স্বপ্নের শহর
লিখেছেন লিখেছেন মেহেদী হাসান হাসিব ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ০৫:১০:১১ বিকাল
সারাদিন উন্মুক্তমনে বনে-জঙ্গলে, ঘাটে-মাঠে, বাজারে, গাছের ডালে কখনো খালের জলে সাঁতার কেটে এভাবে দিনকে দিনকে শিশুমন আরো উদ্যমী হয়ে উঠে। আগ্রহ আর রোমাঞ্চ প্রিয় পাঁচ বছরের নবীন খুব চঞ্চল আর রাগি। যা চাইবে তা না দেয়া পর্যন্ত কান্নার রোলে ঘরময় মাতিয়ে তুলবে নয়ত হাতের কাছের প্রিয় জিনিসগুলই রাগ করে ভেঙে গুড়িয়ে দিবে। আজও সেই কান্নার আলোড়ন মাকে কত করে বলল সে স্কুলে যাবে না। স্কুলে স্যাররা পড়া না পারলে মারে। মাও তাকে বোঝাল, ‘আমি স্যারকে বলে দিয়ে আসব মারবে না।’ তারপর নবীব বলল, ‘না মারবে। আর কতসাথে কতজন বসে থাকে। স্যার সবার সামনে পড়া ধরলে আমি লজ্জায় পড়া বলতে পারব না।’ ‘আমি স্যারকে বলে দিব পড়া ধরতে না—চল বাবা না ভাল আমার। স্কুলে গেলে আজকে রাতে তোকে একটা গল্প শোনাব। ঢাকা শহরের গল্প।’ ‘কি ঢাকার গল্প! শোনাবাতো নয়ত কালকে আবার যাব না।’
তারপর ছেলেকে বুঝিয়ে-টুজিয়ে স্কুলের প্রাঙ্গনে হাজির হয়ে দিয়ে আসল। ছেলের সাথে কতক্ষণ বসে থেকে স্যারকে বলে আসলেন দেখে রাখতে। উফ! ছেলেটা বেজায় রাগি–প্রথমদিন স্কুল যাওয়ার জন্য বাচ্চারা খুশিতে টইটই করে আর সে কিনা কান্না!
স্কুল থেকে ফিরেই আবার কান্নাকাটির জুরি বসাল। দাদি এসে শাড়ির আঁচল দিয়ে চেহারা মুছে বলল, ‘ভাই তুইতো অনেক বড় হবি পড়াশোনা করে। পড়তে গেলে কান্না করে না।’ হাউমাউ কান্নার ভিতর বলে চলছে, ‘ক্লাসে আমার অনেক শুশু ধরছে। স্যারকে বলি নাই ভয়ে, স্যারের চেহারা কি ভয়ংকর! পরে প্যান্টে প্রসাব করে দিছি আর স্যার বকা দিছে।’ দাদি বলল, ‘এখন কিছু খেয়ে নে। তারপর গিয়ে পড়তে বস যা।’
নবীন বায়না ধরেছে খাবে না। মা বলল সে যদি খায় তাহলে ঢাকা শহরের গল্প শোনাবে।
বাটি হাতে নিয়ে বাটিতে ভাত আর তরকারি মেখে একগ্রাস মুখে দিতে দিতে বলছে, ‘শোন ঢাকার শহরের গল্প বলি। ঢাকায় বড় বড় বিল্ডিং একেবারে আকাশের সাথে লাগানো একেকটা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাঁদে উঠলে আকাশের পিঠে বসা যায়। নবীব যেন কল্পনায় সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ঢাকায় সবাই গাড়িতে ঘুরে। আর তোর বাবার মতো গরীবরা রিক্সায় ঘুরে। তোর বাবাকে বললাম তোর জ্বালায় আর থাকতে পারি না। তোকে তোর বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারতাম বুঝতো কত কষ্ট করি এই ছেলেকে নিয়ে।’ ‘মা তুমি কি এতক্ষণ গল্প বলছো?’ ‘হুঁ।’ ‘এটা কেমন গল্প? আচ্ছা ঢাকা শহরে কি আমাদের মত গাছ নাই।’ ‘নারে বাবা সব বিল্ডিং। আর সবার ঘরে ঘরে টিভিতো আছেই। ঘরের ভিতরই রান্নাঘর, গোসলখানা সব। আর বিল্ডিং থেকে বাহির হলেই দোকান, বাজার। আমাদের মত এত কিলোমিটার ওদের হাঁটা লাগে না।’
তারপর থেকে নবীন স্বপ্নেও ঢাকা শহর দেখে। রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে কল্পনা করে ঢাকায় গিয়ে সে সেই ব্যাংকের ছাঁদ থেকে আকাশে উঠে বসে থাকবে। আর টিভিতে সারাদিন টম এন্ড জেরির কার্টুন দেখবে। তাদের বাজারে একটা মাত্র দোকানে টিভি তাও এত ভিড় যে বাচ্চারা দাঁড়াতেই পারে না। আর কতরকম খেলনা ঢাকা শহরে—ইচ্ছে হচ্ছে সে যেন এখনি বাতাসের সাথে স্বপ্নের শহরে চলে যায়।
সেবার বৈশাখে নবীনের ছোট চাচা ঢাকা থেকে বেড়াতে আসে। যাওয়ার সময় সে বায়না ধরে সে ঢাকা যাবেই। আর তার বায়না মানেই কারো সাধ্য নেই তাকে থামানোর। চলে আসলো চাচার সাথে। বাসে জানালার পাশে বসে সে কত নদী, কত ক্ষেত আর কত লম্বা বিল্ডিং পার করেছে খেয়াল নেই। কারণ একসময় সে ঘুমিয়ে যায়। আর উঠে দেখে মানুষে আর গাড়িতে গিজিবিজি রাস্তা। এত কোলাহল। সে একসাথে এত কোলাহল কখনো শোনেনি। স্কুলে ছুটি হলেও সবাই এমন শব্দ করতো তবে এতটা তীব্র না। তারপর বাস থেকে নেমে রিক্সা তারপর সোজা চলে গেলো নবীনের বাবার দোকানে। ‘ভাই কী করব আপনার ছেলে বায়না ধরছে সে ঢাকা আসবেই।’ ছেলেকে দোকানে বসিয়ে নানা রকম চকলেট আর বিস্কুট খাওয়ালো। একেএকে চিপস আইসক্রিম সব খেয়ে দেখলো। ঢাকায় এত মজার মজার আইসক্রিম পাওয়া যায় এত বড় বক্সের ভিতর সে আগে জানতো না।
প্রায় তিনদিন বাবার সাথে ঢাকা থাকার পর একদিন নবীনের জ্বর হলো। নবীন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বলল, ‘বাবা আমি মার কাছে যাব। এখানে আর ভাল লাগে না। মানুষ আর মানুষ ঢাকায়। এত বড় বিল্ডিং রাতে চাঁদ মামাকে দেখতে পাই না, কোন গাছ নাই গাছের ডালে শুয়ে ঘুমাতে পারি না। পুকুর নাই, দেয়াল ফুটো হয়ে পানি পড়ে সেটা দিয়ে গোসল করতে আমার ভাল লাগে না। আর ঢাকা শহরে মা বলছে বিল্ডিং থেকে আকাশ ছোঁয়া যায়। কই যায় নাতো। আর দেশে আমি খোলা আকাশে হাঁত বড় করলেই মনে হয় আকাশে উড়ছি। বাবা এই ঢাকা শহর ভাল না, আমি মার কাছে যাব।’
বিষয়: বিবিধ
৫৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন