা তার নেই। চাকরি হতেও পারে; সে খারাপ ছাত্র নয় । কিন্তু অনিশ্চিতি। আমার প্রশ্ন, একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের সন্তানেরা অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করবে কেন?
যারা সামাজিক অবস্থায় যথেষ্ট কর্মক্ষম হওয়ার বিপরীতে কাজ পায়না তাদের বেকার বলা হয় কিংবা কাজ করার যোগ্যতা বা ইচ্ছা থাকা সত্বেও কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ না থাকার নাম বেকারত্ব। আমি একটি চাকরি করি। যে বিষয়ে পড়ালেখা করেছি তার সাথে আমার কাজের দুরতম সম্পর্কও নেই। দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ সরকারী-বেসরকারী চাকরির সাথে পড়ালেখার বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়। পদার্থ বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ে পড়ালেখা করে ব্যাংকে চাকরি করেন। বিজ্ঞানের কোন সূত্রটি এখানে প্রয়োগ করা হয় জানিনা। অন্য বিষয়ে পড়ুয়ারাও ব্যাংকার হন। তাহলে ব্যাংকিং বিষয়টার দরকার কোথায়! খোঁজ নিলে দেখা যাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ালেখা করে সম্পর্কিত কাজটি অন্যরা করছেন এমন উদাহরণ অগণিত। এতে কি হচ্ছে? বিষয় সংশ্লিষ্ট লোকজন বঞ্চিত হচ্ছেন এবং সেবার গুণগত মান রক্ষা করা যাচ্ছে না। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সুচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিংবা যে মাত্রায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল সেটি হচ্ছে না।
ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো কোথায় দরকার? কেন দরকার? মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকতা আর উচ্চতর গবেষণার জন্য। উচ্চ শিক্ষায় বিষয়গুলোর আদৌ দরকার আছে কিনা ভেবে দেখা সময়ের দাবী। জরিপ করে দেখা দরকার, প্রতি বছর কতজন ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষক আমাদের লাগবে। শুধুমাত্র সে কয়জনকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বাকী আসনগুলো বিলুপ্ত করা উচিত। প্রাইমারী শিক্ষায় স্নাতকোত্তর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিসিএস উর্ত্তীর্ণরাও নিয়োগ পাচ্ছেন। প্রাইমারীর কারিকুলাম সম্পর্কে যতটুকু জানি, এখানে উচ্চ শিক্ষিত লোকের বিশেষ প্রয়োজন নেই এবং উচ্চ শিক্ষা প্রয়োগেরও ক্ষেত্র নেই। যেটা দরকার তা হলো শিশুদেরর মানসিক অবস্থা বুঝার সক্ষমতা এবং সহজে বোধগম্য উপায়ে উপস্থান দক্ষতা। এজন্যে দরকার বিদ্যমান বিশেষ ট্রেনিং আরও আধুনিকায়ন এবং হালনাগাদ করা। আমরা এই মুহুর্তে চাইলেই আমেরিকার মানে যেতে পারব না। মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশগুলো অনুসরণ করতে পারি।
এক সময় মেধাবীরা বাংলা, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে পড়ালেখা করতেন। গবেষণা করতেন। তাঁরা আমাদের কাছে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। বর্তমানে চাহিদা সম্পন্ন বিষয়ে সুযোগ পায়না বলে বিষয়গুলোতে ভর্তি হন। যার ফলে বর্তমানে কোন পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক আমাদের নেই। হয়তো আছে, কিন্তু উল্লেখ করার মতো কি? একবার এক প্রশিক্ষণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষক আমাদের পড়াচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, গবেষণা কর্মের জন্য তিনি মাসে সাকুল্যে ছয়শত টাকা পান। জাপান তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে প্রতিনিয়ত ঋণ স্বীকার করে। জাপান আজকের এ অবস্থার সুফল হলো তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণাকর্ম।
আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সমাজের সকলেই পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে চাকরি করাকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এ ব্যাপারে আমরা ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ। এর বিকল্প প্রবণতা কোন কালে ছিল কিনা জানা যায়না। এর মধ্যেও কোন কোন শিক্ষার্থী-অভিভাবক চাকরি বিমুখ আছেন। তাঁদের সাধুবাদ জানাই। তাঁরা স্বাধীন পেশায় নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন। কিন্তু সংখ্যাটা একেবারে নগন্য। এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনার দরকার। চাকরি যেন পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য না হয়ে বিকল্প ভাবনার বিষয় হয়।
কয়েকদিন আগে বন্ধুবর এডভোকেট শফিউল আজম সাহেব এর একটি facebook স্ট্যাটাস দেখেছি। তাঁর ঢালাও কথায় আমি একমত নই; আবার দ্বিমত করার সুযোগও কম। তাঁর মতে, বেকার বানানোর কারখানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে বেকার সমস্যা সমাধানে চীনের মতো উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি লিখেছেন, ‘বিপ্লবের পর চীন তার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রায় বার বছর তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। চীন সরকারের বক্তব্য ছিল, এত ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে কি করবে? কোথায় চাকরি পাবে? কেইবা চাকরি দেবে? এত বেকারকে চাকরি দেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান চীনে নেই। ঐ সময়টাতে চীন ছাত্র-ছাত্রীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বিভিন্ন ধরণের ট্রেড কোর্সে। স্বল্প মেয়াদী ট্রেড কোর্স সম্পন্ন করে চীনের ছেলে-মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেল। প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ওঠল এক একটি ছোট ছোট কারখানা। পরিবারের সকলেই সেখানে কাজ করেন। বড় কারখানা করার আলাদা খরচ নেই। ফলে পন্যের উৎপাদন খরচ কমে গেল।………অপরদিকে বাংলাদেশে গড়ে ওঠছে বেকার বানানোর কারখানা বিশ্ববিদ্যালয়।…..কোম্পানীরাও এটা বুঝে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেওয়া শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ বেতন পাননা। মালিকদের নানাবিধ অপেশাদার আচরণের সম্মুখীন হন।’ আমার মামাত ভাই শাহেদের অবস্থা হয়েছে এরকমই।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি উক্তি প্রাসঙ্গিক হতে পারে, ‘........বেঙ্গলের এন্টায়ার এডুকেশন সিসটেমটাই টপ হেভি। এইখানে সাপোর্টিং কোন কলেজ তৈয়ার করনের আগে এইটিন ফিফটি এইটে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি তৈয়ার অইছে। একই রকম সাপোর্টিং স্কুল ছাড়া কলেজগুলো তৈয়ার অইছে। অখন গ্রামে-গঞ্জে যেখানে যাইবেন দেখবেন কলেজ অইতাছে। এইগুলা কোন কামে আইব না। আমাগো দরকার শক্তিশালী মিডল স্কুল। শিক্ষার আসল জায়গাটাতেই নজর পড়ছে না কারো। বাঙালিদের যেরকম ডিগ্রীর ক্রেজ, এইডা নতুন কোন কিছু নয়। কলেজ তৈরি করার আগে ইউনিভার্সিটি তৈরি করার কারণে এই ক্রেজ জন্মাইছে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাইরে ইন্ডিয়ার অন্য কোন অঞ্চলে ক্রেজ পাইবেন না (যদ্যপি আমার গুরু, লেখক-আহমদ ছফা)।’ প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক সাহেব কথাগুলো বলেছিলেন সত্তরের দশকে।
সাম্প্রতিক সময়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নামক শব্দেরগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি। আমার সীমাবদ্ধতার কারণে দেরিতে শুনেছি হয়তো। শুনার কথা ছিল নব্বই এর দশকের শুরুতে। আমাদের বোদ্ধা ও নীতি নির্ধারিত মহলে নিশ্চই এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে কিংবা হচ্ছে। Demographic Dividend (জনসংখ্যার বোনাসকাল/জনসংখ্যার উপহার/জনসংখ্যার লভ্যাংশ) মুলত নির্ভরশীল জনসংখ্যার (০ বছর থেকে ১৪ বছর এবং ৬৫ বছর প্লাস) চেয়ে কর্মক্ষম (১৫ বছর থেকে ৬৪ বছর) জনসংখ্যার আধিক্য। যারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। কোন দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা যখন ৬০ শতাংশে উন্নীত হয় তখন সে দেশকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট এর সুবিধা গ্রহণকারী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে আমাদের এ সংখ্যা ৬৭ শতাংশ বা ১০ কোটি ৭২ লক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে এ সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লক্ষ এবং ২০৫০ সাল এ সংখ্যা ১৩ কোট ৬০ লক্ষে উন্নীত হবে। তারপর এ সংখ্যা কমতে থাকবে অর্থাৎ বুড়োদের সংখ্যা বাড়বে। আমরা ২০০৭ সালে (কেউ কেউ বলছেন ২০১২ বা ২০১৪ সালে) এ জনসংখ্যা তাত্বিক বোনাসকালে প্রবেশ করেছি। এটি সচরাচর ৫০/৬০ বছর পর পর আসে কিন্তু আমাদের আসতে সময় লেগেছে প্রায় দেড়শ বছর। জাপান শাস্ত্রীয়ভাবে ১৯৮০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যার বোনাসকালে প্রবেশ করলেও তারা এর আধিক্য টের পেয়েছিল চল্লিশ এর দশকে। তখন থেকে তারা এর সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত তাদের এ বোনাসকাল বিদ্যমান ছিল। আজকের জাপান তার প্রমাণ। আমেরিকাও জাপানের কাছাকাছি সময়ে এ সুবিধাটি গ্রহণ করেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এই দেশগুলোকে এশিয়ান টাইগার বলা হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তারা জনসংখ্যার বোনাসকালের সুবিধা ভালভাবে গ্রহণ করেছে। ভারত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের অর্থনীতি সমীহ করার মতো। চীনকেতো চিনতে আমাদের বাকী নেই। তাদের ব্যাপারে বলা হয়-ইউরোপ-আমেরিকানরা যখন কোন ব্রিজ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা নদীর দুই পাড় থেকে শুরু করে মাঝখানে এমনভাবে মিলে যায় যে চুল পরিমাণও এদিক সেদিক হয়না। আর চীনারা যখন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে কোন টানেল বানানোর কাজ শুরু করে তখন দুই দলের কারও সাথে মাঝখানে দেখা নেই। দুই দল পাহাড়ের দুই প্রান্ত দিয়ে বের হয়। তারপর তাজ্জব বনে যায়; সম্বিত ফিরে তারা খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে, ‘টানেল চেয়েছিলাম একটা, পেয়ে গেলাম দুইটা।’ এই চীন ডমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করেছিল ২০০০ সালে। কিন্তু তারা এর সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিল ১৯৭৮ সালে। নাইজেরিয়া ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এর সুবিধা কাজে লাগাতে পারেনি।
আমরা ইতিপূর্বে Sustainable Development Goals (SDG), Millenium Development Goals (MDG), পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে শুনে থাকলেও Demographic Dividend (DD) সম্পর্কে খুব একটা শুনিনি। তবে সবগুলোর মূল স্রোত একটিই; আর তা হলো দেশের সমৃদ্ধি। আপনি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাটা কিভাবে নেবেন তা নির্ভর করছে এ ব্যাপারে আপনার প্রস্তুতিটা কেমন তার উপর। ধরে নিলাম, সীমিত সামর্থ্যে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে এবং সেটা কাজে লাগাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা লোকজন গ্রহণ করেছে। ইনোভেশন আইডিয়াকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি ধারণার চেয়ে বেশি। বিশেষ করে সরকারী বিভাগগুলো এ ব্যাপারে যুদ্ধ শুরু করেছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অনেক আগে থেকে চাহিদা সম্পন্ন ট্রেডে ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজ করছে নিরলসভাবে। এর সূফল আমরা পাচ্ছি। ক্রিকেটে আগামী দুই দশক সম্ভবত আমরাই রাজত্ব করব। আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষি বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী কারিগরী প্রতিষ্ঠান, ভাষা ইনিস্টিটিউট কাজ করছে। কিন্তু কর্মক্ষম জনসংখ্যার বোনাসকালকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট দিন তারিখ ঠিক করে চীন-জাপানের মতো বিশ বছর পূর্ব থেকে যু্দ্ধ ঘোষণার যে প্রস্তুতি থাকার কথা ছিল সেটি আমাদের ছিল কিনা জানিনা। যদি থেকে থাকে তাহলে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সঠিকভাবেই এগুচ্ছি। যতটুকু গ্যাপ রয়েছে সেটি সংশোধন করে নিলেই আমাদের পিছিয়ে থাকাটা ওভারকাম করা সম্ভব।
