ফনী বাবু স্যার

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ শাহ ই জাহান ১১ অক্টোবর, ২০১৮, ১০:২৬:৫০ রাত

শ্রী ফনী ভূষণ দাস মহাশয় অামার প্রিয় শিক্ষক৷ এতদিন মনে হতো তাহের স্যার অামার উপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে অাছেন৷ তার কারণও অাছে, স্যারের অান্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা, পাঠদানে দক্ষতা, অন্যকে শেখানো ও শেখার অাগ্রহের সাথে তুলনা করার মতো অামার অধ্যয়নকালীন সময়ে দেখিনি৷ তার উপর তিনি অামাদের প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের নিজস্ব প্রোডাক্টতো বটেই, অামাকেও বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন এবং দেখেন৷ অামি স্বীকার করছি, তাহের স্যারের চেয়ে দক্ষ শিক্ষক ছিলেন, অাছেন এবং থাকবেন৷ অামার সীমাবদ্ধতার কারণে নজরে পড়েনি হয়তো৷ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, কিন্তু অনেকের প্রিয় কবি নন৷ প্রত্যেকের এক একজন ঘরোয়া কবি থাকেন৷ একইভাবে প্রত্যেক ছাত্রের এক একজন প্রিয় শিক্ষক থাকেন অার প্রত্যেক শিক্ষকের এক একজন বিশেষ ছাত্র থাকে৷ অাজ যখন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসছি, অামার অবচেতন মনে ফনী বাবু স্যারই নাড়া দিয়ে যাচ্ছেন বার বার৷

স্যারের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র হওয়ার পূর্ব থেকে তিনি অামার পরিচিত৷ তিনি অামার মামার শিক্ষক, মামীর শিক্ষক এবং অামার নানার বন্ধু৷ স্যার ক্লাসে ঢুকে অামাকে দাঁড় করিয়ে অামার নানার সাথে পুরনো বন্ধুত্ব ঝালাই করে নিতেন৷

ফনী বাবু স্যার অামাদের বাংলা পড়াতেন৷ অামরা তখন সপ্তম ক্লাসে৷ তিনি সমাস এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করছিলেন৷ কালিদাশ ছিলেন সে যুগের মহা পন্ডিত; সমসাময়িক কালে অার একজন বিখ্যাত পন্ডিত পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিলেন৷ সামনে একটি শুকনো কাঠ দেখে দু' জন ভাবটা প্রকাশ করলেন, "নিঃ রসঃ তরু বরো পুরোভাগে," কালিদাশ বললেন৷ অন্যজন বললেন, "শুস্কং কাস্টং তিস্টতি অগ্রে৷" ভাষার বিচারে কালিদাশ এর প্রকাশটা শ্রুতি মধুর ; অার সমাসের কাজ হলো ভাষাকে শ্রুতি মধুর করা৷ এই সংস্কৃত উদ্ধৃতি কতটুকু সঠিকভাবে বলতে পারলাম জানিনে, যদি ভুল হয় তা অামার শোনার ভুল অথবা স্মৃতির ভুল৷

পাঠদানে স্যারের উপমা এবং উদাহরণ গতানুগতিক ধারা অতিক্রম করে এক ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পেত৷ সেখানে তিনি "ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া অাঙ্গিনার" উদাহরণ দিতে যেমন পারঙ্গম ছিলেন, একইভাবে "বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দুরে'' র উপমা ব্যবহার করতেও স্যারের তুলনা ছিলনা৷ পাঠদানে স্যারের অালোচনায় পাঠ্যবহির্ভূত বিষয় প্রাধান্য পেত৷ হুমায়ুন কবিরের "মেঘনার ঢল" কবিতাটি পড়াতে গিয়ে তিনি The Sands of Dee কবিতাটির তুলনা করেছিলেন- ''ভৌগলিক দুরত্ব, কালের ব্যবধান থাকলেও সব মানুষের চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ একই৷" অামরা নবম ক্লাসে কবিতাটি পড়েছিলাম৷ অামাদের প্রধান শিক্ষক রহমান স্যার কবিতাটি অাবৃত্তি করেছিলেন৷ মেরির জন্য স্যারের অাবেগ দেখে অামাদের চোখের কোণাও ভিজে উঠেছিল৷ সেখানকার জেলে ও মাঝি-মাল্লারা এখনও নাকি মেরির ডাক শুনতে পায়৷ অামাদের প্রধান শিক্ষক মহোদয় Dee নদীতে ডুবে যাওয়া মেরি ও তার সোনালী চুলের বর্ণনা দিয়েছিলেন, মেঘনা সর্বনাশীতে ডুবে যাওয়া অামিনার কাল চুলের সাথে ফণী বাবু স্যারের তুলনার যথার্থতা সেদিনই উপলব্ধি করতে পেরেছি৷

চাঁটগার অাঞ্চলিক প্রবাদ স্যারের ঠোঁটাগ্রে লেগে থাকত৷ অামার অাফসোস হয় কেন সেগুলো টুকে রাখলাম না৷ স্যার অাঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন, অধিকাংশ সময় পাঠদানও অাঞ্চলিক ভাষায় চলতো৷ বাক্য বিন্যাস, প্রকাশভঙ্গী এবং শব্দ গ্রন্থন নৈপুণ্যে সে ভাষা হয়ে উঠতো মোহনীয়, কান ফেরানোর জো ছিলনা৷

স্যার স্কুলে ক'টা বাজে অাসবেন কিংবা ক'টার সময় ফিরবেন, ক্লাস নেবেন নাকি অফিসে বসে কোন ছাত্রীর শ্বশুড় বাড়ির গল্প শুনবেন অথবা ক্লাসে পড়াবেন কি ঘুমাবেন সে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুপ্রিম পাওয়ার স্যারের ছিল৷ এ ব্যাপারে খবরদারী করার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা হয় বন্ধু নয়তো ছাত্র৷ তাই কেউ স্যারের ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাতেন না৷ স্যারও সে সুযোগটা কাজে লাগাতেন৷

একদিন অামরা স্যারকে ধরলুম স্যার, 'পথের পাঁচালী উপন্যাস' এর অপুর চরিত্র সম্পর্কিত প্রশ্নটির যদি নোট দিতেন৷ স্যার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, "ব্যাডাইনের সোয়াগ ছা- ত! অাঁ- র দোয়ানত তিন মিনিট বই- লে পাঁচ্ছল্লিশ টেঁয়া পাই, অার এন্ডে গোডা দিনে পাই পাঁচ্ছল্লিশ টেঁয়া, এ্যাডে অাবার নোডর হতাও হয়৷ অপুর চরিত্র হঅইলান্দে অ্যাঁত্তে হানত তালা দিইলি না!"

অামাদের উদ্দেশ্য মুলত স্যারের বকা খাওয়া৷ এ বকাও অামাদের কাছে উপভোগ্য ছিল৷

অামার বন্ধু মুজিব ফণী বাবু স্যারের প্রিয় ছাত্র৷ স্যারের ক্লাসে তারই একাধিপত্য৷ শোরগোল থামানো, অফিস থেকে চক-ডাস্টার-বেত অানা-নেওয়া, ঘুম থেকে জাগিয়ে ক্লাস শেষ হওয়ার সময়টা বলে দেওয়া ইত্যাদি কাজে সে স্যারকে সহযোগিতা করতো৷ স্যারও মুজিব ছাড়া অার কাউকে দেখতেন না৷ স্যারের হাতে বেত থাকলেও সেটার ব্যবহার কখনও দেখিনি৷ মুজিব হিসেব-নিকেশ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিল- স্কুলে অাসা স্যারের জন্য সমুহ লোকসান, দোকানের ইনকাম না থাকলে খুব কঠিন অবস্থা হতো৷

শুনে স্যার খুশি হলেন৷ মুজিবের মতলবি কথা স্যার বুঝতেন না৷ স্যারদের কাছে যে কাজগুলো অপ্রয়োজনীয় ও বিরক্তিকর সেগুলো মুজিব মহা উৎসাহে করে যেত৷ কোন সুষ্ঠু কাজে প্যাঁচাল লাগানো ছিল তার কাজ৷ এ ব্যাপারে অামাদের সমর্থন ও উসকানি থাকত বটে, কিন্তু অামরা থাকতাম দৃশ্যপটের অাড়ালে৷ যাবতীয় ঝড়ঝঞ্জা মুজিবের পিঠের উপর দিয়েই বয়ে যেত৷

কিছুদিন সে অামাদের প্রধান শিক্ষক মহোদয়েরও প্রিয় হয়ে উঠেছিল ; পরে স্যার বুঝতে পেরেছিলেন৷ অামদের তৎকালীন শিক্ষক বাবু অনীল কান্তি ধর ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে যে কোন গন্ডগোলের জন্য বিনা ওয়ারেন্টে মুজিবকেই রিমান্ডে নিতেন৷ অার ফণী বাবু স্যার প্রিয় ছাত্রের দুর্দশা দেখে অাফসোস করতেন, "মুজিব! এ কি করলি তুই৷"

সপ্তাহে সোমবার দিন স্যার কুম্ভকর্ণের মেঝাজে থাকতেন৷ রবিবার রাত জেগে দোকানদারী করতে হতো বলে পরদিন ঘুমের ঘোরে থাকতেন এবং অনেক সময় ক্লাসেই কাজটা সেরে নিতেন৷ রবিবার এবং বিষ্যুদবার থাকতেন মিলিটারি মেঝাজে৷ দিনগুলোতে হাটবার থাকায় তাড়াতাড়ি দোকানে পৌঁছানোর তাড়া থাকত৷ বাকী দিনগুলো থাকতেন প্রফুল্ল মেঝাজে, তখনই অামরা স্যারের পান্ডিত্য অাঁচ করতে পারতাম৷

কি কারণে জানিনে, প্রত্যেক ক্লাসে নোটিশ দেয়া হলো কোন শিক্ষকের পাঠদানের ব্যাপারে যে কোন অভিযোগ যেন অফিসে জানানো হয়৷ অামাদের ক্লাসে বিশেষ করে ছাত্রীদের দাবী, বাংলার পরিবর্তে যেন অন্য বিষয় ফণী বাবু স্যারকে দেয়া হোক৷ ল্যবরেটরী কক্ষের সামনে করিম স্যারকে দাবীটি জানানো হলো৷ দাবী শুনে করিম স্যার অাকাশ থেকে পড়লেন, "ফনী বাবুর চেয়ে বাংলা সাহিত্য অন্য কেউ ভাল পড়াবেন অামার অন্তত জানা নেই৷" মুজিব খুশি হয়ে বললে, রাইট স্যার৷ অামিও খুশি হলাম৷

ক্লাসে কোন কোন সময় পারিবারিক কথা চলতো৷ স্যারের মেঝাজ বুঝে কথার মোড় সে দিকেই ঘুরিয়ে দিতাম- স্যার, শুনলাম অাপনার মা নাকি এখনও বেঁচে অাছেন৷ স্যার তখন বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে যেতেন৷ চেয়ারে হেলান দিয়ে উপরের দিকে চেয়ে কি অাউড়াতেন শুনতাম না, ঠোঁট নাড়ানো দেখতাম৷ স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় স্যারের চোখে জল এসে যেত৷ চোখ মুছে সোজা হয়ে বসে মহা উৎসাহে মায়ের কথা বলে যেতেন, "দুনিয়াতে মা হলো বড় নেয়ামত৷ মা বেঁচে অাছেন বলে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছি, অনুভব করছি৷ এ এক ভিন্ন অনুভুতি৷ তুলনা করা যায়না, ভাষায় প্রকাশের অসাধ্য৷ ভগবান মা'কে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং সুস্থও রেখেছেন৷ প্রতিদিন স্কুলে অাসার সময় মা অামাকে অাশীর্বাদ করেন৷ ভাত খাখাওয়ার সময় পাখার বাতাস করেন৷ এটা খা ওঠা খা বলে কত অাদরই না করেন৷"

শুনে স্যারের প্রতি অামাদের ঈর্ষা হতো৷ স্যারের মা কিভাবে পানের খিলি করে স্যারকে দেন তা অামাদের অভিনয় করে দেখান৷ অামরা তখন হেসে কুটি কুটি৷ স্যারও হাসেন৷ পানের খিলি মুখে দিয়ে মা'র পা ছুঁয়ে সেলাম করে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হন৷

বায়েজিদের মাতৃভক্তির কথা শুনেছি, বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির ঘটনাও অামাদের জানা অাছে অার এ কালের মাতৃভক্তির অাদর্শ ফণী বাবু স্যারকে দেখলাম৷

অামার মা পান খান না৷ অামি পান খাই বলে মা অামার জন্য পান যোগাড় করে রাখেন৷ আর মা অামাকে পান দেওয়ার সময় মনের পর্দায় ফণী বাবু স্যার ভেসে ওঠেন৷

স্কুলের সাময়িক পরীক্ষার সময় অামি ও মুজিব পাশাপাশি বসতে চেষ্টা করতাম৷ উদ্দেশ্য ছিল পরস্পরের উত্তরপত্র থেকে দেখে দেখে লেখা৷ স্যারদের কড়াকড়ির কারণে সেটা অনেক সময় হয়ে উঠতো না৷ তারপরও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম৷ এমনি এক পরীক্ষার দিন ফণী বাবু স্যার হল পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন৷ অামরা যারা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের চেষ্টায় থাকতাম, অামাদের খুশি দেখে কে! অামরা মা কালী, মৌলা অালী, পীর মুর্শিদের নাম নিয়ে দেখাদেখি শুরু করলাম৷ মুজিবের উত্তরপত্রের নিচে বইয়ের পাতা স্পস্ট দেখা যাচ্ছে৷ অামি তাকে সতর্ক করলাম৷ সে কেয়ার করল না৷ বলে কি, ফণী বাবু স্যার, অসুবিধা নেই৷ অামিও ভাবলাম, তাইতো৷

স্যার অাসলেন, দেখলেন, কিছুই করলেন না৷ অফিসে চলে গেলেন৷

মুজিব বললে, দেখলিতো, কিছুই হবে না৷

পরক্ষণে স্যার ফিরে এলেন৷ এক হাতে বেত অার হাতে নোটিশ খাতা৷ স্যার টেবিলে বেত্রাঘাত করে সকলের দৃষ্টি অাকর্ষণ করলেন৷ তারপর শুরু করলেন- Notice is here by given that

Shah-E-Jahan and Mujibur Rahman the students of class nine bearing Roll No. ........ and ..........respectively have been expelled for adopting unfairmeans in the examinatuon.

ইন্নালিল্লাহ! মুজিব! এ কি শুনি!

"অালহামদুলিল্লাহ, করিম স্যারের মাইর থেকে বাঁচলাম৷"

এতদিন নকল ধরা পড়লে অফিসে যেতে হতো৷ সেখানে করিম স্যার অাচ্ছামতো ধোলাই করতেন৷ তারপর জীবনে নকল না করার ওয়াদা করে অাবার সিটে গিয়ে বসতে বসতে এই! ন নম্বর প্রশ্নের বইয়ের পাতা থাকলে দে, তোর হাতের লেখা পড়তে পারব না৷ তাড়াতাড়ি দে, সময় শেষ৷

পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে এ পদ্ধতিতে ফণী বাবু স্যারের দেয়া শাস্তি অামার জানামতে সেই প্রথম তাও অাবার ইংরেজি নোটিশ দিয়ে৷

গড়পরতা বাঙালী সাইজের চেয়ে স্যার খানিকটা ছোটখাট ছিলেন৷ জীবনের প্রান্ত সীমায় এসেও স্যারের চুল-দাড়ি পাকেনি৷ সহজ সরল মুখ খানার সাথে কানের উপর বড় বড় লোমগুচ্ছ নিষ্পাপ শিশুর মতো মনে হতো৷

অাজ মানস চক্ষে দেখতে পাই, গায়ে ছাই রং এর ঢিলে পাঞ্জাবী, পরনে নীল রং এর লুঙ্গি, কাঁধে ছাতা, স্যার স্কুলে অাসছেন। পথে হাজারও মানুষের সাথে কুশল বিনিময় হচ্ছে৷ সবাই স্যারকে চেনে৷

সহজ-সরল, অকৃত্রিম, অজাতশত্রু মানুষটি অাজ অার নেই৷ কি একটা জটিল রোগে ভুগে চিকিৎসার জন্য কলকাতা গিয়েছিলেন৷ সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন৷

বিষয়: সাহিত্য

৬২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File