দেশে কর্মসংস্থান এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কিছুটা আলাদা। বিভিন্ন দেশের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কত সংখ্যক দক্ষ লোক বিদেশে পাঠাতে পারব তার একটি জরিপ করা জরুরী। দুতাবাসগুলো, সংশ্লিষ্ট এজেন্সি এবং প্রয়োজনে বিশেষ এজেন্সি এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে। দক্ষ জনবল প্রেরণের লক্ষ্যে লোক বাছাই করে তাদের দক্ষতাবৃদ্ধিমুলক প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে কাজ বেগবান করা যায়। একইভাবে দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে কারিগরী জ্ঞানে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়। সরকারী-বেসরকারী এজেন্সির সমন্বয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়ে এগুনো যেতে পারে। এতে অপচয় হবে, অনিয়ম হবে, দুর্নীতিও হতে পারে। কিন্তু যে কর্মক্ষম দক্ষ জনগোষ্ঠী বেরিয়ে আসবে তার সুদুরপ্রসারী ফল দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে।
প্রাইমারী থেতে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত কারিগরী বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পাঠ্যক্রমে অন্তভুক্ত করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার পরিধি সংকোচিত করে কারিগরী বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী প্রদানের কাজকে ত্বরান্বিত করা যায়। রুট লেভেল পর্যন্ত কারিগরী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের শুরুটা দেরিতে হলেও এক্ষেত্রে আমাদের অর্জন ভাল। ক্ষেত্রটিকে কিভাবে আরও ধারালো করা যায় তার চিন্তা ভাবনা করা দরকার।
দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির পূর্ব শর্ত নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। এটি সবাই জানে। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারের প্রচেষ্টা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদার তুলনায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে অাছি। বড় সমস্যা আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থা ভঙ্গুর। ঝড় ঝাপটার এই দেশে আরও টেকসই সঞ্চালন লাইনের চিন্তা করা দরকার। বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সিলিন্ডারের মাধ্যমে সহনীয় দামে গ্যাস সরবরাহের চিন্তা করা যায়। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। নতুন নতুন সিডিন্ডার কারখানা গড়ে ওঠবে। সিলিন্ডার আনা নেওয়ায় লোকজন কাজ পাবে। মানি সার্কুলেশন হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের আর একটি শর্ত। আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যথাযথ স্টিমেট করেন কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। ফলে কাজ শেষ করার কয়েকমাসের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বয় জরুরী। ভবিষ্যতে রাস্তাটি কতটুকু সম্প্রসারণ হতে পারে সেটি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের খুটি বসানো উচিত। গ্রামীণ সড়ক করার সময় প্রয়োজন সাপেক্ষে গার্ডওয়াল সহ রাস্তার ডিজাইন করা দরকার। অন্যথায় পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে ভেঙ্গে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকলে দুর করা প্রয়োজন। ব্রিজ-কালভার্ট করার পর দেখা যায়, উভয় পাশের সংযোগ সড়ক দেবে যায়। অত্যন্ত স্বাভাবিক। যদি ব্রিজ-কালভার্টের উভয় পাশে প্রয়োজনীয় দুরত্ব পর্যন্ত লোহার রড বের করে ঢালাই করা হয় তাহলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। আমি টেকনিক্যাল ব্যক্তি নই; সম্ভব কিনা জানিনা। প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন অত্র এলাকার সংসদ সদস্য এ.বি.এম. ফজলে করিম চৌধুরী এমপি (সংসদীয় আসন-২৮৩, চট্টগ্রাম-৬)।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আগামী কয়েকশ বছরও কৃষি প্রধান দেশই থাকবে। গবেষণা পর্যায়ে এক্ষেত্রে সাফল্য রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণটা আরও বেগবান করা দরকার। বেশির ভাগ কৃষক এখনও আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানের বাইরে। অনাবাদী জমিগুলো চাষের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। কৃষকের একটি প্রধান অভিযোগ, উৎপাদন খরচের সাথে ভারসাম্য রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে চিন্তা করা দরকার।
মৎস্য খাতে আমাদের সাফল্য আছে। বলা হচ্ছে, এ খাতে বিশ্বে আমরা চতুর্থ স্থানে রয়েছি। মাঠ পর্যায়ে উপজেলা মৎস্য বিভাগ কাজটি সম্প্রসারণ করে থাকে। একটি উপজেলার প্রতিটি কর্ণারে বিদ্যমান জনবল কাঠামো দিয়ে কার্যক্রম পৌঁছানো কঠিন। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর মৎস্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এ খাত দ্রুত সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ জরুরী।
প্রাণী সম্পদ বিভাগে পোল্ট্রি খাতে ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। এ খাত সম্প্রসারণে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যথেষ্ট ভুমিকা রয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অবদান। এ খাতে মুল সমস্যা হলো, বাচ্চা ও খাবারের দাম বেশি হওয়ায় খামারীরা সুবিধাটা নিতে পারছেন না। খুব সম্ভবত সিন্ডিকেট প্রবণতা এখানে বিদ্যমান রয়েছে। সহনীয় খাবারের দাম, সহজলভ্য মুরগির বাচ্চার ব্যবস্থা করা গেলে এখাতে আরও ভাল ফলাফল আশা করা যায়। গবাদী পশু পালনে গবেষণা পর্যায়ে যে সাফল্য রয়েছে মাঠ পযায়ে তার দ্রুত সম্প্রসারণ জরুরী। টেলিভিশনে আমরা বিভিন্ন জনের সাফল্য গাঁথা দেখি। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ খাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে। কিন্তু এ অঞ্চলে (চট্টগ্রাম) এখানে-সেখানে সেভাবে খামার গড়ে ওঠেনি, হয়তো আছে।
আমাদের উন্নয়ন অগ্রগতির অন্যতম বাধা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার এই দেশ। এগুলো মাথায় রাখলে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন সহজ হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো সম্ভব নয়। ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পযায়ে রাখা সম্ভব। টেকসই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী খনন, খাল, নালা, ছড়া পুনরুদ্ধার, প্রয়োজনে নতুন খাল খনন করে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা এড়ানো সম্ভব। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সড়ক যোগাযোগের মতো কিংবা তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে এ বিভাগকে চাঙ্গা করা যায়। ভুপৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্লুইজ গেইট নির্মাণ করে জলাধার স্থাপনের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে সেচের প্রয়োজন মেঠানো যেতে পারে। এতে মাছ উৎপাদন হওয়াও সম্ভব এবং সেই সাথে ভুগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানোর সুযোগ রয়েছে।
উপকুলের দুঃখ উপকুলের বেড়িবাঁধ। একই সাথে বাংলাদেশেরও দুঃখ উপকুলের বেড়িবাঁধ। উপকুলের সতেরটি জেলার প্রায় চার কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এর ভুক্তভোগী। পুরান ঘায়ের ব্যথা কম। সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমন খবর জানা নেই। বেড়িবাঁধ নিয়ে সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনার কথা শুনা যায়। উপকুলের একজন অধিবাসী হিসেবে আশায় বুক বেঁধে আছি। বেড়িবাঁধের একটি স্থায়ী সমাধান করা গেলে পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটতে পারে।
রিডিং রুমে বসে সুপারিশের গীতাঞ্জলি রচনা করা যতটা সহজ মাঠ পর্যায়ে য়ে বাস্তবায়ন করা ততটা কঠিন। এজন্যে দরকার সৎ, দক্ষ, কর্মট ও দেশপ্রেমিক জনবল। এই লোক কি আমাদের আছে? হয়তো আছে৷
===============
বিষয়: বিবিধ
৫০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন